ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা পেলেন র‍্যাবের আইন কর্মকর্তা
ভ্রাম্যমাণ আদালত

আবার মোবাইল কোর্ট বিতর্ক: রাষ্ট্রের বোধোদয় হবে কবে?

সুসময় ঘোষ:

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট-পরিচালিত মোবাইল কোর্ট নিয়ে যেন বিতর্কের শেষ নেই। কিছু কিছু বিষয়ে প্রশংসিত হলেও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় আলোচনায় আবার হাজির মোবাইল কোর্ট। এবারের ঘটনা –বরিশালের এক আইনজীবীকে মোবাইল কোর্টে  সাজা। অনেকে জেলা প্রশাসন সঠিক ভাবে পরিচালানোর জন্য মোবাইল কোর্টের গুরুত্ব তুলে ধরেন। এ ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন তার আদেশ,নির্দেশ, উপদেশ প্রতিপালন এর জন্য একটি ‘বাহিনী’ রাখতে পারেন; যেখানে একজন সহকারী কমিশনার সেই বাহিনীর প্রধান হয়ে  উক্ত আদেশ মান্য করাতে পারেন। জেলা প্রশাসনের উপর অর্পিত প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে কিছুটা ফোর্সের দরকার আছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।   কিন্তু তা যে একটি ‘আদালতের’ নামে হতে হবে তাঁর কোন প্রয়োজন নেই। কারন আদালত বলতে মানুষ বুঝে – একজন আইনজ্ঞ বিচারক থাকবেন, আইনজীবী থাকবে, কোন ধরনের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রভাব থাকবেনা। যেখানে গেলে সে জামিন, শাস্তি এমন কি খালাসও পেতে পারেন, যেখানে সে নিজের পক্ষের সাক্ষ্য সবুদ উপস্থাপন করতে পারবেন।  কিন্তু মোবাইল কোর্ট নামীয় এই নির্বাহী আদালতে আজ পর্যন্ত শুনিনি কেউ খালাস পেয়েছেন। আমরা দেখি যে – মোবাইল কোর্ট মানেই শাস্তি। একটি কোর্ট  শুধুই শাস্তি দেবার মানসিকতা নিয়ে পরিচালিত হতে পারেনা। মনে রাখতে হবে এটি কোন কমান্ডো অভিযান না, যে মিসন একমপ্লিশ করে আসতে হবে। এখানে ম্যাজিস্ট্রেট এর সম্মুখে ঘটা অপরাধ আমলে নিয়ে বিচার করা হয়। এখানে ফোন করে ডেকে নিয়ে এসে, বাসা থেকে ধরে এনে, আজকে গ্রেপ্তার করে কালকে হাজির করিয়ে শাস্তি দেওয়ার কোন সুযোগতো নেই বরং তা নিজেই একটি অপরাধ ও মোবাইল কোর্ট আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। মোবাইল কোর্টে ২ বছরের বেশি জেল দেবার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা দেখি যে যেসব অপরাধের শাস্তি ২ বছরের ও বেশি সেগুলোকেও আমলে নিয়ে সামান্য পরিমান জরিমানা করে বা গুতি কয়েক মাস জেল দিয়ে নিস্পত্তি করে হচ্ছে। ফলে আসামীরই লাভ হচ্ছে। আইনের প্রতি ভয় আর তার নাই । কিছু দিন আগে দেখলাম ছিনতাই এর মত অপরাধকে এক সেলেব্রেটি ম্যাজিস্ট্রেট ‘চুরি’ হিশেবে সাব্যস্ত করে সামান্য কমাস জেল দিলেন ; অথচ দ্রুত বিচার আইনে উক্ত অপরাধের শাস্তি ৭ বছর জেলের মতন।

মোবাইল কোর্ট এর সমর্থনকারীরা যুক্তি দেখান যে –এখানে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু পুলিশ, র‍্যাব বেষ্টিত একজন শাস্তিদ্যূত ম্যাজিস্ট্রেট এর সামনে একজন অবলা ‘অভিযুক্ত’ এর এক পর্দ কাগজের  কোনায় কাঁপা কাঁপা হাতের স্বাক্ষর বা টিপ সই কতটুক ‘স্বেচ্ছায়’ বা ‘স্বীকারোক্তি’ মূলক তা একজন বিবেকবান মানুষ মাত্রই বুঝেন।

