বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইনের বিধিমালা গত মঙ্গলবার (১৬ অক্টোবর) জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব লায়লা জেসমিন। এই বিধিমালায় অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ের ক্ষেত্রে
শুধু বাবা-মা’র মতামতই নয়, একই সঙ্গে আদালতকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ আয়োজিত ‘বাংলাদেশের শিশু: প্রতিশ্রুতি ও অগ্রগতি ২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদনের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি।
লায়লা জেসমিন বলেন, ‘বাল্যবিয়ে নিরোধ করতে সচেতনতা বড় বিষয়। সমাজের সব অসঙ্গতি শুধুমাত্র আইন বা বিধি-বিধান দিয়ে দূর করা যায় না। বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইনের বিধিমালা ইতোমধ্যে জারি করা হয়েছে, গত ১৬ অক্টোবর জারি হয়েছে। এই বিধিমালায় অপরিণত বয়সে বিয়ের ক্ষেত্রে শুধু বাবা-মা’র মতামতই না, এর সঙ্গে আদালতকেও সম্পৃক্ত করা হয়েছে। বাবা-মা এবং আদালতের মতামতের ভিত্তিতে অপরিণত বয়সে বিয়ের ক্ষেত্রে সম্মতি পাওয়া যাবে। দুই পক্ষকে কিন্তু একমত হতে হবে, তা না হলে বিয়েটা হবে না। দুই পক্ষের এক পক্ষ অমত দিলে এখানে বিয়ের কোনও সুযোগ নেই। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে অনেকগুলো কারণের মধ্যে দারিদ্র একটি বড় বিষয়, শিক্ষাও একটি বড় বিষয়। আমরা আমাদের সমাজে যখনই একটি মেয়ের নিরাপত্তার অভাব বোধ করি, তখনই অল্প বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উদ্যোগ নিই। একজন দরিদ্র বাবা-মা’র জন্য নিরাপত্তা একটা বড় বিষয়।’
এর আগে অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রটেকশন ম্যানেজার রাশেদা আক্তার বলেন, ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিসংখ্যানগত দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয় এবং সারা পৃথিবীতে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। ইউনিসেফের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের শতকরা ৫৯ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই।
চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশের ১৯ টি জেলা থেকে ৮৫টি কেস স্টাডি বিশ্লেষণ করে জানা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ শিশুর বিয়ে হয়েছে ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সে এবং মাত্র সাত শতাংশ শিশুর বিয়ে হয়েছে ১৭ থেকে ১৮ বছর বয়সে। বাল্যবিয়ের কারণে অধিকাংশ মেয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্তর পার হতে পারছে না।
তিনি আরও বলেন, এসব কেস স্টাডি পর্যালোচনা করে বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে দেখা যায়, এখনও মেয়ে শিশুর প্রতি সমাজের গতানুগতিক বদ্ধমূল ধারণা, মেয়ের বয়স হয়েছে, সুপাত্র, যৌতুক ও সামাজিক চাপ ইত্যাদি কারণ ৪২ শতাংশ, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে ২৩ শতাংশ এবং অনিরাপত্তাকে দায়ী করেছেন ৬ শতাংশ বাবা-মা। এসব কেস স্টাডি থেকে আরও দেখা যায়, বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে ৮৫টি কেসের মধ্যে ৫৬ শতাংশ বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছে। কিন্তু রেজিস্ট্রিকৃত বিয়ের বয়স প্রমাণের জন্য জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট ব্যবহার করা হয়নি।
এছাড়া প্রতিবেদনে আরও যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হলো, শিশুদের জন্য পৃথক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উন্নয়নে অগ্রগতি সামান্য, শিশুবান্ধব বাজেট শিশুদের জন্য অংশগ্রহণমূলক নয়, জন্মনিবন্ধনে এখনও পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি উদ্বেগের বড় কারণ, সব শিশুর শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি এখনও চ্যালেঞ্জ, শিশুদের খেলাধুলা ও বিনোদনের অধিকার এখনও কম গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর ওপর সহিংসতার ক্ষেত্রে উদ্বেগের বড় বিষয় হলো, শিশু ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি। এ ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতা পরিবার, বিদ্যালয়, সমাজ ও শিশুর কর্মস্থলে সবক্ষেত্রেই সমানভাবে চলছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কারণ হিসেবে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে যেমন দায়ী করা হয়েছে, তেমনি শিশুর প্রতি যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গির অভাবও অনেকাংশে দায়ী। প্রতিবেদনে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের বিশেষ বিধানের সম্ভাব্য অপব্যবহার রোধে বিধিমালায় সঠিক দিক নির্দেশনাসহ ১২টি সুপারিশ করা হয়।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা শাহ্নাজ রহমান, এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা সৈয়দ মতলুব রশীদ প্রমুখ।