ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ :
সামনে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া এরই মধ্যে একাধিক দুর্নীতির মামলায় সাজা পেয়ে কারাবন্দি। একই সময়ে বাংলাদেশের আদালতে চলছে ‘নাইকো’ দুর্নীতি মামলার শুনানি। গত শুনানির দিন (২২ নভেম্বর ২০১৮) ‘নাইকো’ দুর্নীতি মামলায় রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার সাক্ষ্য নিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিচারিক আদালতে আবেদন করা হয়েছে। আগামী ৯ ডিসেম্বর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৯ এ আবেদনটি শুনানির জন্য রাখা হয়েছে। যদি আবেদনটি বাংলাদেশের আদালত আমলে নেয়, তাহলে এটাই হবে বাংলাদেশের কোনো আদালতে প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক দুর্নীতির মামলায় বিদেশি নাগরিকের সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্যগ্রহণের ঘটনা।
‘নাইকো’ দুর্নীতির ঘটনা এখন বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। কানাডার আদালতে এরই মধ্যে ‘নাইকো’ দুর্নীতি মামলায় কানাডিয়ান অপরাধীদের দণ্ডিত করা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের আদালতে দায়েরকৃত ‘নাইকো’ দুর্নীতি মামলায় বাংলাদেশি অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। কানাডায় নিবন্ধিত তেল ও গ্যাস উৎপাদন কোম্পানি ‘নাইকো’ আমাদের দেশের কয়েকটি গ্যাস ফিল্ড লিজ নেওয়ার চেষ্টা করে আসছিল। পূর্ব ও পশ্চিম ছাতক গ্যাসফিল্ড নিয়েই মূলত বিতর্ক। পশ্চিম ছাতক গ্যাসফিল্ড পরিত্যক্ত হলেও, ২০০২ সাল পর্যন্ত পূর্ব ছাতক গ্যাস ফিল্ড একটি ভার্জিন গ্যাস ফিল্ড অর্থাৎ গ্যাসে পূর্ণ ছিল বলে বাপেক্স এবং বাংলাদেশের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অভিমত দিয়েছিল। পূর্ব ছাতক গ্যাসফিল্ডে এখনো পর্যন্ত কোনো ড্রিলিং হয়নি।কিন্তু ‘নাইকো’ নানা অসৎ পন্থা অবলম্বন করে আমাদের দেশের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ‘হাওয়া ভবন’কে প্রভাবিত করে এই পূর্ব ছাতক গ্যাস ফিল্ডটি লিজ নেয় এবং একটি পরিত্যক্ত গ্যাস ফিল্ড হিসেবে এটাকে তখন তাদের হাতে দেওয়া হয়। আসলে এই গ্যাস ফিল্ড কখনো পরিত্যক্ত ছিল না৷ কিন্তু তখন অস্বচ্ছ এক চুক্তিতে নাইকোকে দু’টো গ্যাসফিল্ডই পরিত্যক্ত হিসেবে কম দামে দিয়ে দেওয়া হয়।
পূর্ব ছাতকের গ্যাস ফিল্ড নেওয়ার ব্যাপারে ‘নাইকো’ যে ঘুষ প্রদান করে, তা নিয়ে কানাডার রয়্যাল মাউন্টেড পুলিশ ২০০৫ সালে তদন্ত শুরু করে এবং তারা তদন্তে প্রমাণ পায়, ‘নাইকো’ কোম্পানি কানাডা থেকে ঘুষের টাকা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দেশ হয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল এবং কয়েকজন ব্যক্তিকে ঘুষ দিয়েছিল। এই তদন্তে তারা পেয়েছেন, টাকা কিভাবে কানাডা থেকে অন্যান্য দেশে বিশেষ করে ক্লেমেন আইল্যান্ড থেকে সুইজারল্যান্ড এবং সেখান থেকে ইউএসএ, তারপর বাংলাদেশে এনে ঘুষ হিসেবে দেওয়া হয়েছে।
পরবর্তীতে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করে। এরপর ২০০৮ সালের ৫ মে চুক্তির সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেয় দুদক। অভিযোগপত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়। বর্তমানে মামলাটির বিচার চলছে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে বসানো অস্থায়ী এজলাসে।
খালেদা জিয়া ছাড়া এই মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলাম, সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব সি এম ইউছুফ হোসাইন, বাপেক্সের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মীর ময়নুল হক, বাপেক্সের সাবেক সচিব মো. শফিউর রহমান, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুন, বাগেরহাটের সাবেক এমপি ও ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি এম এ এইচ সেলিম এবং নাইকোর দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট কাশেম শরীফ।
এরই মধ্যে ‘নাইকো’ কোম্পানির বিপক্ষে কানাডার ক্যালগারির একটি আদালতে বাংলাদেশের একজন প্রতিমন্ত্রীকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ ২০১১ সালের জুন মাসে প্রমাণিত হয়। তখন কানাডার ক্যালগারির আদালতের রায়ে বলা হয়, বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীকে অর্থ ও একটি এসইউভি গাড়ি এবং ক্যালগারি ও নিউইয়র্কে ভ্রমণের সুযোগ করে দিয়েছে ‘নাইকো’ কোম্পানি। কোম্পানিটিকে ৯৫ লাখ ডলার জরিমানাও করে কানাডীয় আদালত৷
এখানে উল্লেখ্য যে, এই মামলা শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া উভয়ের বিরুদ্ধেই ছিল, কিন্তু (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনার বিপক্ষে মামলা খারিজ হয়ে গেছে এবং খালেদা জিয়ার বিপক্ষে মামলা এখনও চলছে। কারণটা হলো, শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬-২০০১ সালে ‘নাইকো’ কোম্পানির সঙ্গে দরকষাকষি করেছে, শেষ পর্যন্ত চুক্তি করেনি। কারণ ‘নাইকো’র একটি শর্ত বাংলাদেশের স্বার্থের বিপক্ষে যাচ্ছিল। বাংলাদেশবিরোধী শর্ত মেনে না নেওয়ায় তখন ‘নাইকো’ কোম্পানির সঙ্গে কোনো চুক্তিই সই হয়নি। এ কারণেই, শেখ হাসিনার বিপক্ষে মামলা খারিজ হয়ে যায়।
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই ‘নাইকো’ কোম্পানির সঙ্গে তাদের সব শর্ত মেনে চুক্তি সই করে ফেলে। ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর নাইকো-বাপেক্স জেভিএ সই হয়। পরবর্তী সময়ে কানাডার আদালতে প্রমাণিত হয় যে ‘নাইকো’ বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার আমলে ঘুষ দিয়ে কাজ পায়। ‘হাওয়া ভবনের’ গিয়াস উদ্দিন আল মামুন ঘুষ নেন এবং খালেদা জিয়ার তৎকালীন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনকে ১ লাখ ৯০ হাজার কানাডীয় ডলার দামের একটি গাড়ি ও বিদেশ সফরের জন্য পাঁচ হাজার ডলার ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ‘নাইকো’ কোম্পানির বিরুদ্ধে।
ঘুষ-দুর্নীতির কাঁটাজালে আবদ্ধ বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। দেশি আদালতের ঘুষ-দুর্নীতির মামলাগুলোকে বিএনপি রাজনৈতিক মামলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মরিয়া হয়ে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এবার আন্তর্জাতিক ঘুষ-দুর্নীতির ঘটনা সামাল দিতে বিএনপিকে বেশ খানিকটা বেগ পেতে হবে বৈকি! রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআইতো আর আওয়ামী লীগ করে না। যদি তাদের সাক্ষ্য বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে ধ্বস নামিয়ে দেয়, তবে সামনের নির্বাচনে বিএনপির ‘ধানের শীষ’ কে খালি হাতেই ঘরে ফিরতে হবে। আর যাই হোক, দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো কর্মকাণ্ড লাল-সবুজের পতাকাবাহী জনগণতো কখনো মেনে নেবে না।
লেখক : আইনের শিক্ষক ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী