শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) মো. মোতালেব হোসেন

শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা বেতন তোলেন ১৩ হাজার, চলেন প্রাইভেট কারে

দুর্নীতির দায়ে আটক শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) মো. মোতালেব হোসেন প্রতিমাসে বেতন তুলতে পারেন মাত্র ১৩ হাজার ৮৮ টাকা। অথচ রাজধানীর পশ্চিম ধানমন্ডিতে মোহাম্মদপুরের বসিলা ব্রিজের কাছে তৈরি করছেন বাড়ি, যার ব্যয় কমপক্ষে সাড়ে চার কোটি টাকা। নির্মাণাধীন সেই বাড়ি তিনি মাঝে-মধ্যে দেখতে যেতেন। স্থানীয়রা বলছেন, প্রাইভেট কারে চড়েই সেখানে যেতেন মোতালেব হোসেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের প্রশাসন শাখা ও সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্টেনো-টাইপিস্ট হিসেবে যোগ দেন মো. মোতালেব হোসেন। এরপর স্টেনোগ্রাফার পদে পদোন্নতি পান তিনি। দ্বিতীয়বার পদোন্নতি পান শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে। এই পদটি ১৯৯৭ সালে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে আপগ্রেড করে সরকার, পদটির বেতন হয় দশম গ্রেডে। দ্বিতীয়বার পদোন্নতির পর থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী সবগুলো টাইমস্কেল পেয়েছেন মোতালেব, পেয়েছেন সিলেকশন গ্রেডও। ধাপে ধাপে বেতন বেড়েছে তার ১৮ বছরের চাকরি জীবনে। মন্ত্রীর পিও হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে।

মন্ত্রণালয়ের হিসাব শাখা থেকে জানা গেছে, বর্তমানে মো. মোতালেব হোসেনের মূল বেতন ২৮ হাজার ১০০ টাকা। চিকিৎসা ও সন্তানদের লেখাপড়া বাবদ ভাতা ও অন্যান্য ভাতাসহ তার মোট বেতন ৩০ হাজার ৬০০ টাকা। এর মধ্যে ঋণের ছয় লাখ টাকা বাবদ প্রতিমাসে পরিশোধ করেন ১২ হাজার টাকা। সরকারি বাসায় থাকার কারণে বাড়িভাড়ার ভাতাও পান না। প্রতিমাসে তিনি নিট বেতন তোলেন ১৩ হাজার ৮৮ টাকা। অথচ এই বেতন পেয়েও রাজধানীতে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি তৈরি করছেন তিনি।

সোমবার (২২ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর বসিলা ব্রিজের কাছে মোতালেব হোসেনের সাত তলা ফাউন্ডেশন দেওয়া নির্মাণাধীন বাড়িটিতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা জানান, শনিবার (২০ জানুয়ারি) বিকালে তাকে ওই বাড়ির ছাদ থেকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। পরদিন থেকেই বাড়িটির নির্মাণ শ্রমিক ও কেয়ারটেকারসহ কারও দেখা নেই।

নির্মাণাধীন বাড়িটির সামনের চা দোকানি আলাউদ্দিন বলেন, ‘রোববার থেকে আর কাউকেই দেখছি না।’

মোতালেব হোসেনের নির্মাণাধীন বাড়িটির উত্তর পাশের প্লটের মালিক স্থানীয় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আতাউল্লাহ। তিনি জানান, ২০১৪ সালে একই সময় জমি কিনেছেন তারা। তিনি বলেন, ‘মোতালেব হোসেনের বাড়িটি তৈরি করতে এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে আনুমানিক দেড় কোটি টাকা। বাড়ির কাজ শেষ করতে আরও কমপক্ষে এক কোটি টাকা খরচ করতে হবে।’ জায়গার দাম মিলিয়ে বাড়ির পেছনে মোট খরচ কমপক্ষে সাড়ে চার কোটি টাকা বলে জানান তিনি।

আতাউল্লাহ ও স্থানীয়রা জানান, এই এলাকায় এক কাঠা জমির দাম ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। সেই হিসাবে তিন কাঠা জমির দাম ন্যূনতম এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাড়ি নির্মাণের খরচ আড়াই থেকে তিন কোটি টাকা হলে বাড়ির মোট খরচ সাড়ে চার কোটি টাকার কম হবে না।

নির্মাণাধীন বাড়ি দেখতে মোতালেব আসতেন কিনা, জানতে চাইলে অধ্যক্ষ আতাউল্লাহ বলেন, ‘মাঝে মধ্যে তিনি বাড়ির কাজ দেখতে আসতেন। সবসময় তাকে প্রাইভেট কারে চড়েই আসতে দেখেছি।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নির্মাণাধীন এই বাড়ি থেকে শনিবার বিকালে মোতালেব হোসেনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এর আগে, গত বৃহস্পতিবার (১৮ জানুয়ারি) গ্রেফতার হন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) উচ্চমান সহকরী মো. নাসির উদ্দিন। তবে তাদের সহকর্মীরা শিক্ষামন্ত্রীকে জানান, মোতালেব হোসেন ও নাসির উদ্দিনকে অপহরণ করা হয়েছে।

শিক্ষামন্ত্রীকে এই তথ্য অবহিত করার পর রবিবার (২১ জানুয়ারি) বিকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সাজিয়া আফরিনের সই করা একটি চিঠি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব বরাবর। ওই চিঠিতে দুই কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিখোঁজ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

এসব ঘটনার পর সোমবার (২২ জানুয়ারি) দুপুরে শিক্ষামন্ত্রী সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘(কেউ) কোনও অন্যায়, দুর্নীতি বা ঘুষের মধ্যে জড়াবে না— (চাকরিবিধিতে) এরকম তো বলা আছেই। কিন্তু তারা এ ধরনের কাজে জড়িত, এমন রিপোর্ট কেউ আমাদের দেয় নাই।’

শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরেছে বলে এখন তো আমরা শিওর হলাম। নিশ্চয় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। সেটা কোর্টে প্রমাণ হবে, তার শাস্তি হবে। সেই অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ অন্যায়কারী, ঘুষখোর কিংবা দুর্নীতি ও বেআইনি কাজের সঙ্গে জড়িত কাউকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলেও জানান শিক্ষামন্ত্রী। বাংলা ট্রিবিউন