দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা (ফাইল ছবি)

‘বিচারক শৃঙ্খলাবিধির গেজেটে কোথায় সুপ্রিমেসি নষ্ট হচ্ছে?’

নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেটের কোথায় সুপ্রিম কোর্টের সুপ্রিমেসি নষ্ট হচ্ছে এমন প্রশ্ন তুলে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা বলেছেন, ‘প্রেসে অনেক কিছু যাচ্ছে। গেজেটে আমাদের সুপ্রিমেসি নেই বলা হচ্ছে। উল্টা পাল্টা লেখা হচ্ছে। কোথায় আমাদের সুপ্রিমেসি নষ্ট হচ্ছে?’

আজ বুধবার (৩ জানুয়ারি) ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সরকারের প্রণয়ন করা গেজেট সর্বসম্মতিভাবে গ্রহণকালে এসব কথা বলেন।

এ সময় বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেটের বিভিন্ন বিধি ও উপবিধিতে ‘সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে’ লেখা দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা।

আদালতে গেজেটের ওপর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে গেজেটের ওপর শুনানি করতে বলেন দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি সংক্রান্ত গেজেটের ২, ৩, ৪, ৭, ১১, ১৪, ১৫, ১৮, ২২, ২৩, ২৫ ও ২৯ সহ বেশ কিছু বিধি-উপবিধি পড়ে শোনান। এসব বিধির যেসব জায়গায় ‘সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে’ শব্দটি লেখা, সেসব জায়গার কথা উল্লেখ করে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘প্রেসে অনেক কিছু যাচ্ছে। গেজেটে আমাদের সুপ্রিমেসি নেই বলা হচ্ছে। উল্টা পাল্টা লেখা হচ্ছে। কোথায় আমাদের সুপ্রিমেসি নষ্ট হচ্ছে?’

এ সময় তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, “দেখেছেন প্রত্যেকটি জায়গায় ‘সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে’ কথাটা লেখা আছে। অথচ বাইরে বলছে সব গেলো সব গেলো।”

দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের শুনানি চলাকালে আরও বলেন, “গেজেট সব বিধিতে ‘সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে’ বলা হচ্ছে। আমরা সবাই বসে এটা ঠিক করেছি। সব দিয়ে দিচ্ছি, আমরা কি এতই বোকা! আমরা কি শিক্ষানবীশ? আমরা সবাই সিনিয়র জাজেস।’

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল গেজেটের ওপর তার শুনানি শেষ করেন। পরে আপিল বিভাগ গেজেটটি গ্রহণ করেন এবং এ মামলাটি নিষ্পত্তি করেন।

আদেশের পর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা গণমাধ্যমকে বলেন, আদালত গেজেটটি গ্রহণ করে আদেশ দিয়েছেন। তবে মাজদার হোসেন মামলাটি ম্যান্ডামাস (চলমান) রেখেছেন।

এর আগে ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিচারক শৃঙ্খলা বিধি নিয়ে আদেশের জন্য ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি দিন ধার্য করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) সকালে আদালত এ মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের একদিন সময়ের প্রয়োজন। বিষয়টি বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাখলাম।

তারও আগে ১১ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত গেজেট জারি করা হয়। বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালার গেজেট প্রকাশে সরকারকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ।

তবে তার আগে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। গত ৫ নভেম্বর দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চে গেজেট প্রকাশে রাষ্ট্রপক্ষের করা চার সপ্তাহের সময়ের আবেদনের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছিলেন, আইনমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে বসতে চান।

এর মধ্যে গত ১৬ নভেম্বর রাতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী। ওইদিন বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির হুকুম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এ গেজেট প্রকাশ করবো।

এর আগে গত ২১ নভেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, আমরা আলোচনার মাধ্যমে (আপিল বিভাগের সঙ্গে বৈঠক) যে ড্রাফটি অ্যাগ্রি করেছি তার ফাইনাল ড্রাফট করা হয়েছে এবং গতকাল (২০ নভেম্বর) সেটি সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট থেকে যে মুহূর্তে ফিরে আসবে আমি আইন মন্ত্রণালয় থেকে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়ে দেবো।

এরপর সুপ্রিম কোর্ট থেকে সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

গত ৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষের ৪ সপ্তাহের সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত গেজেট প্রকাশের সময় বাড়ান দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। আর গত ২০ আগস্ট পদত্যাগী প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ শুনানি শেষে ৮ অক্টোবর পর্যন্ত গেজেট প্রকাশের সময় বাড়িয়েছিলেন।

এর আগে ৬ আগস্ট দুই সপ্তাহের সময় দিয়ে আলাপ-আলোচনা করার কথা বলেছিলেন সর্বোচ্চ আদালত।

১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেনের মামলায় (বিচার বিভাগ পৃথককরণ) ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেওয়া হয়। ওই রায়ের ভিত্তিতে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল।

আপিল বিভাগের এ নির্দেশনার পর গত বছরের ৭ মে আইন মন্ত্রণালয় একটি খসড়া শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধি প্রস্তুত করে সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়।

গত বছরের ২৮ আগস্ট শুনানিকালে আপিল বিভাগ খসড়ার বিষয়ে বলেন, শৃঙ্খলা বিধিমালা সংক্রান্ত সরকারের খসড়াটি ছিল ১৯৮৫ সালে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ওআপিল) বিধিমালার হুবহু অনুরূপ। যা মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপন্থী।

এরপর সুপ্রিম কোর্ট একটি খসড়া বিধিমালা করে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠান। গত ১৬ জুলাই তখনকার প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এ সংক্রান্ত গেজেট শিগগিরই প্রস্তুত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন আইনমন্ত্রী।

সুপ্রিমকোর্ট প্রতিনিধি/ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম