ছবি - প্রতীকী

দেড় হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতি

লাগামছাড়া অনিয়ম আর দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ‘বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় ১৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পে। খুবই নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে এগুলো স্থাপনের কাজে। তাই অল্পদিনের মধ্যেই দেবে গেছে বিদ্যালয় ভবন। অনেক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে আবার অনুমোদিত নকশা অনুসরণ করা হয়নি। নির্মাণ ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘন হয়েছে পদে পদে।

অনিয়ম ও দুর্নীতির এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে সরকারি তদন্তেই। এ তদন্ত করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ’ (আইএমইডি)। তদন্তের পর আইএমইডি প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে।

প্রকল্পাধীন অনেক স্কুলের ছাদে এরই মধ্যে ধরেছে ফাটল। খসে পড়েছে পলেস্তারা। সামান্য বৃষ্টিতেই ছাদ চুইয়ে পানি পড়ছে শ্রেণিকক্ষের মধ্যে। বাধ্যতামূলক হলেও কোনো কোনো বিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয়নি টিউবওয়েল। টয়লেটে রাখা হয়নি পানির ব্যবস্থা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আইএমইডির প্রতিবেদনের সব তথ্য সঠিক নয়। তাদের প্রতিবেদনের জবাব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নির্মাণকাজে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ডিপিইকে (প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর) বলা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘৩৯টি স্কুলের নির্মাণকাজ এখনও শেষ হয়নি। ব্যয় বাড়ানো ছাড়াই জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে জুনের মধ্যে টিউবওয়েল বসানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কার্যাদেশ অনুযায়ী কাজ বুঝিয়ে না দিলে ঠিকাদারদের সব টাকা দেওয়া হবে না।’

গত নভেম্বরে আইএমইডি কর্মকর্তারা এক হাজার ৫০০ বিদ্যালয়ের মধ্যে র‌্যানডম সিলেকশনের মাধ্যমে বান্দরবান জেলার সদর ও রোয়াংছড়ি উপজেলার তিনটি স্কুল সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এ সময়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) কর্মকর্তারাও সেখানে হাজির ছিলেন। স্কুল তিনটি হলো- তুলাছড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড়ইতলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রামারীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরপত্রের শর্তভুক্ত হলেও তিনটি স্কুলে কোনো টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়নি। টয়লেট নির্মাণ করলেও পানির ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে ২০১৬ সাল থেকে শিক্ষা কার্যক্রম চালু হওয়া এসব স্কুলের শিক্ষার্থীরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্মাণকাজের ত্রুটির কারণে তিনটি স্কুলে ছাদ চুইয়ে ও ভবনের দেয়াল বেয়ে পানি শ্রেণিকক্ষে ঢুকে পড়ে। জানালায় বিট না দেওয়ায় বৃষ্টির পানিতে ভবনের ভেতরের দেয়াল ড্যাম হয়ে গেছে। রামারীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তুলাছড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনের ছাদের ব্রিকওয়াল ও আরসিসির বিভিন্ন অংশে ফাটল ধরেছে। তিনটি স্কুলের ভবন নির্মাণের সময়ে কিউরিং কম হওয়ায় মেঝে ও দেয়ালের আস্তরণ উঠে গেছে। কার্যাদেশের ডিজাইন পরিবর্তন করে বড়ইতলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে। স্কুলের ছাদের কংক্রিট নষ্ট হয়ে গেছে। চারতলা ভিতের ওপর একতলা ছাদেরই এ অবস্থা হওয়ায় ভবিষ্যতে নতুন তলা নির্মাণে সমস্যা হবে।

প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, বড়ইতলিপাড়া স্কুলটি ২০১৩ সালে চালু করা হয়েছে। স্কুলটিতে ১৪ ছাত্র ও ১৭ ছাত্রী পড়াশোনা করছে। চারতলা ভিতের ওপর একতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থী কম হওয়ায় ভবিষ্যতেও এ ভবনের তলা বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। দুর্গম এলাকায় এ ধরনের স্কুলের চারতলা ভিত দেওয়া নিয়ে প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অর্থ সাশ্রয় করতে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্প তৈরির ক্ষেত্রে এলাকার চাহিদা, সম্ভাব্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা জরিপ করে প্রকল্প তৈরি ও গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ভবন নির্মাণ ছাড়াও প্রকল্পের স্কুলগুলোতে মেশিনারি সরবরাহ, আসবাব কেনা, সোলার প্যানেল, ভূমি অধিগ্রহণ ও জমি ভরাটে অনিয়ম হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। এর আগেও আইএমইডি একাধিকবার প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন দিলেও ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়।

বড়ইতলিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কলি দাস গণমাধ্যমকে বলেন, স্কুল চালুর কিছুদিন পরেই ভবনে ফাটল ধরেছে। বর্ষার সময়ে ছাদ থেকে পানি পড়ে। পানিতে অফিসরুমে রাখা সব কাগজ নষ্ট হয়ে যায়। আমরা এক কোণে জড়ো হয়ে বসে থাকি। তিনি বলেন, বেশি বৃষ্টি হলে ক্লাস না নিয়েই স্কুল ছুটি দিয়ে দিতে হয়। এতে দুর্গম এলাকায় স্কুল চালুর আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।

এদিকে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার এক বছর না পেরোতেই গত জুলাইয়ে হেলে পড়ছে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার রাজাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বর্তমানে ভবনটিতে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নিচু এলাকার মাটি ভরাট করে পাইলিং ছাড়াই এ ভবন নির্মাণ করা হয়। আরও অনেক স্কুলের ভবন নির্মাণে এ রকম অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

ডিপিই সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের প্রায় দুই হাজার ১০০ গ্রামে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। পাহাড়, হাওর, চর ও উপকূলীয় এলাকায় স্কুলবিহীন গ্রামের সংখ্যা বেশি। চার থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যেও স্কুল নেই, এমন এলাকাও রয়েছে। এসব দুর্গম এলাকার শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ সব শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে প্রাথমিক স্কুল নির্মাণের নির্দেশনা রয়েছে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকার বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ২০১০ সালের জুনে ‘বিদ্যালয়বিহীন ১৫০০ গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৯০৫ কোটি ৭৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। ডিপিইর তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে এলজিইডি। ২০১৬ সালে প্রকল্পের প্রথম মেয়াদ শেষ হয়। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এ পর্যন্ত প্রকল্পাধীন এক হাজার ৪৫২টি স্কুলের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নির্মিত স্কুলে প্রেষণে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে অনেক স্কুল চালু করা হয়েছে। তবে নির্মাণকাজে অনিয়মের কারণে নির্মিত এসব ভবনে ক্লাস করা যাচ্ছে না বলে শিক্ষকরা অভিযোগ করছেন। সূত্র : সমকাল