মতিউর রহমান : আদালত আর শুধু চার দেয়ালের ভেতরে সীমাবদ্ধ নয়, ডিজিটাল প্রযুক্তি আজ আদালত কাঠামোকেও নিয়ে গেছে এক নতুন পর্যায়ে। অডিও-ভিডিও কনফারেন্সে শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ সবই হতে পারে আইনসম্মতভাবে। তথ্য-প্রযুক্তির সর্বত্র ব্যবহার ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে আদালতেও এর ব্যবহার আবশ্যক হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী করোনার ভয়াবহতায় সব কিছু বন্ধ হয়ে গেলে আদালতে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ায় ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার আইন,২০২০’ প্রণয়ন করা হয়।
উক্ত আইনের প্রস্তাবনাতে বলা হয়েছে যে,মামলার বিচার, বিচারিক অনুসন্ধান (inquiry), বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি, বা সাক্ষ্যগ্রহণ, বা যুক্তিতর্ক গ্রহণ, বা আদেশ বা রায় প্রদানকালে পক্ষগণের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আদালতকে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা প্রদানের নিমিত্ত বিধান প্রণয়নকল্পে আইনটি প্রণীত। অর্থাৎ আদালতে বিচারাধীন একটি মামলার সকল পর্যায়েই তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার করে মামলা সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত হতে পারবে। অডিও-ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দূরবর্তী স্থান থেকে মামলার পক্ষ, আইনজীবী, সাক্ষী বা অন্য সংশ্লিষ্ট আগ্রহী ব্যক্তি আদালতের কার্যক্রমে অংশ নিতেপারবেন। এইভাবে উপস্থিতি স্বশরীরে উপস্থিতি হিসেবেই গণ্য হবে।
আরও পড়ুন : আদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্য: তত্ত্ব ও ব্যবহারবিধি (পর্ব-১)
উক্ত আইনের ৫ ধারার ক্ষমতাবলে ওই বছরের মে মাসের ১৫নং বিজ্ঞপ্তি মূলে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার প্রাকটিস নির্দেশনা জারি করেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। উক্ত আইন ও প্র্যাকটিস নির্দেশনার আলোকে অডিও-ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুনানী ও সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে ভার্চুয়াল আদালত ধারণা কার্যকর হয়।উক্ত প্রাকটিস নির্দেশনায় ডাক্তার ও ম্যাজিস্ট্রেট সাক্ষীর সাক্ষ্য অডিও-ভিডিও কনফারেন্স পদ্ধতিতে আবশ্যকভাবে গ্রহণ করার নির্দেশনার মাধ্যমে ভার্চুয়াল আদালত পদ্ধতির বিষয়ে আমাদের অভ্যস্ত হতে জোর আরোপ করা হয়েছে।
আদালত কোন পক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে বা নিজ উদ্যোগে ভার্চুয়ালি সাক্ষ্য গ্রহণ ও শুনানির জন্য ব্যবস্থা করতে পারবেন। অডিও-ভিডিও কনফারেন্স সুবিধা শুধু সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রাকটিস নির্দেশনার প্রথমেই বলা হয়েছে সাক্ষ্য গ্রহণ ও শুনানী সহ মামলার যেকোন আবশ্যকরণীয় ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। সুতরাং, অনুসন্ধান, জামিন শুনানি, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার শুনানীসহ মামলার অন্তবর্তীকালীন বিভিন্ন শুনানিতেও এই নির্দেশনা প্রযোজ্য।
