ধর্ষণের শিকার নারীদের ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক এবং এই টেস্টের রিপোর্ট পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। রাজধানীতে এক গারো তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় হাইকোর্টে রুলের শুনানি শেষে আদালত এই রায় দেন।
আজ রোববার (২৭ মে) সকালে হাইকোর্ট বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে রায়টি প্রকাশ করা হয়।
রায়ে বলা হয়েছে, ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার কোনো নারী বা শিশু যেকোনো থানায় মামলা বা অভিযোগ করতে গেলে তা লিপিবদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীর ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক করে ১৮টি নীতিমালা দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই নীতিমালা নারী এবং শিশু নির্যাতন মামলার তদন্তে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আদালতের নির্দেশনাগুলোয় বলা হয়েছে, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা এ সংক্রান্ত ঘটনায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ লিখিতভাবে রেকর্ড করবেন। এক্ষেত্রে ওই থানার আওতার মধ্যে ঘটনা সংঘটিত হোক বা না হোক, সেটা মুখ্য নয়। অবিলম্বে এমন একটি সার্ভার তৈরি করতে হবে, যেন এ ধরনের অভিযোগ সরাসরি অনলাইনের মাধ্যমে করা যায়। রায়ে আরও বলা হয়েছে, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নমূলক ঘটনায় অভিযোগ পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাধ্যতামূলকভাবে ডিএনএ পরীক্ষা করাতে হবে। একইসঙ্গে এ ধরনের ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএসহ অন্যান্য নমুনা সংগ্রহ করে তা ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া যেকোনও রিপোর্ট সংগ্রহ বা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থার যেকোনও ব্যর্থতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি দ্রুত মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
হাইকার্টের নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে—সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া কোনও পুলিশ অফিসার যদি অভিযোগ গ্রহণে বিলম্ব করেন, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে। প্রত্যেক থানায় কনস্টেবলের নিচে নয়, এমন একজন নারী পুলিশ রাখতে হবে। অভিযোগ পাওয়ার পর ডিউটি অফিসার একজন নারী কর্মকর্তার (দায়িত্বপ্রাপ্ত) মাধ্যমে ও ভুক্তভোগীর পরিবারের সদস্য, শুভাকাঙ্ক্ষী, সমাজকর্মী বা আইনজীবীর উপস্থিতিতে অভিযোগ রেকর্ড করবেন। সবক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর সমস্ত তথ্য সংরক্ষণে গোপনীয়তা রক্ষা করার নির্দেশনাসহ প্রত্যেক থানায় ভুক্তভোগীদের জন্য সহযোগিতাপূর্ণ নারী-সমাজকর্মীদের একটি তালিকা তৈরি রাখার কথা বলা হয়েছে।
ধর্ষণা মামলায় পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়েছে—ভুক্তভোগীর আইনজীবী, সংশ্লিষ্ট বন্ধু, সমাজকর্মী অথবা নিরাপত্তা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে তার অভিযোগ রেকর্ড করতে হবে। অধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের দেওয়া অধিকার সম্পর্কে ভুক্তভোগীকে সচেতন করা জন্য বলা হয়েছে। এছাড়া ভিকটিম চাইলে যেকোনও তাকে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, অভিযোগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে ডিউটি অফিসার ‘ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টার’কে জানাবেন। ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার কোনও নারী বা মেয়ে করণীয় সম্পর্কে বুঝতে অক্ষম হলে, তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে হবে। লিখিত তথ্য গ্রহণের পর কোনও ধরনের বিলম্ব না করে তদন্তকারী কর্মকর্তা ভুক্তভোগীকে একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠাবেন। ভুক্তভোগীর দ্রুত সেরে উঠতে ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে সার্বক্ষণিক প্রয়োজনীয় সুবিধা থাকতে হবে।
আদালতের নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে—নারী ও শিশুদের ওপর সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে ‘১০৯২১’ নাম্বারে ফোন করে যেন প্রতিকার পেতে পারে, সে বিষয়টি প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও ওয়েব সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষা ওপরামর্শ দেওয়ার জন্য প্রত্যেক মহানগরে একটি করে সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। রায়ে আরও বলা হয়েছে, এসব নির্দেশনা দিয়ে আদালত এ বিষয়ে আগে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই নীতিমালা মেনে চলতে হবে।
এছাড়া রায়ের আরেক অংশে এ মামলায় হাইকোর্টের রায়ের সুপারিশ, পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনার আলোকে নীতিমালা তৈরি করতে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ মহাপরিদর্শককে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
২০১৫ সালে রাজধানীর খিলক্ষেতে গারো তরণী ধর্ষণের ২৭ ঘণ্টা পর অভিযোগ গ্রহণ করার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এক রিটের প্রেক্ষিতে এ রায় দেন হাইকোর্ট। সে মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে এসব নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।
এর আগে ধর্ষণ পরীক্ষায় টু ফিঙ্গার টেস্ট অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্টের পৃথক আরেকটি বেঞ্চ।