অসহায়-অসচ্ছল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দিতে বহুল ব্যবহূত জাতীয় ‘টোল ফ্রি হটলাইন’ নম্বর ১৬৪৩০ চালু রাখা নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনি সেবার এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এ পর্যন্ত ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ ওই নম্বর ব্যবহার করে আইনি সহায়তা নিয়েছে, যার মধ্যে শিশু আছে ৬০১টি।
তৃণমূল মানুষের কাছে জনপ্রিয় হতে থাকা হটলাইন নম্বরটি যখন সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ঠিক তখনই নম্বরটির টোল ফ্রি সেবা বন্ধের জন্য জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থাকে (লিগ্যাল এইড) চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
বিটিআরসি বলছে, ‘অধিকাংশ কলই অপ্রয়োজনীয় এবং বিপুলসংখ্যক হওয়ায় তা নেটওয়ার্কের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে। একই সঙ্গে তা অপ্রয়োজনীয় খরচের খাত তৈরি করছে।’ আর এ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে লিগ্যাল এইড ও বিটিআরসি। দেড় মাস ধরে বিষয়টি নিয়ে পাল্টাপাল্টি চিঠি চালাচালি হলেও সংকটের সুরাহা হয়নি এখনও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লিগ্যাল এইডের উপপরিচালক আবেদা সুলতানা গণমাধ্যমকে বলেন, বিনামূল্যে আইনি সেবা দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম টোল ফ্রি হটলাইন নম্বর। এখানে নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করার পর প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের আইনি সহায়তা দেওয়া হয়। আর যাদের ফোনে পূর্ণাঙ্গ সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না, তাদের সংশ্নিষ্ট জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে যোগাযোগের জন্য পরার্মশ দেন হটলাইন কর্মকর্তারা। এরই ধারাবাহিকতায় গত দুই বছরে এই কার্যক্রমে আগের চেয়েও ব্যাপক সফলতা এসেছে। এ অবস্থায় হটলাইন নম্বরটি বন্ধ করা হলে পুরো প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গত ৩১ মে টোল ফ্রি হটলাইন নম্বরকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ উল্লেখ করে লিগ্যাল এইডকে চিঠি দেয় বিটিআরসি। এ বিষয়ে বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের পরিচালক মো. গোলাম রাজ্জাক বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাম্বারিং প্ল্যান অনুযায়ী লিগ্যাল এইডের হটলাইন নম্বরটি টোল ফ্রি রাখার কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া কলের লগ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, অধিকাংশ কলই অপ্রয়োজনীয়। তবে এখন যদি ওই নম্বরটি তারা (লিগ্যাল এইড) ব্যবহার করতে চায়, তাহলে তাদের অবাণিজ্যিক ভিত্তিতে টোল ফ্রি সুবিধা ছাড়াই ব্যবহার করতে হবে।
বিটিআরসির অভিযোগকে ‘মনগড়া’ উল্লেখ করে লিগ্যাল এইডের উপপরিচালক আবেদা সুলতানা বলেন, লাখ লাখ টাকা খরচ করে রেডিও-টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি পথযাত্রা, লিফলেটসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করে টোল ফ্রি নম্বরটি সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষ এখন প্রয়োজন অনুসারে হটলাইন নম্বরে ফোন দেন। তাদের সেবা দেওয়ার জন্যই তো নম্বরটি চালু করা হয়েছে। এখন বিটিআরসি কিসের ভিত্তিতে হটলাইনের কলকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলছে- এটি বোধগম্য নয়। আর নেটওয়ার্কে চাপ তৈরি করছে- এই অভিযোগ আরও হাস্যকর। তাহলে মোবাইল কোম্পানিগুলো চলছে কীভাবে? আমরা বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। আশা করছি, এ নিয়ে জটিলতা কেটে যাবে।
লিগ্যাল এইড সংস্থার তথ্যানুযায়ী, যে কোনো ব্যক্তি হেল্পলাইনের ১৬৪৩০ নম্বরে বিনা খরচে ফোন করে প্রাথমিক আইনি পরামর্শ ও সেবা গ্রহণ করতে পারেন। সরকারি ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পযন্ত এ সেবা দেওয়া হয়। এই সেবা চালু হওয়ার পর থেকে চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ৩০ হাজার ১২৮ জন হেল্পলাইনে ফোন করে আইনি সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে পুরুষ ২০ হাজার ৭০১ ও নারী ৮ হাজার ৮২৬ জন এবং শিশু ৬০১। এ ছাড়া সারাদেশে ৬৪ জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয় থেকে ২০০৯ সাল থেকে গত ৩০ জুন পর্যন্ত আইনগত সহায়তা নেওয়া নারী, পুরুষ ও শিশু সুবিধাভোগীর সংখ্যা দুই লাখ ২৫ হাজার ১২৫ জন।
২০০০ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন পাস হওয়ার পর ২০০১ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে সরকার। কিন্তু জনবল ও বিধির অভাবে প্রায় আট বছর অকার্যকর ছিল সংস্থাটি। ২০০৯ সালে সংস্থাটিকে ঢেলে সাজানোর পর এখন দেশের ৬৪টি জেলায় লিগ্যাল এইডের কার্যালয় এবং সুপ্রিম কোর্টেও এর শাখা রয়েছে। ২০০১ থেকে এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে মোট সুবিধাভোগীর সংখ্যা তিন লাখ ৩৫ হাজার ৫৯৮ জন।
যাদের জন্য আইনগত এই সহায়তা : জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী ‘অসচ্ছল বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি’ যে কেউ এ সহায়তা পাবেন। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টে আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য ওই ব্যক্তির আয় বছরে গড় দেড় লাখ এবং অন্যান্য আদালতের ক্ষেত্রে এক লাখ টাকার মধ্যে হতে হবে। এ ছাড়াও কর্মক্ষম নন, আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন বা বার্ষিক দেড় লাখ টাকার ঊর্ধ্বে আয় করতে অক্ষম এমন মুক্তিযোদ্ধা, শিশু, বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এমন ব্যক্তি, ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থ মাতা, পাচারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত নারী, এসিডে দগ্ধ নারী বা শিশু, উপার্জনে অক্ষম ও সহায়-সম্বলহীন প্রতিবন্ধী এ সুবিধার অধিকারী হবেন। সমকাল