থানা মামলা নিচ্ছে না, আইন কী বলে!
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

হিন্দু বিবাহ রেজিষ্ট্রি না করার ফলাফল ও প্রাসঙ্গিকতা

সিরাজ প্রামাণিক: হিন্দু বিয়ে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে আচার-অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে। সাত পাকে বাঁধা এ বিয়েতে আত্মার সঙ্গে আত্মার, মাংসের সঙ্গে মাংসের এবং অস্থিতে অস্থিতে মিলন ঘটে। কিন্তু নানা ঘটনার অনুসঙ্গ ও প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইনের প্রজ্ঞাপন জারি করে। সারাদেশের প্রায় সকল উপজেলায় একজন করে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধকও রয়েছে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধনের জন্য।

এ আইনের ৩ ধারার ১ উপধারা অনুসারে হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং হিন্দু রীতিনীতি অনুসারে সম্পাদিত বিবাহ সমূহকে আপনি ইচ্ছা করলে নিবন্ধন করতে পারবেন অথবা নিবন্ধন না করতে পারবেন। কেননা এ আইনের ৩ ধারার ২ উপ-ধারায় বলা হয়েছে নিবন্ধন না হলেও উক্ত বিয়ের বৈধতা ক্ষুণ্ণ হবে না। এখানে বিয়ে নিবন্ধনের চাইতেও হিন্দুশাস্ত্র বা হিন্দু রীতিনীতির প্রতি বেশী জোর দেয়া হয়েছে। তবে নিবন্ধন করার সুফল হচ্ছে-

১। বিয়ের পক্ষদ্বয় স্বামী-স্ত্রী বিয়ে অস্বীকার করতে পারে না।
২। স্বামী-স্ত্রী বিদেশে যেতে নিবন্ধটি কাজে লাগে। যেমন: স্বামী বিদেশে আছে, দেশে থাকা স্ত্রীকেও বিদেশে নিতে চান। সেক্ষেত্রে পুরোহিতের কাছ থেকে বিয়ে রেজিষ্ট্রির সনদ সংগ্রহ করে নোটারী পাবলিকের দপ্তরে সাক্ষী উপস্থাপন করে নোটারী পাবলিকের সনদ সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসে উপস্থাপনের মাধ্যমে স্ত্রীর কাংখিত ভিসা পাওয়া সম্ভব।
৩। কোথাও বেড়াতে গিয়ে হোটেল সুবিধা পেতেও বিয়ে রেজিষ্ট্রি কাগজের দরকার হয়।
৪। স্বামী-স্ত্রীর দুজনেরই সরকারী চাকুরী ক্ষেত্রে বদলী জনিত কারণে বিয়ে রেজিষ্ট্রির কাগজ দরকার হয়।
৫। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ব্যাংকের নমিনি করতে কিংবা কারও মৃত্যু অন্তে ব্যাংকের টাকা পয়সা উত্তোলন করতে নমিনির বিয়ে রেজিষ্ট্রির সনদ দরকার হয়।
৬। বিয়ে রেজিষ্ট্রির ফলে পরষ্পর পরষ্পরের প্রতি দায়-দায়িত্ব পালন ও খোরপোষ দেয়া-নেয়া সহজ হয়।
৭। বিয়ের বৈধতার প্রশ্ন সহজেই নিরসন ঘটে এবং
৮। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে বৈধতার প্রশ্ন সহজেই নিরসন হয়।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শাস্ত্রীয়ভাবে বিয়ের পর, বিয়ে যে স্থানে হবে, সেই এলাকার বিয়ে রেজিস্টারের অফিসে গিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। অথবা রীতিনীতির পর বাসী বিয়ের দিনও নিবন্ধককে বিয়ে বাড়িতে ডেকে এনে বিবাহ নিবন্ধন করা যায়। বেশ কিছুদিন পরও স্বামী-স্ত্রীর পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিয়ে নিবন্ধনের জন্য নিবন্ধকের কার্যালয়ে আবেদন করা যায়। তবে হিন্দু বিবাহ নিবন্ধনের জন্য পুরুষের বয়স কমপক্ষে ২১ বছর এবং মেয়ের বয়স ১৮ বছর হতে হবে। অন্য কোন আইনে যাই থাকুক না কেন, ২১ বছরের কম বয়সী কোনো হিন্দু পুরুষ বা ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো হিন্দু মেয়ে বিয়ে করলে তা নিবন্ধনযোগ্য হবে না।

অতএব, আবেদনের সময় বয়স প্রমাণ করে এ-সংক্রান্ত কাগজপত্র সাথে রাখতে হবে। বিবাহ নিবন্ধক কোনো কারণে বিবাহের রেজিষ্ট্রি আবেদন প্রত্যাখ্যান করলে আবেদনকারী প্রত্যাখ্যানের ৩০ দিনের মধ্যে জেলা রেজিস্টারের কাছে আপিল করতে পারবেন। আপিল সম্পর্কে জেলা রেজিস্টারের আদেশ চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। বিধিমালা অনুযায়ী প্রতি বিয়েতে নিবন্ধন ফি লাগবে মাত্র এক হাজার টাকা। এই ফি পরিশোধ করবে বরপক্ষ। বিয়ে-সংক্রান্ত নথির হুবহু নকল পাওয়ার জন্য আলাদা ১০০ টাকা ফি দিতে হবে। কাজেই হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন যেমন নারী অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করছে, তেমনি বিদেশ গমন, ভ্রমণ, সম্পদের হস্তান্তর, দানপত্র তৈরী, আদালতের প্রামাণিক, বৈধপন্থায় তালাক প্রদানে নারীকে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। রোধ হচ্ছে বাল্য বিবাহ।

তবে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে মুসলিমদের বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হিন্দুদের বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়টি এ আইনে অন্তর্ভূক্ত না থাকায় অনেকে নোটারী পাবলিকের মাধ্যমে হিন্দুদের বিবাহ বিচ্ছেদ হচ্ছে। আইনের সংশোধন করে বিবাহ বিচ্ছেদে হিন্দুদের অন্তর্ভূক্ত করার দাবীও অনেক দিনের। এখন মৌখিক চুক্তির কোন ভিত্তি নেই। বিবাহ যেহেতু একটি দেওয়ানি চুক্তির মতোই, সে ক্ষেত্রে সেটিও লিখিত থাকা উচিত এবং সরকারের একটি অথরিটির মাধ্যমে সেটি লিপিবদ্ধ থাকা উচিত।

লেখক: আইনের শিক্ষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com