মোবাইল কোর্টের কিছু সমর্থনকারী আরও যুক্তি দেখান যে – মাননীয় প্রধান মন্ত্রী এই কোর্টের প্রশংসা করেছেন। তিনি তা করতেই পারেন। তিনি নির্বাহী বিভাগের প্রধান। কিন্তু অবৈধ মোবাইল কোর্ট, বা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কারো সাথে অন্যায় করা হলে কিংবা স্বয়ং মোবাইল কোর্ট আইনেরই ব্যত্যয় ঘটিয়ে এই কোর্ট পরিচালনা করলে তখনও কি নির্বাহী বিভাগের প্রধান হিশেবে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী উক্ত মোবাইল কোর্ট ড্রাইভ কে সমর্থন করেন কিনা তা জানার খুব আগ্রহ অনেকের।

জুডিসিয়াল সার্ভিস এ নিয়োগ প্রাপ্ত নতুন বিচারকদের কিন্তু ধরেই ম্যাজিস্ট্রেসি তে পদায়ন করা হয়না। কারন হিশেবে বলা হয়— ম্যাজিস্ট্রেসি অনেক ‘গরম’ জায়গা; এখানে ক্ষমতা আছে, পুলিশ আছে। এখানে জ্ঞানের পরিপূর্ণতার পাশাপাশি , প্রজ্ঞা , ধৈর্য ও বিবেকবোধ ও থাকতে হয়। যা একজন সদ্য ভার্সিটি শেষ করা তরুণ বিচারকের মধ্যে গড়ে নাও উঠতে পারে (যদিও ব্যতিক্রম আছে)। তাই তাঁদের আগে সহকারী জজ হিশেবে সিভিল কোর্টে বিচারক হিশেবে পদায়ন করা হয়। তাঁদের মননে একজন সত্যিকারের বিচারকের মানস তৈরি করা হয় তারপর ম্যাজিস্ট্রেসি তে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিশেবে পদায়ন করা হয়। এদের আইনের ডিগ্রি আছে , পুরো একটি আলাদা প্রক্রিয়ায় এদের বাছাই করা হয়। এই জন্য দেশের সচেতন নাগরিক প্রায়ই আওয়াজ তুলেন যে – কিছু মৌলিক পরিবর্তন এনে এই মোবাইল কোর্ট যেন  জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট দের দিয়ে পরিচালনা করা হয়।

কিন্তু এদিকে আমরা যা দেখি- প্রশাসন ক্যাডার এর একজন সহকারী কমিশনার চাকুরীর শুরুতেই একজন ম্যাজিস্ট্রেট এর ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে যান । যা অনেকেই হজম করতে পারেন না। অনেকে বমি করে দেন। অনেকে বেশি খেয়ে ফেলেন। মিডিয়া, পুলিশ বেষ্টিত একজন শাস্তি-উম্মুখ ম্যাজিস্ট্রেট মাঝে মাঝে নিজেকে ‘ত্রাতা’ ‘প্রভু’  ভেবে বসে থাকেন। ফলে এই ভাবনার অতি উৎসাহে কাউকে কানে  ধরিয়ে ছবি তুলেন, কাউকে রাতের আধারে তুলে নিয়ে পেটান, কারো গালে চড় দিয়ে বসেন, কারো চুল কেটে দেন,  এসব  নমুনা আমরা প্রায়ই দেখি। বরিশালে একজন আইনজীবীকে তুচ্ছ একটি ঘটনায় সাত দিনের কারাদণ্ড দেওয়া তারই একটি রিসেন্ট নমুনা।  সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের একজন তাঁর ফেস বুক পোস্টে খুব সুন্দর করে এটির সুন্দর একটি ব্যখ্যা দিয়েছেন।

আমাদের তরুণ আইনজীবীদের এই বিষয়টি বুঝতে হবে যে – এভাবে মোবাইল কোর্টের নামে  একজন আসামীকে তাঁর নিযুক্ত আইনজীবী দিয়ে নিজেকে  ডিফেন্ড করার সুযোগ না দিয়ে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই অভিযোগ আনয়নকারী আবার নিজেই বিচারক সেজে ক্ষমতার অপব্যবহার করে  সাজা দিতে  থাকলে –তারা চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। তারা কোর্ট অফিসার। অন্যদিক থেকে ভাবলে এটি তাদের ক্যারিয়ারের ও বিষয় ; সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং আইনের প্রতি সম্মানের বিষয়। মোবাইল কোর্টের তফসিলে একের পর এক আইন অন্তর্ভুক্ত করার অর্থ হচ্ছে – ঐ আইন উদ্ভুত কোন অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় একজন আসামীর  নিযুক্তিয়  আইনজীবী হিশেবে একজন আইনজীবীর অংশগ্রহণ কে রোধ করে দেয়া। এটা সংবিধানের সুস্পষ্ট ব্যত্যয়। যদি মোবাইল কোর্টের প্রক্রিয়ায় একজন আসামীর তাঁর নিযুক্তিয় আইনজীবীর মাধ্যমে আত্ম পক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতো তাহলে উক্ত বিচার প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ এবং সাংবিধানিক হত এবং আইনজীবীদের বৈধ উপায়ে রুটি রুজির সংস্থান হত।