ভার্চুয়াল শুনানি ও সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আদালতপ্রান্ত (আদালতের স্থান) ও দূরবর্তী প্রান্ত (অংশগ্রহণকারীর স্থান) হিসেবে গণ্য হবে। আদালত প্রান্ত ও দূরবর্তী প্রান্তে একজন সমন্বয়কারী থাকবেন। আদালত প্রান্তে আদালতের বিচারক নিজেই বা পেশকার বা নির্ধারিত অন্য কেউ সমন্বয়কারী হতে পারবেন। অপরদিকে দূরবর্তী প্রান্তে সমন্বয়কারী হিসেবে কারাগার, হাসপাতাল, দূতাবাস, শিশুউন্নয়ন কেন্দ্র বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন।
আরও পড়ুন : আদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্য: তত্ত্ব ও ব্যবহারবিধি (পর্ব-২)
অন্যান্য স্থানে আদালত কর্তৃক মনোনীত যেকোন ব্যক্তি এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন। উভয় প্রান্তের সমন্বয়কারীরা ভার্চুয়াল শুনানীর পরিবেশ, নিরাপত্তা, নির্ভরযোগ্যতা ও অন্যান্য আনুষংগিক বিষয়াদি নিশ্চিত করবেন। ভার্চুয়াল শুনানী বা সাক্ষ্য গ্রহণের সিদ্ধান্ত হলে আদালত সময় সূচি নির্ধারণ করে সমন্বয়কারীকে জ্ঞাত করবেন এবং নির্ধারিত সময়ের পূর্বে মিটিং লিংক প্রেরণ করবেন। উভয় প্রান্তের সমন্বয়কারী নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে ভার্চুয়াল মিটিং পদ্ধতিতে আদালতে শুনানী ও সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন।
ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে শুধু শুনানীর ব্যবস্থা উক্তভাবে সম্পন্ন হলেও ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে আরোও কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। কোন সাক্ষী ভার্চুয়ালি সাক্ষ্য প্রদানে আগ্রহী হলে কারণ উল্লেখ করে নির্ধারিত তারিখের পূর্বেই আদালতে আবেদন প্রেরণ করতে পারেন। আদালত স্বীয় উদ্যোগেও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আদেশ করতে পারেন।
আরও পড়ুন : আদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্য : কিছু প্রযুক্তিগত বিষয়, যা জানা জরুরি (পর্ব-৩)
সাক্ষ্যগ্রহণের আগে অভিযুক্ত বা সাক্ষীকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে শপথ পাঠ করানো হবে। অনেক সময় সাক্ষীর মেমোরি রিফ্রেশের প্রয়োজন হয়। তাই প্রয়োজনবোধে সংশ্লিষ্ট নথি যথাযথভাবে স্ক্যান করে ইমেইলে অপর প্রান্তে প্রেরণ করা যাবে। সাক্ষী পরীক্ষা শেষ হলে গৃহীত সাক্ষ্যে আদালত প্রান্তে সংশ্লিষ্ট বিচারক এবং পক্ষগণের প্রতিনিধি (যদি থাকে) দ্বারা স্বাক্ষরিত হবে এবং এটির স্ক্যান কপি দূরবর্তী প্রান্তে সমন্বয়কারীর ইমেইলে পাঠাতে হবে। দূরবর্তী প্রান্তের সমন্বয়কারী সেটির প্রিন্ট আউট করে তাতে সাক্ষীর স্বাক্ষর নেবেন এবং নিজে স্বাক্ষর করবেন। এরপর এটির হার্ড কপি পরবর্তী ০৩ (তিন) কার্যদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট আদালত বরাবরে প্রাপ্তি স্বীকারপত্রসহ রেজিস্টার্ড ডাকযোগে প্রেরণ করবেন।
রেকর্ডেড সাক্ষ্যের নথির সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা রক্ষার্থে আদালত প্রান্তে বিচারক ও পক্ষদের প্রতিনিধিদের স্বাক্ষরিত মুল কপি এবং দূরবর্তী প্রান্তের সমন্বয়কারী ও সাক্ষীর স্বাক্ষরিত ডাকযোগে প্রেরিত কপি উভয়টিই মামলার নথিতে সংরক্ষণ করতে হবে।
