সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সহকারী লাইব্রেরিয়ান আসাদ

আসাদের মৃত্যু এবং আমাদের কান্না

মোঃ মোতাহার হোসেন সাজু : 

শুনলেই চমকে যাবে, ছবি দেখে তাকিয়ে থাকবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা এ কোন আসাদ? ৬৯’র গনঅভ্যুত্থান এর বিজয় সূচিত হয়েছিলো শহীদ আসাদ এর জীবন উৎসর্গের মধ্যে দিয়ে, যাকে বাঙ্গালী জাতি সারা জীবন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। ছবির আসাদ সমসাময়িক কালের করোনা মহামারীর থাবায় পরাজিত শহীদ আসাদ।

এই আসাদ রাজশাহী জেলার বাগমারা থানার অন্তর্গত প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা এক মেধাবী তরুন, সর্বশেষ গত ২০ মে’২০ পর্যন্ত যে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন এ সহকারী লাইব্রেরিয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। সরকার যখন প্রথম লকডাউন ঘোষনা করে, ২৫ মার্চ ২য় শ্রেনীতে পড়ুয়া বাচ্চা, স্ত্রীসহ গ্রামের বাড়ীতে চলে যায়। করোনা ভাইরাস মহামারীর প্রচন্ড প্রভাব পড়ায়, অসহায় আইনজীবীদের পাশে দাড়ানোর জন্য, যখন বার এসোসিয়েশন ঋন দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন ঋন বিতরণ এর জন্য বার এসোসিয়েশন এর ডাকে ছোট্টো বাচ্চাকে নানুর কাছে রেখে, স্ত্রীকে নিয়ে গত ০৯মে’২০ সে ঢাকায় চলে আসে। ১০মে থেকে বার এসোসিয়েশন এর ঋন বিতরণ এর কার্যক্রম শুরু করে, ২০ মে শেষ অফিস করে সহকর্মীদের গ্রামের বাড়ীতে যেয়ে ঈদ করবে বলে জানিয়ে যায়। বিধি বাম ঐ রাত্র থেকেই জ্বরসহ কিছু করোনা উপসর্গ দেখা দিলে বাসায় থেকে ডাক্তার এর পরামর্শে ঔষধ সেবন করতে থাকে। ঈদে আর বাড়ী ফেরা হয়না। দিন দিন উপসর্গ বাড়তে থাকায় স্ত্রী সহ সে চিন্তিত হয়ে পড়ে। বারংবার করোনা পরীক্ষার হটলাইনে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হয়।

অবশেষে পরীক্ষার জন্য একটি তারিখ পেয়েছিলো আনোয়ার খান মডার্ণ হাসপাতালে, আজকে সকালে পরিক্ষার কথা ছিলো কিন্তু সকাল ৯.০০টায় জানিয়ে দেয়া হয় মঙ্গলবার ১০.০০টায় যাওয়ার জন্য। এদিকে প্রচন্ড উপসর্গ দেখা দেওয়ায় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল এ পরীক্ষার নিমিত্তে বারের এম্বুল্যান্সে তাঁকে নিয়ে আসলে ঢাকা মেডিকেল এর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষনা করেন( ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাহে রাজেউন)। আজকে আসাদ এর মৃত্য, চট্টগ্রামের আইনজীবী কাশেম এর মৃত্যু চিকিৎসা না পাওয়া এক অবহেলার শিকার এর নাম। এরকম আইনজীবী, বিচার সংশ্লিষ্ট স্টাফরা করোনায় মারা যাচ্ছেন হিসেব আমাদের নেই। করোনায় মারা যাওয়া মানেই সে, মা, বাবা, স্ত্রী সহ পরিবার আত্মীয় স্বজনের কাছে অস্পৃশ্য ব্যক্তি।

করোনা মহামারী এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছে, স্বাভাবিক দাফন পাওয়ার প্রত্যাশায় অনেকে, চিকিৎসা বা পরীক্ষা করতে না পারায় মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে চায়না, তাঁর করোনা উপসর্গ দেখা দিয়েছে। খবর জানলেই তাঁর কাছ থেকে সবাই দুরে চলে যায়, নিজ জীবন বাঁচানোর তাগিদে সে ঘরে চিকিৎসা নেয়। এমৃত্যু আমরা কেউ চাইনা, আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুটুকু চাই। আমার এই মহান পেশায় আসার ইচ্ছেটাই ছিলো অন্তত মারা গেলো বিচারক, আইনজীবীসহ উচ্চ পর্যায়ের লোকজন সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণে জানাযায় এসে শেষ শ্রদ্ধা জানাবে। করোনা সেই সুযোগ কেড়ে নিয়ে গেছে। যখন পত্রিকার পাতায় দেখি করোনার উপসর্গ নেই, বৃদ্ধ মাকে সম্তান এক নজর বহুদুর থেকে দেখতে এসে, দুর থেকে মাকে হাত ঈশারা করে চলে যায়, প্রিয়জনকে দেখতে এসে নীচতলা থেকে ছয়তলার বোনটিকে হাত ঈশারা করে চলে যায়। এর চেয়ে কষ্ট আর কি হতে পারে? কত প্রিয়জন, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব করোনায় না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে এক নজর দেখতেও পারিনা, জানাজাতেও যেতে পারিনা? করোনা আমাদের নির্মম, পাষন্ড বানিয়েছে। মনে মনে বলি, ঐ মৃত স্বজনকে ও আল্লাহকে, আমাদের মাফ করে দিও। জানিনা আর কতদিন অষ্পৃশ্য মৃত্যুর মিছিলে থাকবে গোটা বিশ্ব? প্রসঙ্গ ছেড়ে অনেক কথাই বললাম।

আসাদ তুমি ছিলে আইনজীবীদের মনিকৌঠায়, তুমি বারের অসহায় আইনজীবীদের ঈদের পূর্বে ঋন বিতরণ করে আজ নিষ্পাপ ছোট্ট বাচ্চাকে রেখে চলে গেলে না ফেরার দেশে, আমরা তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। তুমি এই নিষ্পাপ বাচ্চাকে রেখে করোনার কঠিন উপসর্গ নিয়ে ঢাকায় ঈদ করলে, করোনা তোমাকে কোন করুনা করলোনা, নিষ্পাপ বাচ্চার দিকে তাকিয়ে, পরপারে তুমি ভালো থেকো, আমাদের মাফ করে দিও। আল্লাহ যেন তোমাকে শহীদী মর্যাদা দিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করে এবং পরিবারকে এই শোক কাটিয়ে উঠার তওফিক দান করে। তুমিতো করোনা মহামারীর এক অনন্য শহীদ, তোমাকে আমরা ভূলবনা কোনদিন।

পুনশ্চঃ মৃত আসাদুল ইসলাম আসাদ এর লাশ সত্যিই ইহজগতে অস্পৃশ্য হয়ে গেলো। একমাত্র খবর (রাত ৯.১৫মি.) পেলাম আমাদের বারের সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিমেশ দাস এর কাছে, লাশ পৌছেছে বিকাল ৫.০০ টার দিকে কিন্তু এলাকাবাসী আসাদের মা-বাবা, আত্মীয় স্বজন কাউকে লাশের কাছে আসতে দিচ্ছে না। লাশ নামাতেও দিচ্ছে না। এমনকি লাশের সাথে আসাদের স্ত্রী, ড্রাইভার আলাউদ্দিন, বারের স্টাফ পাকির আলী ও রুবেল তাঁদেরকেও নামতে দিচ্ছে না। গরমের সময় আসাদ এর লাশ নিয়ে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি স্বজনরা ও বারের স্টাফরা। এলাকাবাসী প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া কিছুই করতে দিবে না, তাঁরা বলছে করোনার ভাইরাস এর মৃত দেহ এলাকায় দাফন হবে না। লাশ ঢাকায় নিয়ে যাও। লাশ নিয়ে ওরা এখন বাগমারা থানার জারগ্রাম মাঠে অবস্থান করছে। ৪০০/৫০০ এলাকাবাসী ঘিরে রেখেছে।

সর্বশেষ বারের সভাপতি এ. আমিন উদ্দিন, সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল, আমি নিজে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর প্রেসিডিয়াম সদস্য, এড. জাহাঙ্গীর কবির নানক, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জনাব মনিরুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক, রাজশাহী; পুলিশ সুপার, রাজশাহী, টি. এন. ও, বাগমারা থানা, ও.সি, বাগমারা থানা ও বারের সুপারিন্টেন্ডেন্ট নিমেশ দাস এর হস্তক্ষেপ ও সহযোগিতায় সমাধান করার প্রক্রিয়ায় উপনিত হয়েছে বাগমারা থানা পুলিশ প্রশাসন। তাঁরা সংক্রামক রোগ-২০১৮ এবং সরকারী নির্দেশনা মোতাবেক খুব দ্রুততম সময়ে ১০(দশ) জনের উপস্থিতিতে দাফন কার্য সম্পন্ন করবে। টি.এন.ও, বাগমারা থানা নানক ভাইকে জানিয়েছেন আসাদ এর বাবা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ এর সভাপতি। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অচল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে আইনজীবীদের পক্ষ থেকে আমি নিজেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

মোঃ মোতাহার হোসেন সাজু: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল।

তারিখ- ১.৬.২০২০, ঢাকা।