সচরাচর আইনজীবী সমাজ কে এই প্রশাসনের জনবল দিয়ে  মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সরাসরি বিরোধিতা করতে তেমন দেখা যায়না। কিন্তু শেষ-মেশ তাদেরই একজন আক্রান্ত হলেন। এখন আইনজীবী সমাজ এর প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু তারা কি কখনো ভেবে দেখেছেন মোবাইল কোর্টের তফসিলে একের পর এক আইন অন্তর্ভুক্ত করে তাঁদের প্র্যাকটিসের পথ কীভাবে রোধ করে দেয়া হচ্ছে! এখন পর্যন্ত কোন দেওয়ানী বিষয় মোবাইল কোর্টের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফৌজদারির চেয়ে দেওয়ানী কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু দেওয়ানী তে জেল জরিমানা কম , কাগজ পত্র দেখে অনেক পর্যালোচনা করে রায় দিতে হয়। হয়ত এই কারনে নির্বাহীদের এদিকে আগ্রহ কম; নাহলে তারও একটি কায়দা বের করে  নির্বাহীরা  দেওয়ানী বিষয়েও মোবাইল কোর্ট করত। তবে কিছু থানায় এবং চেয়ারম্যান কার্যালয়ে এখতেয়ার বিহীন সিভিল বিষয় নিস্পত্তি করা হয় যা অন্যায়। এখন পর্যন্ত আইনজীবীরা দেওয়ানী আদালতে তাঁদের মক্কলদের পক্ষে দাড়াতে পারেন। কিন্তু যদি অদুর ভবিষ্যতে এই সব দেওয়ানী বিষয়গুলো ও নির্বাহীরা মোবাইল কোর্ট জাতীয় কিছু দিয়ে এক লহমায় বিচার করা শুরু করে- তাহলে আইনজীবী সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

বিচারিক আদালতে রায় হলে সাথে সাথে রায়ের নকল পেয়ে দণ্ডিত ব্যক্তি আপীল করার সুযোগ পান । কিন্তু আমরা দেখি  মোবাইল কোর্টের অনেক সেলেব্রেটি বিচারক  দণ্ড দেওয়ার পরে ৩ মাস চলে গেলেও রায়ের  নকল দেন না। ফলে দণ্ডিত ব্যক্তি আপীল করতে পারেন না । এটি সুস্পষ্ট অন্যায়, অবিচার, জুলুম।  মোবাইল কোর্ট  আরও সংবিধান বান্ধব করতে হলে এতে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের কোন বিকল্প নাই । আর যদি আমলারা এতে রাজি না হয় তাহলে – বড় জোর যেটা করা যায় – নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইলের কোর্টের মামলায় বিচারক হবেনা ; হবেন প্রসিকিউটর, বিচার করবেন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। তাহলে হয়ত মোবাইল কোর্টের নামে হরহামেশা আমরা যে সকল ক্ষমতার অপব্যবহার এর ঘটনা শুনি তাঁর কিছুটা লাঘব হবে। এখন দেখা যাক রাষ্ট্রের নির্বাহী এবং বিচার বিভাগ বসে মোবাইল কোর্টের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাহীদের যদি জেল জরিমানা জাতীয় কিছু করার জন্য মোবাইল কোর্টের মত কিছু লাগে তাহলে তাকে মোবাইল অপারেশন নাম দেয়া হোক। তাতে ‘কোর্ট’ বা ‘আদালত’  শব্দ বসিয়ে সংবিধান বা বিচার ব্যবস্থার সাথে বিদ্রূপ করার এখতেয়ার নির্বাহী বিভাগের আছে কী? এক দেশে দুই রকম আদালত সিস্টেম  থাকতে পারে কী? প্রশ্ন রইল প্রিয় পাঠক সমাজের কাছে।

 লেখক- সাংবাদিক ও গবেষক; সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।