শুনানিও সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে আদালত আদেশে উল্লেখ করবেন উক্ত কনফারেন্সিংয়ের সময়কাল ও প্ল্যাটফর্মের নাম। শুনানী ও সাক্ষ্য গ্রহণের সময় অপরপ্রান্তের সমন্বয়কারী আদালতের ন্যায় উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করবেন যেখানে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট থাকবে, অননুমোদিত ডিভাইস ব্যবহার হবে না ও সাক্ষী বা পক্ষকে ভীতি প্রদর্শন বা প্ররোচিত করা হবে না।
এইভাবে ভার্চুয়াল শুনানী ও সাক্ষ্য গ্রহণে অংশগ্রহণের নিমিত্ত বেশি আয়োজন বা অবকাঠামোরও প্রয়োজন নাই। যা প্রয়োজন তাহলোঃ কম্পিউটার বা মোবাইল ডিভাইস, ইন্টারনেট ও স্পিকার (ক্ষেত্র বিশেষে) ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ। ভার্চুয়াল আদালতের জন্য কোন প্লাটফর্ম আইনে নির্ধারিত করে দেয়া হয় নি, তাই WhatsApp, zoom, ম্যাসেঞ্জার ইত্যাদি যেকোন সহজলভ্য প্লাটফর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে। যেহেতু, বর্তমানে প্রায় সকলের স্মার্টফোন আছে এবং প্রত্যেকের ফোন নাম্বারেই WhatsApp আছে তাই উক্ত প্লাটফর্ম সহজে ব্যবহারযোগ্য হতে পারে। WhatsApp-তে লিংক ক্রিয়েট করে ভিডিও কনফারেন্সিং করলে একসাথে ৩২ জন যোগদান করতে পারা যায়। নিম্নোক্তভাবেWhatsApp ব্যবহার করে অডিও-ভিডিও কনফারেন্সিং করা যেতে পারে;
আরও পড়ুন : আদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্য (পর্ব-৪); সংগ্রহ, জব্দকরণ ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ধারণা
মোবাইলফোনে WhatsApp অ্যাপ চালু করুন>”Calls” ট্যাবে যান নিচের ডান অংশে নেভিগেশন বার থেকে Calls+ (কলস প্লাস চিহ্ন) অপশনটিতে ক্লিক করুন>New call link তে ক্লিক করুন>স্ক্রিনের উপরের দিকে থাকা Create Call Link অপশনটি নির্বাচন করুন>কল টাইপ নির্বাচন করুন (একটি মেনু আসবে যেখানে আপনাকে কল টাইপ (Call Type) নির্বাচন করতে হবে Video বা শুধু Voice)>লিংকটি তৈরি হয়ে গেলে, লিংক শেয়ার করুন। সেটি WhatsApp মেসেজ, ইমেইল, বা অন্য প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে শেয়ার করতে পারবেন। “Copy Link” দিয়ে লিংক কপি করে শেয়ার করতে পারবেন। বা “Share Link” দিয়ে সরাসরি শেয়ার করতে পারবেন। একই পদ্ধতিতে কম্পিউটারেও WhatsApp এর অ্যাপ/সফটওয়্যার থেকে কনফারেন্সিং করা যায়। উক্ত লিংকে ক্লিক করে পক্ষগণ ও সংশ্লিষ্টরা অডিও-ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দিতে পারবেন।
প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে ভার্চুয়াল আদালত আবশ্যক হয়ে উঠছে।আইনগত কাঠামো মেনে প্রযুক্তি ব্যবহার করলে বিচার প্রক্রিয়ায় শুনানি ও সাক্ষ্যগ্রহণ আরও দ্রুত, স্বচ্ছ ও ব্যয়সাশ্রয়ী হতে পারে। আদালতে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার সংক্রান্ত আইন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, আইনে নির্ধারিত কাঠামো অনুসারে ভার্চুয়াল শুনানি ও সাক্ষ্য গ্রহণের নমুনা আবেদন,নমুনা আদেশ ও সঠিক ভার্চুয়াল আদালত ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন “আদালতে ডিজিটাল সাক্ষ্যঃ তত্ত্ব ও ব্যবহারবিধি” বইটি।
লেখক : মতিউর রহমান, সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।