শারমীন সুলতানা:
গত ৯ মে শুরু হয় এই ‘অপারেশন তুরিন আফরোজ’। এদিন দৈনিক আমাদের সময়ের একটি খবর দিয়ে শুরু হয় এই অপারেশন, যার শিরোনাম ছিল ‘প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বরখাস্ত হতে পারেন’। তারপর মিডিয়াতে দেখা গেল এক বাম ঘরানার প্রসিকিউটরের অতিরিক্ত আস্ফালন। অভিযোগ করা হল এক অডিও নাকি পাওয়া গেছে সেখানে তুরিন আফরোজ অভিযুক্ত এক আসামির সঙ্গে ২৫ কোটি টাকার একটি লেনদেন করেছেন এবং তিনি আইন বহির্ভূতভাবে এই সাক্ষাৎ করেছেন। তার মতে, ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী তুরিন আফরোজের কোনো এখতিয়ার নেই অভিযুক্ত আসামির সঙ্গে দেখা করার। আসুন সেই অভিযোগগুলোর একটু খাতওয়ারি বিশ্লেষণ করি :
১। ২৫ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ:
তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে প্রথম যে অভিযোগটি ওঠে তা হচ্ছে তুরিন আফরোজ নাকি অভিযুক্ত ওয়াহিদুল হকের সাথে ২৫ কোটি টাকার লেনদেন করেছেন এবং এই সম্পর্কিত অডিও পাওয়া গেছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে এই অডিওর রেকর্ডিং এর ঠিক কোন জায়গাটিতে বা কোন মিনিটে বা কোন সেকেন্ডে এই ধরনের কথোপকথন রয়েছে যখন এই প্রশ্নটি করা হয় তখন কোনো উত্তরই পাওয়া যায় না। শুরু হয়ে যায় আমতা আমতা করে আবোলতাবোল অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা।
এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, ২৫ কোটি টাকা হচ্ছে এমন একটি অঙ্কের টাকা যেটি মাটিতে পুঁতে বা বিছানায় গুঁজে রাখা সম্ভব নয়। তাহলে সেই বিশাল অংকের টাকার লেনদেন সংক্রান্ত কাগজ হাজির করলেও ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু সেই কাগজও আজ পর্যন্ত হাজির করতে দেখলাম না। তাহলে সেই ২৫ কোটি টাকার লেনদেনের ভিত্তি কি? উত্তর অজানা!
২। ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী তুরিন আফরোজের অভিযুক্ত আসামির সঙ্গে দেখা করার এখতিয়ার নেই:
সেই বিপ্লবী কমরেড আরেকটি অভিযোগ তুলেছেন যে, ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী তুরিন আফরোজের অভিযুক্ত আসামির সঙ্গে দেখা করার এখতিয়ার নেই। আসুন আমরা দেখি ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে এই বিষয়ে কি বলা আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৮(২) ধারায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে- Any person appointed as a Prosecutor is competent to act as an Investigation Officer and the provisions relating to investigation shall apply to such Prosecutor. অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে যদি কাউকে প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় তবে তার একজন তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার দক্ষতা আছে বলেই ধরে নেয়া হবে এবং ওই আইনে তদন্ত করার ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া বর্ণিত আছে সবই ওই প্রসিকিউটরের ক্ষেত্রেও প্রয়োজ্য হবে।
যেহেতু প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একজন প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সেহেতু ট্রাইবুনালের আইন অনুযায়ী তিনি তদন্ত করবার দক্ষতা রাখেন। সুতরাং তদন্ত সংস্থায় নথিভুক্ত যে কোনো অভিযুক্ত আসামির ব্যাপারে তদন্ত করবার এখতিয়ার প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজের আছে। অতএব যারা প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজের তদন্ত করবার এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তারা আইন না জেনেই প্রশ্ন তোলেন।
এবারে আসি পরের প্রশ্নে- তদন্তকালে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ কোনো অভিযুক্ত আসামির সঙ্গে তদন্তের স্বার্থে দেখা করতে বা কথা বলতে পারেন কিনা। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৮(৪) ধারা প্রযোজ্য হবে যেখানে বলা আছে- Any Investigation Officer making an investigation under this Act may examine orally any person who appears to be acquainted with the facts and circumstances of the case. অর্থাৎ একজন তদন্ত কর্মকর্তা (এক্ষেত্রে একজন প্রসিকিউটর) তার তদন্তকালীন সময়ে অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনাবলীর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল যে কোনো ব্যক্তিকে মৌখিকভাবে কথাবার্তা বলে ঘটনার সত্যতা যাচাই বাছাই করবার অধিকার রাখেন।
তাহলে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ কোনো অভিযুক্ত আসামির ব্যাপারে তদন্তকালীন সময়ে তার সঙ্গে মৌখিক কথাবার্তা বলার মাধ্যমে অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতেই পারেন। আইন তাকে এই ক্ষমতা দিয়েছে। বিষয়টি কোনোভাবেই অনৈতিক বলে বিবেচ্য হতে পারে না।
এ তো গেল আইনের ব্যাখ্যা। এবার আরো একটি দালিলিক প্রমাণ আমরা দেখি।
https://www.youtube.com/watch?v=Hau8zfgDlIQ&feature=youtu.beএই লিঙ্কে গেলে আমরা দেখতে পাবো যে সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম ২০১১ সালে আরটিভিতে এক টকশোতে বলছেন, (ট্রাইব্যুনাল) আইনে প্রসিকিউটরদের তদন্তের সুযোগ আছে এবং আমরা (প্রসিকিউটররা) সেই সুযোগ নিচ্ছি। তাহলে খুব সহজাতভাবে প্রশ্ন জাগে মালুম সাহেবের ভাষ্যমতেও যদি প্রসিকিউটরদের তদন্তের এখতিয়ার থাকে এবং প্রসিকিউটররা যদি সেই এখতিয়ার প্রয়োগ করে থাকেন তাহলে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজের সময় এই গাত্রদাহ কেন? আর যদি ধরে নেই, ট্রাইব্যুনাল আইনে সেই সুযোগ নেই তাহলে কি প্রসিকিটর মালুম সাহেব জাতির সামনে ট্রাইব্যুনাল আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিলেন? তার ভাষ্যমতে যে সকল প্রসিকিউটর ইতিপূর্বে এই তদন্তের সুযোগ নিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
মজার বিষয় হচ্ছে সেই অতিবাম প্রসিকিউটরের কাছ থেকে আজ পর্যন্ত আমরা এই বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা পাইনি। খুব স্পষ্টই বোঝা যায় যে তিনি ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাকা’ নীতিতে বিশ্বাসী।
৩। তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ:
সেই বামপন্থী বিপ্লবী প্রসিকিউটরের আরো একটি অভিযোগ হচ্ছে তুরিন আফরোজের তদন্ত প্রক্রিয়া আইনসিদ্ধ হয়নি। অর্থাৎ আইনে যেভাবে বলা আছে তদন্ত প্রক্রিয়া সেই মোতাবেক হয়নি। মজার ব্যাপার হলো, ট্রাইব্যুনাল আইন এবং সংশ্লিষ্ট বিধিমালা তন্ন তন্ন করে ঘেটে দেখলাম কোথাও তদন্ত প্রক্রিয়া কি হবে সেটি নিয়ে একটি লাইনও উল্লেখ করা নেই। তার মানে দাঁড়ায়, এই ট্রাইব্যুনাল আইনে একজন প্রসিকিউটর (যিনি কিনা তদন্তকারী কর্মকর্তাও বটে) কে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে যে তিনি তার বিজ্ঞতা, প্রাজ্ঞতা, মেধা ও মনন দিয়ে সুবিধাজনক উপায়ে তদন্ত করতে পারবেন।
তাহলে খুব স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, যেখানে ট্রাইব্যুনাল আইনে তদন্ত প্রক্রিয়া বিষয়ে কোনো কথাই উল্লেখ করা নেই সেখানে প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজের তদন্ত প্রক্রিয়া বেআইনি হয় কি করে?
যখন পুরো বিষয়টি আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলছিল, কোনো কুলকিনারা পাচ্ছিলাম না, তখন হঠাৎ মনে হল, আচ্ছা এই তুরিন আফরোজ তো সেই তুরিন আফরোজ যিনি কী না ট্রাইব্যুনালে ২০টির মতো মামলা পরিচালনা করেছেন। যার পরিচালিত মামলাতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ৪৬। যার একটি মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া বিতর্কিত করতে পারলে তার করা পূর্ববর্তী সকল মামলা যেমন- নিজামী, মুজাহিদ, সাকা, গোলাম আজম, মীর কাশেম, আশরাফুজ্জামান, চৌধুরী মইনুদ্দিন, কায়সার, কামরুজ্জামান প্রভৃতি মামালাগুলোকেও বিতর্কিত করে পুরো যুদ্ধাপরাধ বিচারটিকেই বিতর্কিত করা যায়। আওয়ামী লীগ সরকারের গৌরবের অর্জনকে ধূলিসাৎ করে ফেলা যায়। তাহলে কি যে কাজটি এত দিন করতে চেয়েছিল জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের লবিস্টেরা, সেই কাজটি এখন করে যাচ্ছে ট্রাইব্যুনালের ভিতরের সেই বিপ্লবী কমরেড ?
বিপ্লবের লাল ঝাণ্ডার আড়ালে তাহলে কি তিনি উড়াতে চাইছেন জামায়াতের ঝাণ্ডা?
লেখক: এল এল এম (অধ্যায়নরত) ও অনলাইন এক্টিভিস্ট