প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন

মামলাজটের নেপথ্যে যে চারটি কারণ উল্লেখ করেছেন প্রধান বিচারপতি

১৯৭২ সালে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার পর হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলা ছিল ২০ হাজার ৫৬৭টি। ৪৬ বছরের ব্যবধানে সেখানে মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৪১৫টি। একই সময়ে নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ২৯ লাখ ৩৮ হাজার ৬৪৯টি। সব মিলিয়ে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশের সকল আদালতে ৩৪ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫৩টি মামলা বিচারাধীন। এ ছাড়া মামলার পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতি বছর যে হারে মামলার সংখ্যা বাড়ছে সেই তুলনায় নিষ্পত্তি হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে মামলা জট। তবে মামলা জট হ্রাসে অধস্তন আদালতের বিচারকদের সুপ্রিম কোর্ট হতে নানা নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে সময়ে সময়ে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে খোদ প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন মামলা জটের পেছনে চারটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে :

  • জনসংখ্যা ও মামলার সংখ্যা অনুপাতে বর্তমানে দেশে বিচারক সংখ্যা অপর্যাপ্ত;
  • অবকাঠামোগত সমস্যার ফলে অনেক স্থানে বিচারকদের এজলাস ও খাস কামরা (চেম্বার) শেয়ার করতে হয়। ফলে কর্মঘণ্টার অপচয় হয়;
  • সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আদালতের কর্মঘণ্টার পূর্ণ ব্যবহার না করার প্রবণতা এবং
  • আইনজীবীদের পক্ষ হতে বারবার মামলার শুনানি মুলতবির আবেদন করা। ফলে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও নিষ্পত্তির হার বাড়ছে না।

গত আট বছরে দেশের আদালতসমূহে এক কোটি ১৪ লাখ ১৪ হাজার ৭৬২টি নতুন মামলা দায়ের হয়েছে। এ সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৯১ লাখ ৯২ হাজার ৬৩৪টি মামলা। অনিষ্পন্ন রয়েছে ২২ লাখ ২২ হাজার ১২৮টি মামলা। অর্থাত্ গড়ে প্রতি বছরে প্রায় তিন লাখ মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৮ সাল শেষে দেশের আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল ১৭ লাখ ৭৭ হাজার ৮৯৮টি। ২০০৯ সালে ১০ লাখ ২৭ হাজার ১৩১টি নতুন মামলা দায়ের হয়। অর্থাত্ মোট মামলা দাঁড়ায় ২৮ লাখ ৫ হাজার ২৯টি। এ সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৭ লাখ ৩১ হাজার ৫৪২টি। পরের বছর দায়ের হয় ১২ লাখ ১৭ হাজার ৯২৭টি এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ১১ লাখ ১ হাজার ৫৩৩টি। ২০১২ সালে দায়ের হয় ১৩ লাখ ৫৯ হাজার ৫৮৯টি এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ লাখ ৩২ হাজার ১৮৯টি। পরের বছর ১৫ লাখ ৫ হাজার ১৬৭টি মামলা দায়ের এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ১১ লাখ ১৯ হাজার ২৯৪টি। ২০১৪ সালে ১৬ লাখ ৭ হাজার ২৫৫টি মামলা দায়েরের বিপরীতে ১৩ লাখ ৪ হাজার ৫৪৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। পরের বছর ১৫ লাখ ৪৬ হাজার ৫০২টি মামলা দায়ের এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ১৪ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৬টি। ২০১৬ সালে ১৪ লাখ ৫ হাজার ২টি মামলা দায়ের হয়। আর নিষ্পত্তি হয়েছে ১৩ লাখ ৩৩ হাজার ৫৬৩টি। পরের বছর ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ১৮৯টি মামলা দায়ের হয় এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ১১ লাখ ৪৩ হাজার ২৯৩টি মামলা। বছর শেষে গিয়ে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩ লাখ ৫৪ হাজার ৫ শতে।

প্রসঙ্গত, দেশে কর্মরত বিচারক রয়েছেন ১ হাজার ৬৪৭ জন। এর বিপরীতে মামলা রয়েছে ৩৪ লাখ। অর্থাৎ বাংলাদেশে দশ লাখ লোকের বিপরীতে ১০ জন বিচারক রয়েছেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তিন কোটি মামলার বিপরীতে বিচারক রয়েছেন ২৩ হাজার জন। কিন্তু আমেরিকায় প্রতি দশ লাখে বিচারক রয়েছেন ১০৭ জন, কানাডায় ৭৫ জন, ইংল্যান্ডে ৫১ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৪১ জন এবং ভারতে ১৮ জন।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বলেন, ভারতে একজন বিচারকের বিপরীতে ১ হাজার ৩৫০টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে এবং ওই বিচারক বছরে ৫১৬টি মামলা নিষ্পত্তি করছে। বাংলাদেশে একজন বিচারকের বিপরীতে ২ হাজার ১২৫টি মামলা বিচারাধীন। গত বছরে আমাদের একজন বিচারক বছরে নিষ্পত্তি করছেন ৭০০ মামলা। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে জনসংখ্যার আধিক্যের কারণেই দেশে আদালতগুলোতে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। যদি আইনজীবী ও বিচারকগণ সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন তাহলে মামলা জট হ্রাস করা সম্ভব।

সংসদে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে (২০০৯-২০১৮) নিম্ন আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে এক কোটি ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৬১টি। বিচার বিভাগ আধুনিকায়ন ও গতিশীল করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার যে সব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা বাস্তবায়িত হলে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা সহনীয় পর্যায় নেমে আসবে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে কার্যকর ও দৃশ্যমান উন্নয়ন সাধিত হবে।