জিয়াবুল আলম : দেশে বেশ কিছু দিন ধরে আদালত পাড়ায় একটা হুজুগে কথা প্রচলন শুরু হয়েছে। সেটি হচ্ছে ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সালের মধ্যে যদি ভুমি রেকর্ড সংশোধন সংক্রান্ত মামলা না করে তাহলে আর মামলা করা যাবেনা। সেই হিসেবে আজকে ল্যান্ডে সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করার শেষ দিন। আর এই কথা শুনে শতশত মানুষ যেভাবে এলএসটি অর্থাৎ ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করতে ছুটাছুটি করছেন, মনে হচ্ছে পবিত্র কোরআনে সুরা জিলজালে বর্ণিত কিয়ামতের আলামত শুরু হয়েছে।
আইনের পটভূমি
আসলে এই কথার সূত্রপাত হয়েছে ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালে সরকার এই বিষয়ে একটি গেজেট পাশ করেছিল।
গেজেটি ছিল বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে State Acquisition and Tenancy (Amendment) Act, 2023 (২০২৩ সালের ২৪ নং আইন) এর section 145A এর sub-section (3C) অনুযায়ী ঢাকা, যশোর, ফরিদপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, টাঙ্গাইল, খুলনা, রংপুর, বরিশাল, সিলেট, বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ভোলা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার সিনিয়র সহকারী জজ/সহকারী জজ-কে স্ব স্ব জেলার ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বদলীকৃত মামলাসমূহ বিচারের নিমিত্ত নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।
পাশাপাশি একই আইনের section 145B এর sub-section (3C) অনুযায়ী উপরোল্লিখিত জেলাসমূহের অতিরিক্ত জেলা জজ-কে স্ব স্ব জেলার ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক বদলীকৃত মামলাসমূহ বিচারের নিমিত্ত নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচারক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে এবং ৬ (ছয়) মাসের জন্য বলবৎ থাকবে।
মামলা দায়েরের সময়সীমা নিয়ে বিভ্রান্তি
তবে আইনে বলা আছে গেজেট পাশ হওয়ার দুই বৎসরের মধ্যে এলএসটি মামলা অর্থাৎ জমির রেকর্ড সংশোধনের জন্য মামলা দায়ের করতে হবে। সেই হিসেবে এল এস টি মামলা দায়ের করার আজকে শেষ দিন। আজকে যুগ্ম কোর্টে গিয়ে দেখতে পেলাম শত শত মক্কেল আর আইনজীবী দাঁড়িয়ে আছে এল এস টি মামলা ফাইল করার জন্য।
দাড়িয়ে থাকা মানুষের মধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম “মামলা দায়ের করতে এত তাড়াহুড়ো কেন করতে হচ্ছে??”
তারা বললেন, আজকে হচ্ছে মামলা ফাইলের শেষ দিন। আজকে এলএসটি অর্থাৎ ল্যান্ডে সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করতে না পারলে আমাদের জমিজমা চলে যাবে এবং আর কোনদিন ভূমি রেকর্ড সংশোধন সংক্রান্ত মামলা দায়ের করতে পারবনা। তাই আমাদের এত তাড়াহুড়ো।
এই কথা শুনে মনে মনে হাসলাম। আসলে কি তাই? আজকে যদি এলএসটি মামলা দায়ের করতে না পারি তাহলে ভুমি রেকর্ড সংশোধন নিয়ে পরবর্তীতে আর কোন মামলা করা যাবেনা? যদি এই কথা কেউ বলে থাকে সেটি সঠিক নয়। কারণ ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করা না গেলেও দেওয়ানী আদালতে ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী ঘোষণামূলক মামলা দায়ের করে প্রতিকার চাওয়া যাবে।
কারণ সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারায় সুস্পষ্ট বলা আছে যদি কোনো সম্পত্তির মালিক হন, বা কোনো পদে অধিষ্ঠিত হন, কিন্তু অন্য কোনো ব্যক্তি আপনার সেই স্বত্ব বা অধিকারকে অস্বীকার করে, তাহলে আপনি এই ধারার অধীনে মামলা করতে পারেন। যেহেতু গেজেটে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনে মামলা করতে বারিত করেনি তাই এই আইনে মামলা দায়ের করে ভূমি রেকর্ড সংশোধন সংক্রান্ত প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ আছে।
সাংবিধানিক অধিকার
আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪২ এর মধ্যে বলা আছে আইন দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধের অধীনে প্রতিটি নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্য কোনোভাবে বিলি-বিনিয়োগ করার অধিকার থাকবে। সেহেতু সম্পত্তি অর্জন একটা মৌলিক অধিকারের অংশ। সরকার চাইলে মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারেনা।
যদি জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করে তাহলে ৪৪/১০২ ক্ষমতা বলে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট করেও প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ আছে।
উপসংহার
সুতরাং ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে ভুমি রেকর্ড সংশোধন সংক্রান্ত ৯ সেপ্টেম্বর ২৫ সালে মামলা দায়ের করতে না পারলে পরবর্তী উক্ত ভুমি রেকর্ড সংশোধন সংক্রান্ত কোন আদালতে মামলা দায়ের করা যাবেনা—এই কথা সঠিক নহে।
লেখক: আইনজীবী; বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।