আইনুল ইসলাম বিশাল

মধ্যরাতে একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীর বাসায় পুলিশের অভিযান ও কিছু প্রশ্ন

আইনুল ইসলাম বিশাল:

শিক্ষানবিশ আইনজীবী জাহিদ হৃদয় আইনজীবীদের নিকট এখন একটি পরিচিত নাম। জাহিদ হৃদয়ের সাথে গত ১৭ই মে রাতে কি হয়েছিলো সেই বিষয়ে আইনাঙ্গনের সকলেই কমবেশি জানেন। তারপরও সংক্ষিপ্তভাবে বলি, ঘটনার শুরু গত ১৭ই মে রাত সাড়ে দশটার পর। পুলিশ জাহিদকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে তার বাড়িতে অভিযান চালায়। তাৎক্ষণিক সে বিষয়টি তার ফেইসবুক আইডিতে শেয়ার করে। পরবর্তীতে একাধিকবার লাইভে এসে পরিস্থিতি কেমন তা জানানোর চেষ্টা করে। পুলিশের সাথে তার কথোপকথন কি হচ্ছিলো তাও সে লাইভের মাধ্যমে জানায়। বিষয়টি তাৎক্ষণিক সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। অনলাইন পত্রিকা থেকে ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত ওয়ালে জাহিদের ফেইসবুক লাইভ এবং পোস্টগুলো শেয়ার হতে থাকে এবং সেগুলো এখনো আছে।

পুলিশ জাহিদের গৃহের সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে ছাদের গেইট ভেঙ্গে গৃহে প্রবেশ করে, এক পর্যায়ে জাহিদদের বাসার বিদ্যুতের লাইন কেটে দেয়। রাতভর এমন কর্মকান্ড চলতে থাকে, কয়েক হাজার ফেইসবুক ব্যবহারকারী কখনো ফেইসবুক লাইভের মাধ্যমে আবার কখনো জাহিদের পোস্টের মাধ্যমে বিষয়গুলো দেখতে পাচ্ছিলো। সব সময় এক টানটান উত্তেজনা, কখনো আতংকে শরীর শিউরে উঠা। অবশেষে ১৮ই মে ভোর ৬.০০ টায় জাহিদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের সময় জাহিদের পরিবারকে পুলিশ কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখাতে পারেনি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগও বলতে পারেনি। গ্রেফতার হওয়ার পর জাহিদের পরিবারের লোকজন গ্রেফতারের কারণ এবং জাহিদের অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য থানায় যায়, তখন জাহিদের পরিবারকে জানানো হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে কিন্তু মামলার কোনো নথিপত্র দেখায়নি বরং তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করে থানা থেকে বিদায় করে।

এরপর আমরা কালেরকন্ঠে একটি সংবাদ প্রকাশ হতে দেখি, সেখানে যা লিখা হয়েছে তার অর্ধেক মিথ্যা বাকি অর্ধেকের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আছে। যেমন, জাহিদ লাইভে এসে পুলিশের জামা খুলে নেওয়ার হুমকি দেওয়া, সারাদেশের শিবির কর্মীদের ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান করা। আদৌতে ফেইসবুক লাইভ বা তার ওয়ালে এমন কোনো কিছুই বলা হয়নি। প্রয়োজনে জাহিদের ফেইসবুকে গিয়ে দেখে আসতে পারেন। এগুলো সব মিথ্যা ও বানোয়াট। আবার পুলিশ শিবির ও জাহিদকে নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছে তাতে শিবিরের সাথে জাহিদের সুস্পষ্টভাবে সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করেনি। যেমন, ২০১৩ – ২০১৪ সালে সাঈদীর জন্য কুতুবদিয়ায় শিবির তান্ডব চালায় এবং তাতে তিনজন নিহত হয়। এই ঘটনার সাথে জাহিদ কিভাবে জড়িত তার ব্যাখ্যা পুলিশ দেয়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযোগ এনে শিবির তকমা দেওয়া হলো কেনো? আর যখন এই শিবির তকমা দেওয়া হলো তখন আরো অনেক প্রশ্নই চলে আসে।

জাহিদের বাবা মাওলানা এই বিষয়টিই কি জাহিদের গায়ে শিবির তকমা লাগাতে সহজ করেছে ? জাহিদ মাদ্রাসার ছাত্র ছিলো, এই বিষয়টিও কি পুলিশের (ভাষ্য অনুযায়ী) জাহিদকে শিবির বানানোর ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে? জাহিদ যে মাদ্রাসায় পড়তো সে মাদ্রাসায় আদৌ শিবির আছে কিনা? যদি থাকে তাহলে ঐ মাদ্রাসার বিরুদ্ধে অতীতে এবং বর্তমানে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? যদি শিবির ঠিকই থেকে থাকে তাহলে এই ব্যর্থতার দায় কি পুলিশের উপরে বর্তায় কিনা?

