অনবদ্য মানবাধিকার সংগ্রামী আইনজীবী আসমা জাহাঙ্গীর

কে এই আসমা জাহাঙ্গীর? পাঠক আপনার মনে নিশ্চয়ই এ প্রশ্ন দানা বেঁধেছে এতক্ষণে। তাহলে শুরু থেকেই বলা যাক। আমরা না হয় নানা কারণে, নানা চিন্তা মাথায় নিয়ে আসমা জাহাঙ্গীর এবং তাঁর বাবাকে ভুলে গেলাম কিন্তু আমাদের আজকের প্রজন্ম এবং আগামী প্রজন্মের কাছে তো আসমা জাহাঙ্গীরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কারণ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে পরিবারটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত-সম্পৃক্ত। আমাদের সহযোদ্ধাও বটে। একাত্তরের কোন পাকিস্তানী নাগরিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তথা বাঙালীদের মুক্তি সংগ্রামকে জোরালোভাবে সমর্থন করা অবশ্যই বিরল এক সাহসী পদক্ষেপ। আসমা জাহাঙ্গীরের পিতা সেই দুঃসাহসী কাজটিই করেছেন।

আসমা জাহাঙ্গীরের পিতা ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। একাত্তরের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর তাঁর মুক্তির দাবিতে জেনারেল ইয়াহিয়াকে তিনি খোলা চিঠি লেখেন। এ জন্য তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। পাকিস্তানী সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধোচারণ করার ফলে ১৯৬৮-৬৯ সালে তাঁকে গৃহবন্দী রাখা হয়। বাংলাদেশের অনেক চিহ্নিত ব্যক্তি যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পাকি সামরিক বাহিনীর সহচর হিসেবে কাজ করেছেন, সেখানে এক পাকিস্তানী যেভাবে বাংলার নির্যাতিত আক্রান্ত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন তা অবশ্যই বাঙালীর জন্য এক অনন্য কাজ। আর এ জন্যই বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে তাঁকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ প্রদান করে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কাছ থেকে তা গ্রহণ করেছিলেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা আসমা জাহাঙ্গীর।

আসমা জাহাঙ্গীর ছিলেন পাকিস্তানের বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী। পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। ইরানে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশেষ দূত হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন। আসমা জাহাঙ্গীর ছিলেন সাহসী নারী। যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার। পাকিস্তানে নারীদের নিজেদের পছন্দ মতো বিয়ে করার অধিকার ছিল না। আসমার প্রচেষ্টায় তা আজ স্বীকৃত সে দেশে। জনগণের অধিকার আদায়ে তিনি বার বার গ্রেফতার হন। বাংলাদেশের মানুষ বিশেষভাবে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকার কথা এ কারণে যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে বর্বর পাকি সৈন্যরা যেভাবে গণহত্যা চালিয়েছে, বর্বরতার সীমা ছাড়িয়েছে তার জন্য আসমা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ক্ষমা চাওয়ানোর জন্য বার বার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু সেই বর্বর রাষ্ট্রের কর্ণধাররা এখনও সে কাজটি করার মতো সৎ সাহস দেখাতে পারেনি।

আসমা জাহাঙ্গীর শুধু পাকিস্তান আর বাংলাদেশেই পরিচিত মুখ নন, সারা বিশ্বে তিনি মানবাধিকার কর্মী হিসেবে স্বীকৃত এবং নন্দিত। তাঁর মৃত্যুতে সারা বিশ্ব নেতৃবৃন্দই শোকাহত। জাতিসংঘ মহাসচিব এ্যান্তনিও গুতেরেস তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে আসমার মৃত্যুতে গভীর শ্রদ্ধা ভরে নানা মন্তব্য করে। কেউ বলেন তিনি ছিলেন পাকিস্তানের নৈতিক কম্পাস। কেউ বলেন, আসমার মতো একজন নাগরিকের জন্য পাকিস্তান গর্ববোধ করতে পারে। কোন কোন সংবাদপত্র লেখে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের বিবেক। কেউ বা বলেন, পাকিস্তান যত সাহসী সন্তানের জন্ম দিয়েছে আসমা ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী। এই সাহসী নারীর প্রতি আমাদের সন্মান ও শ্রদ্ধাঞ্জলি।

জীবনকথা

আসমা জিলানী জাহাঙ্গীর (জন্ম: ২৭ জানুয়ারি, ১৯৫২ – মৃত্যু: ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮) লাহোরে জন্মগ্রহণকারী পাকিস্তানের বিশিষ্ট মহিলা আইনজীবী ছিলেন। পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। এছাড়াও, সংস্থার মহাসচিব ও পরবর্তীকালে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আসমা জাহাঙ্গীর।

প্রারম্ভিক জীবন
সমৃদ্ধশালী ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার পরিবারে আসমা জাহাঙ্গীরের জন্ম। বাবা মালিক গুলাম জিলানী সরকারী চাকুরীজীবি ছিলেন। অবসর শেষে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন ও বেশ কয়েক বছর কারাভোগ করেন। এছাড়াও, সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ করায় গৃহে অন্তরীণ ছিলেন ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করায় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার ছিলেন।

মা সহ-শিক্ষানুক্রমিক মহাবিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন ও স্বল্পসংখ্যক মুসলিম মহিলা হিসেবে উচ্চতর শিক্ষালাভে সক্ষমতা দেখিয়েছেন। এছাড়াও তিনি প্রাচীন ধ্যান-ধারণার বিপক্ষে তিনি লড়াই করেন। স্বামীর কারাভোগের ফলে ১৯৬৭ সালে নিজস্ব কাপড়ের ব্যবসা পরিচালনা করেন।

আসমা লাহোরের কিন্নাইর্দ কলেজ থেকে স্নাতক ও ১৯৭৮ সালে আইনে স্নাতকধারী হন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রী পান। এছাড়াও, সুইজারল্যান্ডের সেন্ট গালেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রীসহ কানাডার কুইন্স ও কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী লাভ করেন।

কর্মজীবন
পাকিস্তানের মানব এবং মহিলা অধিকার, সংখ্যালঘু ও শিশুদের ধর্মীয় অধিকার নিয়ে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। মৃত্যু পূর্ব-পর্যন্ত তিনি হুদুদ অধ্যাদেশ ও পাকিস্তানে ইসলামীকরণের বিষয়ের অংশ হিসেবে জেনারেল মুহাম্মদ জিয়া-উল-হকের ব্লাসফেমি আইনের কড়া সমালোচক তিনি।

২৭ অক্টোবর, ২০১০ তারিখে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন ও আইনজীবীদের আন্দোলনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি প্রথম মহিলা হিসেবে এ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় মানবাধিকার ফোরামে সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালনসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ফেডারেশনের সহ-সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

আগস্ট, ২০০৪ থেকে জুলাই, ২০১০ পর্যন্ত ধর্মীয় স্বাধীনতা বা বিশ্বাস সম্পর্কীয় জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শ্রীলঙ্কা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তদন্তের জন্য জাতিসংঘের দলে ছিলেন।

অর্জনসমূহ
আসমা বেশকিছু পুরস্কার লাভ করেছেন। তন্মধ্যে, ২০১৪ সালে রাইট লাইভলিহুড অ্যাওয়ার্ড, ২০১০ সালে ফ্রিডম পুরস্কার, হিলাল-ই-ইমতিয়াজ, সিতারা-ই-ইমতিয়াজ, রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে মার্টিন এনালস ও ইউনেস্কো/বিলবাও পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও, ফ্রান্স থেকে অফিসার ডি লা লিজিও ডি’অনার পুরস্কার পেয়েছেন। ১০০০ উইম্যান ফর পিস পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ২০০৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁকে মনোনয়ন দেয়া হয়।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিতা ও এক সন্তান এবং দুই কন্যার জননী ছিলেন। মুনিজাই জাহাঙ্গীর নামীয় কন্যা সাংবাদিক ও সুলেমা জাহাঙ্গীর আইনজীবী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। ‘দ্য হাদুদ অর্ডিন্যান্স: এ ডিভাইন স্যাঙ্কশন’ ও ‘চিলড্রেন অব এ লেজার গড’ শিরোনামে পুস্তক রচনা করেছেন তিনি।