ধর্ষণে সহযোগিতায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রথম আসামি সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার (ডানে)

ধর্ষণে সহযোগিতায় সর্বোচ্চ সাজার প্রথম নজির

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জাতীয় পার্টির (জাপা) সাবেক নেতা ও প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে (১২ নম্বর) ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। দেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে ধর্ষণে সহযোগিতায় মৃত্যুদণ্ড সাজার এটাই প্রথম নজির।

আজ মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ রায় দেন।

এর আগে কায়সারের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ৩, ৫, ৬, ৮, ১০, ১২ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আপিল বিভাগ ওই ৭ অভিযোগের মধ্যে ৫, ১২ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড সাজা বহাল রাখেন। ৬, ৮ ও ১০ নম্বর অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়। আর ৩ নম্বর অভিযোগে তাকে খালাস দেন।

তবে ১২ নম্বর অভিযোগে ধর্ষণের অভিযোগে কায়সারের মৃত্যুদণ্ড সর্বসম্মতিক্রমে বহাল রাখেন আপিল আদালত। এ অভিযোগ বলা হয়েছে, সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী আগস্টের মাঝামাঝি কোনও একদিন মাজেদা বেগমকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী তাকে ধর্ষণ করে। এ বিষয়ে মাজেদা বেগম ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যও দিয়েছেন।

রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ধর্ষণের অভিযোগে সহায়তা করায় এই প্রথম একটি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হলো।’

আর আসামিপক্ষের আইনজীবী এসএম শাজাহান বলেন, ‘এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে তা দেখে আমরা রিভিউ আবেদন করবো।’

যা বলেছিল ট্রাইব্যুনাল
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সলের ২৩ ডিসেম্বর সৈয়দ কায়সারের মামলার রায় ঘোষণা করে। ট্রাইব্যুনাল অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের অভিযোগে কোনো যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ ছিল সেটাই প্রথম।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালিকে ‘দমনের অস্ত্র হিসাবে’ ধর্ষণের ব্যবহার এবং সেই পাশবিকতার শিকার নারীদের দুর্দশার কথা বার বার উঠে আসে এই রায়ে।

একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিত আড়াই লাখ বীরাঙ্গনা ও তাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া যুদ্ধশিশুদের ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করে ‘জাতীয় বীর’ হিসাবে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন- তারা আমাদেরই মা, আমাদেরই বোন। আমরা আর চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না।”

বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের প্রাপ্য সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানোর জন্য সরকার দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলেও রায়ে আশা প্রকাশ করা হয়।

ক্ষতিপূরণ স্কিম চালুর পাশাপাশি বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের তালিকা করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এবং যারা ইতোমধ্যে মারা গেছেন, তাদের মরণোত্তর সম্মান জানিয়ে স্বজনদের শোক ও দুর্দশা লাঘবের ব্যবস্থা নিতে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে বলে ট্রাইব্যুনাল।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “সমাজ ও জাতিকে আরো মনে রাখতে হবে যে, বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুরা যুদ্ধে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত, মুক্তিযোদ্ধারা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সমাজ ও জাতির কোনো স্বীকৃতি ছাড়াই এখনো সেই আত্মত্যাগের জন্য মানসিক ক্ষত বয়ে চলেছেন বেঁচে থাকা বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুরা। ধর্ষণের শিকার এসব নারীদেরও মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেওয়া উচিৎ, তাদের অব্যক্ত বেদনাকে আর অবহেলা করা যায় না।”

ট্রাইব্যুনাল বলেন, সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠন বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের সম্মান দেখাতে তাদের দুর্দশা কমানোর জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে আদালত আশা করে।

রায়ে ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, “শুধু ধর্ষণের শিকার নারীদের ক্ষত দূর করার জন্য নয়, বরং আমাদের সমাজ ও জাতির ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্যও এটি করা প্রয়োজন। তাই, তাদের মানসিক-সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য বিস্তৃত ও সুশৃঙ্খল মনোযোগ ও ব্যবস্থার ওপর জোর দিচ্ছি আমরা।”