নারী-পুরুষের সমতা, অধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্ষণ আইনের সংশোধন ও সংস্কারসহ ধর্ষণ রোধে ২১ দফা সুপারিশ করেছেন বিশ্লেষকেরা। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ধর্ষণ আইনের সংস্কার শীর্ষক আলোচনা সভায় শনিবার (৮ ডিসেম্বর) বিশ্লেষকেরা তাঁদের সুপারিশ তুলে ধরেন।দিনব্যাপী এ আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, ধর্ষণ মূলত নারীর মানবাধিকার বোধকে ধ্বংস করা, তাকে পদানত রাখা বা অধস্তন করে রাখার টুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই শুধু বিচার কিংবা জরিমানা করলেই হবে না, এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আমাদের দর্শন ও নৈতিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
প্রথম আলোর পরামর্শক (বার্তা) কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা বলেন, ‘ধর্ষণ রোধ করতে হলে আমাদের মনের চিন্তা বা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। মিডিয়া জগতের ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও এ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন দরকার। এর সঙ্গে আইনটাও জরুরি। তাই মিডিয়াতে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে অভিযুক্ত ব্যক্তির কথা চিন্তা করার পাশাপাশি উল্টো দিকে যিনি আছেন তাঁর বিষয়টিও সতর্কভাবে চিন্তা করতে হবে।’
বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজের সম্পাদক নবনীতা চৌধুরী বলেন, ধর্ষণের সংবাদ পেলেই অনেকেই ক্যামেরা নিয়ে ভিকটিমের বাড়িতে চলে যান। তার পরিচয় প্রকাশ না করলেও বারবার ভিকটিমের বাড়িতে যাওয়ায় তার সম্পর্কে সবাই জেনে যায়, এতে ভিকটিম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আয়শা খানমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ব্লাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য জেড আই খান পান্না, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক জাফরুল হাছান, বাংলাদেশ আইন কমিশনের প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা ফৌজুল আজিম, কেয়ার বাংলাদেশের পরিচালক হুমায়রা আজিজ, হেইকি আলিফসেন, অধ্যাপক ফিওনা ডি লনড্রেস, আইনজীবী সারা হোসেন, মো. আবদুল হালিম, মাহতাবুল হাকিম প্রমুখ।
২১ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে—
- আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও বাংলাদেশ সংবিধানের নিশ্চয়কৃত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৫, ১০ ও ১৬ অর্জনের জন্য ধর্ষণ-সংক্রান্ত আইন সংস্কার করা;
- কোনোরূপ বৈষম্য না করে ধর্ষণের শিকার সব ব্যক্তি (লিঙ্গ-গোত্র-ধর্ম-বর্ণ-জাতিসত্তা-প্রতিবন্ধিতা বা যৌনতানির্বিশেষে) ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ধর্ষণের আইন সংস্কার করা;
- রাষ্ট্র পরিচালিত একটি ‘ক্ষতিপূরণ তহবিল’ গঠন করা, যেখানে ধর্ষণ প্রমাণ হওয়া সাপেক্ষে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ পেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অপরাধী চিহ্নিত হয়েছে কি না বা তার বিচার হয়েছে কি না, তা বিবেচনা না করা;
- চিকিৎসক, আইনজীবী, পুলিশ, বিচারক, সমাজকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সব পেশাজীবী ও কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ মডিউল ও ম্যানুয়াল পর্যালোচনা করে জেন্ডার সমতা, হাইকোর্টের নির্দেশনা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল এবং ন্যায়বিচার অভিগম্যতার ক্ষেত্রে নারীর যেসব অভিজ্ঞতা ও বাধার মুখোমুখি হয়, সেগুলোর সামাজিক প্রেক্ষিত এবং দায়দায়িত্বসংক্রান্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা;
- বিচারক, আইনজীবী, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ও সমাজকর্মীদের জন্য সংস্কারকৃত আইন সম্পর্কে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা;
- প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে সব স্তরের পাঠ্যপুস্তকে নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নির্যাতন এবং সম্মতি ও পছন্দ ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যেন সমাজে এ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়;
- অপরাধের শিকার ব্যক্তি, সাক্ষী এবং ধর্ষণের মামলা পরিচালনা ও তদন্ত সংস্থার তথ্য বিভিন্ন ফরমেটে ও ভাষায় প্রচার করা;
- ধর্ষণসংক্রান্ত আইন ও বিচারপদ্ধতি বিশেষ করে নারীপক্ষ ও অন্যান্য বনাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশনা (জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতায় প্রতিক্রিয়া: স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রটোকল) সহজ ভাষায় সংশ্লিষ্ট সবার (বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সমাজকর্মী ও আইন সহায়তা সংস্থা) কাছে প্রচার করতে হবে;
- যেকোনো লিঙ্গ-নির্বিশেষে সম্মতি ছাড়া সব ধরনের পেনিট্রেশনকে আওতাভুক্ত করে ধর্ষণের পুনঃ সংজ্ঞায়িত করতে হবে;
- ‘সম্মতি’ প্রত্যাহার হতে পারে এমন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ধর্ষণের সংজ্ঞাকে সুস্পষ্ট করতে হবে;
- বলপ্রয়োগ বা শারীরিক বাধা প্রদান প্রমাণের অনুপস্থিতি ‘সম্মতি’ প্রদান বোঝায় না, তা সুস্পষ্ট করতে হবে;
- কোনো বস্তু বা দ্রব্যের ব্যবহারকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘পেনেট্রেশন’-এর সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট করা;
- ছেলে শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এ ‘শিশু’ শব্দটিকে সুনির্দিষ্ট করা;
- কোনোরূপ বৈষম্য না করে ধর্ষণের শিকার সব ব্যক্তির (নারী, শিশু, পুরুষ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, হিজড়া জনগোষ্ঠী, রূপান্তরকামী ব্যক্তি, আদিবাসী, যৌনকর্মীসহ সবার) ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ধর্ষণ আইনের সংস্কার করা;
- ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টি শর্তসাপেক্ষ বা বিচারিক বিবেচনায় না রেখে অপরাধীর কাছ থেকে পাওয়া বাধ্যতামূলক করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে, ২০০০-এর ১৫ ধারা সংশোধন করা;
- অপরাধের গুরুত্ব ও প্রকৃতি অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করা এবং অন্যান্য যৌক্তিক বিষয় যেমন-অভিযুক্তের বয়স ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনায় নেওয়ার জন্য শাস্তি প্রদানসংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা;
- ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে ভাষা ও শ্রবণ এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যাতে ধর্ষণ মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করতে পারে, এমন ব্যবস্থা রেখে আইনটির সংশোধন করা;
- ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনে ধর্ষণ মামলায় অভিযোগকারীর চারিত্রগত সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে আইনটির ১৫৫ (৪) ধারার সংশোধন করা;
- আসামিপক্ষের আইনজীবীরা অভিযোগকারীকে জেরার সময় যাতে অবমাননাকর ও অপমানজনক প্রশ্ন করতে না পারেন, তা-ও এ আইনে নিশ্চিত করা;
- সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ আইন কমিশনের তৈরি করা খসড়া সাক্ষী সুরক্ষা বিলটি বিশেষ করে যেসব ব্যক্তি জাতিসত্তা, বর্ণ, ধর্ম এবং প্রতিবন্ধকতার কারণে বৈষম্যের শিকার, তাদের প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে সবার সঙ্গে পরামর্শ করা এবং
- ওই পরামর্শ পরবর্তী আইনে অপরাধের শিকার ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদের প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষার অধিকার, জরুরি পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা প্রদান করে সাক্ষী সুরক্ষা বিল পাস করা ও সাক্ষীদের সুরক্ষা চলমান রাখা।