জাহিদ যদি মাদ্রাসায় পড়াকালীন সময়ে শিবিরের সভাপতি ঠিকই হয়ে থাকে তাহলে ২০১৩-২০১৪ সালে সাঈদীকে নিয়ে যে তান্ডব ঘটানো হয় এবং তাতে তিনজন নিহত হওয়ার পরও জাহিদের নামে থানায় কোনো অভিযোগ এতদিনেও নাই কেনো? ফেইসবুকের বাইরে গিয়ে শিবিরের কর্মী হিসেবে জাহিদ কি কি সরকার বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলো তার কোনো তালিকা পুলিশের নিকট কি আছে? যদি থাকে তাহলে সেগু‌লোর আলোকে মামলা করা হলো না কেনো? একজন সাবেক শিবির সভাপতি ও বর্তমানে সক্রিয় শিবিরকর্মী এবং জঙ্গির বিরুদ্ধে কেনো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বাইরে গিয়ে আর কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত করা গেলো না?

একজন চিহ্নিত শিবির কর্মী কিভাবে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হলো? কিভাবে একজন শিবিরকর্মী সরকারি ত্রাণ কার্যক্রমে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলো? কালেরকন্ঠের সংবাদ অনুযায়ী কুতুবদিয়ায় শতাধিক শিবিরকর্মী সরকারি ত্রাণ কার্যক্রমের স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আছেন, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে সেখানে শিবিরের এতো দাফট এখনো কিভাবে এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ওসির কোনো ভূমিকা আছে কিনা? জাহিদ যে শিবিরের সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে সক্রিয় শিবিরকর্মী পুলিশ এই ব্যাপারে পূর্বে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে তথ্য দিয়েছিলো কিনা? ১৮ তারিখ ভোর ৬.০০ টা বাজে গ্রেফতারের পরও কেনো ১৮ তারিখ জাহিদকে আদালতে হাজির করা হয়নি? নাকি ১৭ তারিখের বিষয়টিকে জায়েজ করার জন্য এই শিবির ট্যাগ দিতে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা রুজু করতে গিয়েই এই বিলম্ব? শিবির ট্যাগ দেওয়ার উদ্দেশ্য আইনজীবীদের থামিয়ে দেওয়ার কৌশল কিনা?শিবির ট্যাগ দিয়ে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট ১৭ তারিখ রাতের সকল কিছু জায়েজ করার কৌশল কিনা তাও বিবেচনা করতে হবে?

সত্য উন্মুক্ত হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। জাহিদ যদি অপরাধী হয়ে থাকে তবে জাহিদের শাস্তি হওয়া উচিত, আর পুলিশ যদি একজন নিরাপদ শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে এবং তাদের কাজের বৈধতার জন্য শিবির সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি রটিয়ে থাকে, তবে তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। অন্যথায় এইদেশে এই ঘটনার পর কোনো আইনজীবীর নিরাপত্তা থাকবে না, শিক্ষানবিশ আইনজীবীর নিরাপত্তা থাকবে না, আইনজীবীদের সন্তানদের নিরাপত্তা থাকবে না, কোনো মাওলানার নিরাপত্তা থাকবে না, কোনো মাওলানার সন্তানের নিরাপত্তা থাকবে না, কোনো মাদ্রাসার ছাত্রের নিরাপত্তা থাকবে না, সবশেষে বলবো কারোরই নিরাপত্তা থাকবে না। ক্ষমতাবান যে কেউ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য শিবির ট্যাগ অস্ত্রটি ব্যবহার করবে।

এই ভয়াবহ ভবিষ্যৎ থেকে একমাত্র আইনজীবীরাই সবাইকে রক্ষা করতে পারে। তাই সত্য প্রকাশ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আইনজীবীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। যদি এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না যায়, তবে হেরে যাবে ন্যায় বিচার, জিতে যাবে ষড়যন্ত্র। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পবিত্র দায়িত্ব আজ আইনজীবীদেরই।

আইনুল ইসলাম বিশাল: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা আইনজীবী সমিতি