আইনজীবীদের সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও দেশের আইন পেশার সর্বোচ্চ সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাধারণ নির্বাচন আগামী সোমবার (১৪ মে) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এ দিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবন, দেশের জেলা সদরের সকল দেওয়ানি আদালত প্রাঙ্গণ এবং বাজিতপুরসহ দেশের ১২ উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি আদালত অঙ্গনে স্থাপিত কেন্দ্রে এই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
বার কাউন্সিল নির্বাচনে বিজয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে এবার প্রার্থী নির্বাচনের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন সরকার সমর্থক আইনজীবীরা। বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের থেকে অপেক্ষাকৃত সিনিয়র, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং হেভিওয়েট নেতাদের প্রার্থী করা হয়েছে।
ঢাকা বারের গত নির্বাচনে আওয়ামীপন্থীদের প্যানেল থেকে সম্পাদকসহ ১৪টি পদে বিজয়ী হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের নিরঙ্কুশ বিজয় চিন্তার ভাঁজ ফেলে সরকারের শীর্ষ মহলের কপালে। তবে এবার তারা আশা প্রকাশ করছেন, বার কাউন্সিল নির্বাচনে এবার ভিন্ন চিত্র দেখবেন দেশের মানুষ। এ জন্য নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।
আসন্ন নির্বাচনে সাধারণ আসনের প্রার্থী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘এবার আমরা বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী দিয়েছি। আশা করছি, সাধারণ আইনজীবীরা তাদের ভোট দেবেন। এছাড়া সাংগঠনিকভাবে এবার আমরা আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। আশা করছি, এবারের নির্বাচনে আমরা সবার সমর্থন পাব।’
অন্যদিকে, এবারের নির্বাচনে দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা বৃহত্তর বরিশালের কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়নি বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী প্যানেল। সে হিসেবে ওই অঞ্চলে গ্রামের বাড়ি রয়েছে তাদের মধ্যে চারজনকে মনোনয়ন দিয়েছে সরকারদলীয় আইনজীবীরা। একই অবস্থা বৃহত্তর ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও। এ কারণে এবারের ভোটের পাল্লা আওয়ামী লীগের দিকে ভারী বলে ধারণা করছেন সুপ্রিম কোর্ট, ঢাকা বারসহ ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও কুমিল্লা বারের আইনজীবীরা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের পক্ষে যাদের প্রার্থী করা হয়েছে তাদের নাম বললেই সবাই চিনে ফেলছেন কিন্তু বিএনপি-জামায়াতপন্থী প্রার্থীদের নাম আগে কেউ তেমন শোনেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এবারের বার কাউন্সিল নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবী প্যানেল থেকে সিনিয়র কয়েকজন বাদে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের প্রার্থী করা হয়েছে। যদিও এবারের নির্বাচনে প্রার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যেই এক ধরনের শঙ্কা কাজ করছে। এরপরও নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে তারা আশাবাদী।
সাধারণ আসনে আওয়ামীপন্থী প্যানেলের তুলনায় বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবী প্যানেলের প্রার্থীরা অভিজ্ঞতায় কিছুটা পিছিয়ে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ফজলুর রহমান বলেন, উনাদের (আওয়ামীপন্থী) প্যানেলে কয়েকজন সিনিয়র প্রার্থী আছেন। তবে নদীতে যখন জোয়ার আসে তখন হাতিরাও ভেসে যায়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অনেক তরুণ প্রার্থীর কাছে মুসলিম লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীরাও হেরে গিয়েছিল। তাই এখন দেশের রাজনৈতিক যে প্রেক্ষাপট তাতে সরকারের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ ভোটারদের সহানুভূতি আমাদের দিকে থাকবে।
এদিকে, ভোট চাইতে প্রায় মাসব্যাপী সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন উভয় প্যানেলের প্রার্থীরা। সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোতে বিভিন্ন জেলার বার অ্যাসোসিয়েশনগুলোতে নির্বাচনী প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন। সারাদেশে নিজ নিজ দলের আইনজীবীদের পক্ষে প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করেছেন সিনিয়র আইনজীবীরাও। নির্বাচন ঘিরে আইনজীবীদের মধ্যে একটি উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করছে।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের তথ্য মতে, বার কাউন্সিল মূলত ১৫ সদস্যের কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার-১৯৭২’ অনুসারে প্রতি তিন বছরে একবার বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে ১৪ জন সদস্য নির্বাচিত হয়ে বার কাউন্সিল পরিচালনার দায়িত্ব পান। তবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল পদাধিকার বলে বার কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
এ কারণে চেয়ারম্যানের পদ ব্যতীত বাকি ১৪টি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে আইনজীবীদের ভোটে সাধারণ আসনে সাতজন এবং আঞ্চলিকভাবে গ্রুপ আসনে সাতজন আইনজীবী সদস্য নির্বাচিত হন।
আঞ্চলিকভাবে সাতটি গ্রুপ আসনের মধ্যে যেসব আইনজীবী সমিতিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে হয়েছে, সেগুলো হলো—গ্রুপ এ-তে ঢাকা জেলার সব আইনজীবী সমিতি, গ্রুপ বি-তে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর জেলার আইনজীবী সমিতি, গ্রুপ সি-তে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার আইনজীবী সমিতি, গ্রুপ ডি-তে কুমিল্লা জেলা ও সিলেট জেলা অঞ্চলের আইনজীবী সমিতি, গ্রুপ ই-তে খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলের আইনজীবী সমিতি, গ্রুপ এফ-এর মধ্যে রাজশাহী, যশোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের আইনজীবী সমিতি এবং গ্রুপ জি-তে রয়েছে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার আইনজীবী সমিতি।
এবারের নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ৪৩ হাজার ৭১৩ জন আইনজীবী। পরে নির্বাচিত ১৪ সদস্যের মধ্যে থেকে সংখ্যা গরিষ্ঠতার মতামতের ভিত্তিতে একজনকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে যারা আছেন
সাধারণ আসনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত সাতজন প্রার্থী হলেন— বার কাউন্সিলের বর্তমান কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল বাসেত মজুমদার, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুয়ায়ুন, অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান, আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও বার কাউন্সিলের ফাইন্যান্স কিমিটির বর্তমান চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম, বার কাউন্সিলের বর্তমান কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম (জেড আই) খান পান্না, অ্যাডভোকেট পরিমল চন্দ্র গুহ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল।
পাশাপাশি গ্রুপ আসনের সাত প্রার্থী হলেন, গ্রুপ এ: বার কাউন্সিলের বর্তমান কমিটির নির্বাচিত সদস্য ও লিগ্যাল এডুকেশন কমিটির চেয়ারম্যান কাজী নজিবুল্লাহ হিরু, (গ্রুপ- বি) মো.কবির উদ্দিন ভূঁইয়া, (গ্রুপ- সি)ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুল, (গ্রুপ- ডি) এ এফ মো. রুহুল আনাম চৌধুরী, (গ্রুপ- ই) পারভেজ আলম খান, (গ্রুপ- এফ) মো. ইয়াহিয়া এবং (গ্রুপ- জি) রেজাউল করিম মন্টু।
বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে যারা আছেন
সাধারণ আসনের সাত প্রার্থী হলেন— সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এজে মোহাম্মদ আলী, অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার, অ্যাডভোকেট মো. বোরহান উদ্দিন, অ্যাডভোকেট হেলালউদ্দিন মোল্লা, অ্যাডভোকেট মো. আব্বাস উদ্দিন ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আসিফা আশরাফী পাপিয়া।
এছাড়া গ্রুপ আসনে মনোনীতরা হলেন- ঢাকা অঞ্চল থেকে অ্যাডভোকেট মহসিন মিয়া, ময়মনসিংহ-ফরিদপুর অঞ্চল থেকে শ্রী জীবন কুমার গোস্বামী, সিলেট-কুমিল্লা অঞ্চল থেকে এ.টি.এম ফায়েজ, বগুড়া-রংপুর-দিনাজপুর-পাবনা অঞ্চল থেকে শেখ মুখলেসুর রহমান, যশোর-কুষ্টিয়া-রাজশাহী অঞ্চল থেকে মোঃ ইসহাক, খুলনা-বরিশাল-পটুয়াখালী অঞ্চল থেকে এম. আর. ফারুক এবং চট্টগ্রাম-নোয়াখালী অঞ্চল থেকে দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ভোটকেন্দ্রিক আপত্তি নিষ্পত্তিতে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল
নির্বাচনকে ঘিরে আইনজীবী প্রার্থী বা ভোটারদের মধ্যে কোনও আপত্তি দেখা দিলে সে বিষয়ে শুনানির জন্য বিধি অনুসারে তিন সদস্যের একটি ট্রাইব্যুনালও গঠিত হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হলেন বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম। অন্য দুই সদস্য হলেন— বিচারপতি ফরিদ আহমেদ ও সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট মো. ওজি উল্ল্যাহ। এছাড়া নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করবেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।