মোঃ ওবাইদুল্যাহ আল মামুন সাকিব : অনুচ্ছেদ ৭(১) এ বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। যদিও জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক, তারা কিন্তু কেউ সংবিধান অনুসারে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে না। জনগণের পক্ষে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিগনই সংবিধান অনুসারে কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
জনগণ মালিক বলে আমরা সবাই জানলেও আসলে এদেশের জনগণ প্রকৃত অর্থে কেউ মালিক না। বাস্তবতা এবং প্রয়োগে এই জনগণ হলো দাস। আর যারা জনগণ থেকে ক্ষমতা পেয়ে যান তারা জনগণকেই শোষণের চিন্তায় মশগুল। রাজা ও প্রজার শাসন চলে এই অঞ্চলে। শুধু ভোটের সময় আসলেই জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক বলে উতলা হয়ে যায়।
এবার আসি, জুলাই গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লব, যা বলেন না কেন, জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল ছাত্ররা। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সাধারণ পরিবারের, খেটে খাওয়া কৃষকের ছেলে মেয়েদের আন্দোলন। এই আন্দোলন ছিল শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত জনগণের বিস্ফোরণ। স্বৈরশাসকের পতনের পর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকার গঠন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠে।
আরও পড়ুন : সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবারো বৈঠকে ঐকমত্য কমিশন
পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও আন্দোলন আইন মেনে হয় না। আন্দোলন হয় আইন ভাঙার জন্য, নতুন আইন প্রণয়নের জন্য। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন, নতুন করে আইনের ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলো।
বিদ্যমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ অনুচ্ছেদ ৫৭ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ অবসান হবে:
১) যদি তিনি পদত্যাগ করেন
২) যদি সংসদ ভেঙে যায়
৩) সংসদ সদস্য হিসেবে থাকতে অযোগ্য হয়ে যান।
এগুলো ঘটলে প্রধানমন্ত্রীর পদ অবসান হবে। তবে প্রধানমন্ত্রী পদে তার উত্তরসূরী না আসা পর্যন্ত তিনি স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন, তিনি কি পদত্যাগপত্র দিয়েছেন রাষ্ট্রপতির নিকট? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যাওয়া বাতুলতা বৈ কিছু না।
আরেকটি প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেলে বিদ্যমান সংবিধানে যেহেতু কোন বিধান নেই, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির করণীয় কী? সেটাও কিন্তু এই সংবিধানে নেই। সুতরাং, বিদ্যমান সংবিধান বহাল থাকাবস্থায় শেখ হাসিনার পদ নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। যেহেতু জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এখনো পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে পারষ্পরিক সমঝোতা হয়নি, এবং সংবিধান বহাল তবিয়তে, সেহেতু সাংবিধানিক শূন্যতায় প্রশ্নের জন্ম নেয়া অবান্তর নয়।
০৫-০৭ আগস্ট ২০২৪, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যাওয়া, মন্ত্রীসভা বিলুপ্ত করা, সংসদ ভেঙে দেয়াসহ রাষ্ট্রপতি নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। ০৮ আগস্ট ড. ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ড. ইউনুসকে রাষ্ট্রপতি একক সিদ্ধান্তে শপথ পাঠ করাননি। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের কাছে রাষ্ট্রপতি অনুচ্ছেদ ১০৬ এর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে বললে, আপীল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকার গঠন করা হয়।
এখানেই মূল প্রশ্ন জড়িত, অনুচ্ছেদ ১০৬ অনুযায়ী—
যদি কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এইরূপ কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, যাহা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রীম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি প্রশ্নটি আপীল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করিতে পারিবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানীর পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করিতে পারিবেন।
বলা হয়েছে যে, “আইনের এইরূপ কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে”—এটার মানে হলো বিদ্যমান কোন আইনের কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া। এক্ষেত্রে সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে সংজ্ঞায়িত “আইন” অর্থ কোন আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোন প্রথা বা রীতি; তার মানে উত্থাপিত বিষয়টি অবশ্যই বিদ্যমান আইনের হতে হবে। যেটা আইনে নেই সেটা নিয়ে ব্যাখ্যার ও কোন প্রয়োজন নেই আপীল বিভাগের।
নতুন কোন আইন প্রণীত হলে সেটা যদি এমন কোন সাংবিধানিক সাংঘর্ষিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তখন সেক্ষেত্রে বিদ্যমান অনুচ্ছেদ ৭(২) অনুযায়ী, জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে। সুতরাং অসামঞ্জস্য বিধান সংবিধান বাতিল করার এখতিয়ার দিয়েছে সুপ্রীম কোর্টকে।
গত কয়েকদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সামগ্রিক চিন্তা ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, অনুচ্ছেদ ১০৬ এবং ড. ইউনুসের সরকারের বৈধতা নিয়ে। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে বৈধতার প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছেন সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির। জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের বৈঠকে তিনি সংবিধান ও সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন।
আরও পড়ুন : প্রধান বিচারপতির রোডম্যাপ ঘোষণার একবছর: বাস্তবায়ন শতভাগের কাছাকাছি
প্রকৃত অর্থে বিদ্যমান সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিধান নেই। ড. ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ নতুন ধারণা। কেননা, ইতোপূর্বে ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতন হয়েছিল কিন্তু তিনি একজনের নিকট সরাসরি সেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করেছিলেন। ফলে ৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল।
০৫ আগস্ট ২৪ এ শেখ হাসিনা কারো কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি কিংবা জনসম্মুখে তার কোন পদত্যাগ হয়নি। তিনি পালিয়ে গিয়েছেন, ফলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল। সবচেয়ে ভালো হতো, যদি বিদ্যমান সংবিধানকে বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা। ৭২ এর সংবিধানের যেগুলো প্রাসঙ্গিক সেগুলো বহাল রেখে জনগণের বাস্তবতা এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন বিধান সংযোজন করে একটা কার্যকরী সংবিধান প্রণয়ন করা ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু সেটি আর হয়ে উঠেনি। ফলে আধা গণঅভ্যুত্থান, আধা বিপ্লব নিয়ে একটা জগাখিচুরির সংমিশ্রণ হওয়ায় পতিত স্বৈরশাসকের আনাগোনা বেড়ে চলেছে।
অনুচ্ছেদ ১০৬ এর ক্ষমতা প্রয়োগ একেবারেই সীমিত। রাষ্ট্রপতি চাইলে তখন এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে সুপ্রীম কোর্ট। স্বাধীনতার ৫৫ বছরে এই পর্যন্ত তিনবার ১০৬ এর ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়েছিল। প্রথম দুইবার বিদ্যমান আইনের প্রশ্ন জড়িত ছিল, ফলে রাষ্ট্রপতি সুপ্রীম কোর্টের মতামত নিয়েছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালের ০৮ আগস্ট গঠিত সরকারের জন্য বিদ্যমান কোন আইন ছিল না, ফলে এটি একেবারেই নতুন ধারণা। ফলে, এই বিষয় নিয়ে নতুন আলোচনা হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার টেবিলে।
‘সুপ্রিম উইল অব দ্য পিপল’—জনগণের সর্বোচ্চ ইচ্ছা হলো সংবিধানের সর্বোচ্চ ক্ষমতা। জনগণের ইচ্ছা ছিল বলেই ০৫ আগস্ট হয়েছিল। আর এই গণঅভ্যুত্থানই জন্ম দিয়েছিল নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
লেখক : মোঃ ওবাইদুল্যাহ আল মামুন সাকিব; রাজনীতি বিশ্লেষক এবং অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট