চেকের মামলা দেওয়ানী মোকদ্দমার মতো সংশোধনী ও প্রাসঙ্গিক আইন
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

আমাদের ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা যেন শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা!

সিরাজ প্রামাণিক : ‘শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা’ একটি বাংলা প্রবাদ। যার অর্থ কারও উপর এমন দায়িত্ব দেয়া, সেই ব্যক্তিই তার ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রবাদটি একটি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করে মাত্র। বহু বছর আগে মার্কিন মানবতাবাদী মার্টিন লুথার কিং লিখেছিলেন, ‘যে কোন জায়গায় অবিচার ঘটলে তা সমস্ত জায়গার বিচারকে হুমকির মুখে ফেলে। ফরাসী দার্শনিক আঁনাতোলে ফ্রান্স লিখেছিলেন, ‘আইন যদি সঠিক হয় তাহলে মানুষও ঠিক হয়ে যায় কিংবা ঠিকভাবে চলে। অপরাধ সংঘটিত হলে বিচার করার জন্য আমাদের আইনের কোন অভাব নাই। অভাব শুধু ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে। আইন নিজস্ব গতিতে না চলে, চলে চালকের গতিতে।

আমরা সবাই জানি, একটি ফৌজদারী মামলা শুরু হয় অভিযোগ দাখিলের মধ্যে দিয়ে। তারপর তদন্ত, অভিযোগ গঠন, সাক্ষী শুনানি পার করে আসে রায়। ফৌজদারী মামলার বিচারে দোষী সাব্যস্ত করতে হলে অপরাধ সন্দেহাতীত প্রমাণ করতে হয়। সন্দেহাতীত প্রমাণের একটা বড় উপাদান হলো ঘটনার তদন্ত। মামলা আদালতে বিচারে গড়ানোর আগেই তার গতিপথ ও ফলাফল অনেকটা নির্ধারণ করে দিতে পারে এ তদন্ত। এ কারণে ফৌজদারী অপরাধে তদন্ত যাতে ভালো করে হয় সেজন্য অনেক দেশেই তদন্তের জন্য স্বাধীন তদন্ত সংস্থা আছে।

আমাদের দেশে পুলিশই তদন্ত করে। শিয়ালের কাছে মুরগী বর্গা দেয়া হয়। আর অভিযুক্তের রিমান্ড হলো তদন্তের প্রধান হাতিয়ার। সে হাতিয়ারে মাঝে মাঝেই হাতি হয়ে যায় ঘোড়া, মানুষ হয়ে যায় জঙ্গি পশু, আর “লুকিং ফর শত্রুজ” হয়ে যায় জজ মিয়া। এটা যেন তদন্ত সংস্থা নয়, হাতি ঘোড়া আর জজ মিয়া উৎপাদনের কারখানা। আমাদের কথিত স্বাধীন বিচার বিভাগ এ কারখানার কাছে বড় অসহায়।

আরও পড়ুনসারজিসের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার আবেদনের আদেশ ২০ জুলাই

ফৌজদারী মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া আছে পাবলিক প্রসিকিউটার বা সরকারী উকিলের উপর। মামলার কৌঁসুলি চাইলে পুলিশি তদন্তকে টেক্কা দিতে পারে। কিন্তু টেক্কা দিতে হলে তো ঘটে মাল থাকতে হবে! কে না জানে সরকারী উকিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যোগ্যতার মাপকাঠিতে হয় না, তারা নিয়োগ পান তাদের খুঁটির জোরে। কাজেই সে খুঁটি নড়লে তারা নড়েন। নইলে তারা বসেই জাবর কাটেন। তদন্ত আর প্রসিকিউশন দুইকেই প্রভাবশালীরা প্রভাবিত করতে পারবেন এমন সুযোগ আছে। হয় কি-না জানি না তবে উপসর্গ তো দেখি।

আমরা দেখেছি কোন কোন মামলার তদন্ত শুরু হয় ঠিকই কিন্তু শেষ হয় না কখনো। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকেও কোন তাড়া থাকে না। মামলায় তারিখের পর তারিখ পরে, কিন্তু মামলা বিচারে আর উঠে না। স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার স্বাধীন বিচারকরা অসহায় ভাবে লিখে যান: দেখিলাম, শুনিলাম; দরখাস্ত মঞ্জুর করিলাম। সাগর রুনির মামলার তদন্ত শেষ হয় না, তনুর মামলার বিচার শুরু হয় না। আমরা সংস্কার নিয়ে কত কথা বলছি; কিন্তু ব্রিটিশদের তৈরী আইন দিয়ে চলমান ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা নিয়ে কেউ কথা বলছি না। এভাবেই চলছে শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দিয়ে আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও পিএইচ.ডি ইন ল। ই-মেইল : seraj.pramanik@gmail.com