উচ্চ আদালতের ঐতিহাসিক রায়: নিরাপদ সুপেয় পানি এখন নাগরিকের মৌলিক অধিকার
ফাইজুল ইসলাম

বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার: আইনের চূড়ান্ত অপব্যবহার ও মানবাধিকার রক্ষায় আমাদের দায়

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি আমাদের সংবিধানেই নিহিত। কিন্তু বাস্তবতা হলো—বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার আজো নাগরিক স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা কিংবা বিশেষ ক্ষমতা আইন রাষ্ট্রকে যে ক্ষমতা দিয়েছে তা মানবাধিকারকে উপহাস করার জন্য যথেষ্ট। In International human rights arbitrary arrests and detention is absolutely prohibited but no one takes the initiative to reform the laws against humanity.

আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বনাম নগ্ন বাস্তবতা

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে—রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদে প্রদত্ত নীতিমালা অনুসরণ করবে অক্ষরে অক্ষরে । সেই প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সনদে অনুস্বাক্ষর বা Ratification করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার আর বাস্তব চিত্রের মধ্যে রয়েছে স্পষ্ট গড়মিল। কোন আন্তর্জাতিক কনভেনশনই পুরোপুরি মানা হচ্ছে না।

১. সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (UDHR, 1948)

এই ঘোষণার অনুচ্ছেদ ৯ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “No one shall be subjected to arbitrary arrest, detention or exile.” অর্থাৎ, কাউকে স্বেচ্ছাচারীভাবে গ্রেফতার  করা যাবে না। এটি যদিও আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক নয় অর্থাৎ রাষ্ট্র মানতে বাধ্য নয় তবে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের মৌলিক মানদণ্ড হিসেবে তা বাংলাদেশ মানতে বাধ্য।

কেননা এই অধিকার পৃথিবীর অন্যতম JUS Cogens or general principles of laws. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিদিনের খবরের কাগজে যেভাবে বিনা পরোয়ানায় রাজনৈতিক কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষ গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা উঠে আসে তা এই নীতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।বাংলাদেশের উচিত এই আইনগুলোকে যথাযথ সংশোধন করে আইনকে জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা।

২. আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ (ICCPR, 1966)

বাংলাদেশ ২০০০ সালে এই সনদে অনুস্বাক্ষর বা Signature  করেছে। এর অনুচ্ছেদ ৯(১) বলছে, “Everyone has the right to liberty and security of person. No one shall be subjected to arbitrary arrest or detention.” অনুচ্ছেদ ৯(৩) অনুযায়ী কাউকে গ্রেফতারের পর দ্রুত একজন বিচারকের সামনে হাজির করা বাধ্যতামূলক।

কিন্তু বাস্তব চিত্রে দেখা যায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা  ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে প্রাথমিক অভিযোগ ছাড়াই আটক রাখা হয় কখনো কখনো মাসের পর মাস আদালতের সামনে হাজির করা হয় না। এভাবে ICCPR-এর মৌলিক নীতিই উপেক্ষিত হয়।অথচ যে সনদই হয়েছিল For the wellbeing of the people’s civil and political rights amidst the conflict of class civilization.

৩. নির্যাতনবিরোধী সনদ (CAT, 1984)

বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে CAT অনুমোদন বা Ratification করেছে। এই সনদে বলা হয়েছে, আটক অবস্থায় কোনো প্রকার শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবতা হলো—মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় আটক ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতন প্রায় নিয়মিত একটি ঘটনা। বিগত সরকারের সময় সাংবাদিক শহীদুলকে বিনা পরোয়াবায় গ্রেফতারসহ প্রমুখ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গকে গ্রেফতারের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি ভয়াল রাজনৈতিক ব্যবস্থার শুরু হয়েছিল অর্থাৎ CAT-এর প্রতিশ্রুতি কাগুজে রয়ে গেছে।

৪. শিশু অধিকার সনদ (CRC, 1989)

CRC-এর অনুচ্ছেদ ৩৭ বলছে শিশুকে আটক করা হবে কেবলমাত্র ‘last resort’ হিসেবে এবং তা হবে স্বল্প সময়ের জন্য। আমরা বিগত কোটা আন্দোলনের সময় দ্দেখেছি ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের একজন ছাত্রকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে তোলা হয়েছিল যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি হতাশাজনক নজির।অথচ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় দেখা যায় রাজনৈতিক কর্মসূচির সময় অপ্রাপ্তবয়স্কদেরও বিনা পরোয়ানায় আটক করা হয় যা এই সনদের সরাসরি লঙ্ঘন।যখন শিশুইই আইনের আওতায় নিরাপদ নয় তখন আমাদের সে আইন প্রণয়ন নিয়ে ভাবতে হবে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা

এসব আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের শিকার হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রায়শই “সন্দেহভাজন” বা *“রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের আশঙ্কা”*র অজুহাতে এদের গ্রেফতার করে থাকে বিনা কারণে । আদালত যেমন BLAST মামলায় এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছে বাস্তবে তার পূর্ণ প্রয়োগ বাংলাদেশ কখনো দেখেনি।অন্তর্বতীকালীন সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে এই আইনগুলো বন্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে ঘৃণ্য এই গ্রেফতার আজীবনের জন্য বন্ধ হোক।ফলে প্রশ্ন থেকেই যায়—আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলাদেশ কেন বাস্তবে নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না সেখানে জুজুর ভয়টি কোথায়? উত্তর হলো—রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এই আইন এখনো সংস্কার হয় নি।

আদালতের অবস্থান

বাংলাদেশের উচ্চ আদালত বারবার এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছে।

BLAST v. Bangladesh (2003) মামলায় মহামান্য  হাইকোর্ট বলেন, ৫৪ ধারার অপব্যবহার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন।তবে এখন পর্যন্ত আমরা কোন কার্যকর ব্যবস্থাপনা দেখতে পাইনি

Aruna Sen মামলায় (1970) সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটককে নাগরিক স্বাধীনতার পরিপন্থী ঘোষণা করে এবং তা ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্বের বহি:প্রকাশ।তবুও বাস্তবে এ ধরনের রায় প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব স্পষ্ট।In practice the government should interfere to intervene these malpractices otherwise the mere declaration from the court can’t bind law enforcing agencies to misinterpret section 54 of CRPC,1898.

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মানবাধিকারের সুরক্ষায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার ইস্যুটি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় আছে নানাভাবে। এর বিরুদ্ধে আদালত ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বারবার নীতিগত অবস্থান নিয়েছে।কিন্ত সেখানেও রয়েছে সান্ত্বনা  Brogan v. United Kingdom (ECHR, 1988) মামলায় ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে নজির স্থাপন করেছেন কাউকে ৪ দিনের বেশি বিনা পরোয়ানায় আটক রাখা সুস্পষ্ট  মানবাধিকার লঙ্ঘন।

আদালত বলেন, “দ্রুত বিচারকের সামনে হাজির করার বাধ্যবাধকতা” কেবল আনুষ্ঠানিক বিষয় নয় কাগজে কলমে বরং এটি নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার মূলভিত্তি ও আইনি অধিকার । A v. Australia (UNHRC, 1997) মামলায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিটি রায় দেয় যে  দীর্ঘদিন ধরে একজন শরণার্থীকে বিনা বিচারিক পর্যালোচনায় আটক রাখা ছিল ICCPR-এর অনুচ্ছেদ ৯-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন যেখানে বলা হয়েছে No arbitrary arrest and detention. But we have seen in Bangladesh most of the political figures used to arrested by the law enforcing agencies with affiliation of government.

এখানে ‘স্বেচ্ছাচারী আটক’ বলতে শুধু বেআইনি আটক নয় বরং অযৌক্তিক ও অনুপাতহীন আটককেও বোঝানো হয়েছে যার আদতে কোন ভিত্তি নাই। Preventive Detention Cases)–এ ভারতের সুপ্রিম কোর্টও বলেছে প্রতিরোধমূলক আটক (Preventive Detention) সংবিধানে থাকলেও এর ব্যবহার অবশ্যই ব্যতিক্রমী হতে হবে বরং তা  নিয়মতান্ত্রিক ন।

উল্লেখ্য লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপটে Velásquez Rodríguez v. Honduras (IACHR, 1988) মামলায় আন্তঃআমেরিকান মানবাধিকার আদালত রায় দিয়েছেন অবৈধ ও গোপন আটক কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়  বরং এটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের অংশ এবং প্রকাশ্য মানবাধিকারের প্রতি বুড়ো আংগুল দেখায়।

এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা এশিয়া—যেখানেই হোক না কেন  বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারকে আদালতগুলো স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে দেখেছেন দীর্ঘদিন ধরে। বিশ্বব্যাপী অভিন্ন বার্তা হলো—রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে নাগরিক স্বাধীনতা খর্ব করা চলবে না।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার

এখন প্রশ্ন উঠতে বাধ্য—বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার আসলে কাদের নিরাপত্তা রক্ষা করছে আদতে?

নাগরিকের নিরাপত্তা নাকি রাষ্ট্রের ক্ষমতাশালী মহলের সুবিধা?

প্রকৃতপক্ষে নাগরিক নিরাপত্তা বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় না। বরং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠী এটি ব্যবহার করে বিরোধী মত দমনে সুস্পষ্টভাবে। আইনের শাসন নাকি রাজনৈতিক প্রতিশোধ হিসেবে তা কাজ করে ? যখন কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ অভিযোগ ছাড়াই নাগরিককে আটক করে, নির্বিচারে আটক করে তখন তা আইনের শাসনের চেয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অস্ত্রে পরিণত হয় যা আমরা বিগত সরকারের সময়ও দেখে এসেছি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, নির্বাচনকালীন সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বড় অংশকেই বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা হয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে। একইভাবে আন্দোলন,প্রতিবাদ ও  সভা-সমাবেশ বা সাংবাদিকদের প্রতিবেদন ঠেকাতেও এই ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়। এর ফলে আইনের শাসনের বদলে ভয়ের সংস্কৃতি ও দমনমূলক সংস্কৃতি তৈরি হয়।

এই ধারা অব্যাহত থাকলে তিনটি গুরুতর সংকট তৈরি হয়—

১. বিচারহীন আটক: আদালতের ভূমিকা খর্ব হয় এবং বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা অনেক  কমে যায়।মানুষ আস্থা হারায় প্রচলিত বিচারব্যবস্থায়
২. নির্যাতন ও ভয়: আটককৃত ব্যক্তিরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন সামাজিকভাবে। এতে ভয়ভীতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে এবং দেশে মাফিয়া তন্ত্র কায়েম হয়।
৩. রাষ্ট্রের নৈতিক বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়: একটি রাষ্ট্রের বৈধতা কেবল ক্ষমতার (Sovereign Command) ওপর নয় যেটাকে Jurisprudence এর ভাষায় আমরা Analytical School of jurisprudence বলি যেখানে বলা হয় আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের একমাত্র অধিকার সরকারের।তাই সরকার মানবাধিকারবিরোধী এই আইনের সমর্থন করলে যেকোনো সরকারের স্বৈরাচার এর তাকমা পেতে সময় লাগবে না।

করণীয়

প্রথমত, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সংস্কার করতে হবে। In the mandate of international mechanism three bodies i.e. executive, legislative and judiciary will work together to reduce the misuse of section 54 of the CRPC. Even one alliance of the government never handle the burden of the misuse and in practice our authority can initiate narrow interpretation of the word suspect under the codified legislation.

দ্বিতীয়ত, আদালতের নির্দেশনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।Without implementing proper methods the misuse never stop rather day by day people will suffer a lot according to the provision of law. And our government can provide a Supervisory committee for reducing the hesitation of people randomly, only for the suspension to arrest a person is ultimately injustice to the people. Moreover during arbitrary arrest and detention the principle of natural Justice named Audi Ultram Partem is absolutely absent.

তৃতীয়ত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে এবং গ্রেফতারের যথাযথ কারণ দর্শাতে হবে।রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জরুরি কার্যকরভাবে কিন্তু তার চেয়ে বড় হলো নাগরিকের স্বাধীনতা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার শুধু মানবাধিকার নয় বরং আইনের শাসনকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। এখন সময় এসেছে রাষ্ট্রকে পরিষ্কার বার্তা দেওয়ার—ক্ষমতার নামে স্বাধীনতা খর্ব নয় আইনের অপব্যবহার করে বরং মানবাধিকারের পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে হবে।Every human being has the right to not be treated inhumanly and arrested without warrant . As a policy maker, the government takes the measures for applying a free fair procedure at the time of  arrest whether arbitrary arrest  is absolutely prohibited.

লেখক : ফাইজুল ইসলাম; লেকচারার, আইন বিভাগে, প্রাইম ইউনিভার্সিটি এবং এম.ফিল রিসার্চার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।