বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়: ৯৪টি গ্রাউন্ডে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া আপিলের রায়ে বেশ কিছু এখতিয়ার বহির্ভূত, ভুল, অপ্রত্যাশিত ও ভিত্তিহীন পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। এ কারণে রিভিউ আবেদনের মাধ্যমে আপিলের ওই রায় বাতিল চেয়ে ৯৪টি গ্রাউন্ডে নিজেদের যুক্তি উপস্থাপন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।

রবিবার সকালে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষ।

ওই আবেদনের সর্বমোট ৯৪টি গ্রাউন্ডের মধ্যে প্রথম কয়েকটি গ্রাউন্ডে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন এরকম:

ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘Founding Father’s of the country’. এই বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ তাদের রিভিউ আবেদনে যুক্তি দেখিয়ে বলছে, এটা স্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা (বাঙালির) হিসেবে ইতোমধ্যে স্বীকৃত। কিন্তু রায়ে Father  না লিখে Father’s শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যা সংশোধনযোগ্য।

রায়ের একটি অংশে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে,‘আমাদের অবশ্যই আমিত্বের ধারণা থেকে মুক্তি পেতে হবে’। এই অংশে রাষ্ট্রপক্ষ তাদের যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ ভিত্তিহীন ও অপ্রত্যাশিত―যা আমাদের এই মামলার বিবেচ্য বিষয় নয়। এটি সংশোধনযোগ্য।

ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায়ের আরেকটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে,‘১. আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সংসদ এখনও শিশুসুলভ ; ২. এখনও এই দুটি প্রতিষ্ঠান মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি’।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি হলো, এই পর্যবেক্ষণ আদালতের বিচার্য বিষয় নয়।বিচারিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যা সংশোধনযোগ্য।

ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায়ের আরেকটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ক। যদি সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় তবে তা হবে আত্মঘাতী।

এর সুরাহা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আদালতের এই পর্যবেক্ষণ শুধু অবমাননাকরই নয়, বরং ভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্নও বটে! আদালতের বিচারিক এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে এই মন্তব্য করা হয়েছে। রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ অন্য একটি অঙ্গের বিরুদ্ধে এরূপ মন্তব্য করতে পারে না। এটা বিচারিক মন্তব্য নয়, এ মন্তব্য করে আদালত করে ভুল করেছে। যা সংশোধনযোগ্য ও বাতিলযোগ্য।

রাষ্ট্রপক্ষ তাদের রিভিউ আবেদনে আরও যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, এই আদালত (আপিলের রায় প্রদানকারী আদালত) মার্শাল ল’জারির মাধ্যমে প্রণীত কোনও আইনকে (ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে) বৈধ হিসেবে বিবেচনা করেনি। কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান সংক্রান্ত বিষয়টি বৈপরীত্য দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণ (সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ধারণা) করে ভুল করেছে,যা সংশোধনযোগ্য।

রাষ্ট্রপক্ষ তাদের রিভিউ আবেদনে উল্লেখ করেছে, রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মধ্যে শৃঙ্খলা নিশ্চিত ও সরকারের স্থায়ীত্ব নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ আনয়ন করা হয়। জাতীয় রাজনীতি থেকে দুর্নীতি ও অস্থিতিশীলতা অপসারণ করাই ছিল এই অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য। কিন্তু সংবিধানের এই যে উদ্দেশ্য তা বিবেচনা না করে আদালত একটি ভুল করেছে। আদালতের এই ধরনের পর্যবেক্ষণ অপ্রত্যাশিত এবং বাতিলযোগ্য।

রাষ্ট্রপক্ষ তাদের যুক্তি দেখিয়ে রিভিউ আবেদনে বলছেন, মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশটি তৎকালীন রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ দ্বারা গঠিত হয়েছিল। কিন্তু এই আইনকে (মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ) মার্শাল ল’এর অধীনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ কারণে এই অধ্যাদেশটি দেশে আইন (বর্তমানে) হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এই কারণে মার্শাল ল’অধ্যাদেশটি ষোড়শ সংশোধনীর সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। যা আদালত তুলনা করে ভুল করেছে। এটি সংশোধনযোগ্য।

রায়ের আরেক অংশের পর্যবেক্ষণ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের যুক্তি হলো, যদিও ষোড়শ সংশোধনী অনুযায়ী সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান রেখে একটি আইন করার কথা ছিল। কিন্তু সেই আইন এখনও করা হয়নি। অথচ এই আইন করার আগেই রিটটি দায়ের করা হয়েছে। তাই এই রিট অপরিপক্ক। অথচ এই অপরিপক্ক রিটটি আদালত আমলে নিয়ে রায় দিয়েছে। যা সংশোধনযোগ্য।

রিভিউ আবেদনে আরও বলা হয়, মূল সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ কার্যকর রেখে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করার মাধ্যমে সরকার কোনও বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচারণ প্রমাণিত হলে আইন অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংবিধানে সংশোধনী আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু এই আদালত (আপিল বিভাগ) সেই সংশোধনীকে একটি ‘কালারেবল অ্যামেন্ডমেন্ট’ মন্তব্য করে এবং কোনও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না নিয়ে এই সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করার মাধ্যমে ভুল করেছে―যা সংশোধন হওয়া প্রয়োজন।

রাষ্ট্রপক্ষ রায়ের আরেক অংশের বিষয়ে রিভিউয়ে যুক্তি দেখিয়ে উল্লেখ করেছে, মার্শাল ল’এর যাবতীয় কার্যক্রম সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর রায়ের মাধ্যমে মার্জনা করা হয়েছিল। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে তা বিবেচনায় না নিয়ে ভুল করা হয়েছে। এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এ কারণে এটি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

(বাহাউদ্দিন ইমরান/ বাংলা ট্রিবিউন)