ব্যক্তিস্বার্থে সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ সাত বছরের জেল বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি আইন করছে সরকার।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ সংক্রান্ত ‘স্বার্থ সংঘাত প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা আইন’- এর খসড়া প্রণয়ন করে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে। এখন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের মতামত নিয়ে খসড়াটি চূড়ান্ত করার কাজ করছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
দুদকের তৈরি খসড়া অনুযায়ী, অবসরের দুই বছরের মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারবেন না সরকারি চাকরিজীবীরা। প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তার কোনো আত্মীয় ওই প্রকল্পের টেন্ডারে অংশ নিলেও সেই কর্মকর্তাকে শাস্তির মুখে পড়তে হবে।
প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বহুমুখী স্বার্থ থাকে। অনেক সময় তাদের ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পাওয়ায় বৃহত্তর জনস্বার্থ ও জনকল্যাণ উপেক্ষিত হয়। সরকারি চাকুরেদের ব্যক্তিক ও পেশাগত স্বার্থের সংঘাত বা পারিবারিক দুর্নীতি দূর করতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নানা বিধি-বিধান ও নৈতিক চর্চার নজির থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই। তাই এ সুযোগে বাংলাদেশে স্বার্থ সংঘাত সংক্রান্ত নিয়ম লঙ্ঘিত হচ্ছে অহরহ।
কর্মকর্তারা সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে নানা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করছেন, জড়িয়ে পড়ছেন পারিবারিক দুর্নীতিতে। চাকরিতে থাকাকালীন যে প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিয়েছিলেন অবসরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন।
এসব অনিয়ম প্রতিরোধের মাধ্যমে সুশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আইনটি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুদকের উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা স্বার্থ সংঘাত প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা আইনের খসড়া করে তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে দিয়েছি। বাকি প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করে তারা আইনটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন, আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের পর সংসদের মাধ্যমে চূড়ান্ত করবে।’
স্বার্থ সংঘাত প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা আইনের খসড়া প্রণয়ন ও ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪’ – এর তফসিলভুক্তের বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মতামত নেয়া হয়েছে। খসড়া চূড়ান্তে মতামতগুলো কীভাবে এবং কতটা বিবেচনায় নেয়া হবে সেই বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব (জেলা ম্যাজিস্ট্রেসি অধিশাখা) মো. সাবিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, মতামতের জন্য খসড়াটি আমরা মন্ত্রণালয়/বিভাগে পাঠিয়েছিলাম। তাদের কাছ থেকে মতামতও পেয়েছি। মতামতগুলো যাচাই করে দেখছি, কোন ধারার ওপর কতটুকু মতামত আসছে সেগুলো সংযুক্ত করে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করব।
আইনের খসড়া চূড়ান্তের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে জানিয়ে যুগ্ম সচিব বলেন, ‘আমরা একটু দেখেশুনে এগোচ্ছি।’
আইনের খসড়ায় স্বার্থ সংঘাতের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, সরকারি বা বেসরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বা নিয়োজিত পরামর্শক বা উপদেষ্টা বা অপর কোনো ব্যক্তির মধ্যে বিদ্যমান কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ যা তাদের দায়িত্ব পালনকে প্রভাবিত করতে পারে বা আস্থার হানি ঘটায় বা অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অবৈধ বা পরোক্ষ লাভের কারণ হয়।
যদি কোনো স্বার্থ সংঘাত থেকে কোনো ধরনের অনৈতিক বা অন্যায় ফলাফল উদ্ভূত নাও হয় তারপরও এ আইনের অধীন স্বার্থের সংঘাত হিসেবে গণ্য হতে পারে। এ বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, ‘ক’ একটি প্রকল্পে নিয়োজিত থাকাকালীন তার পুত্র ‘খ’ ওই প্রকল্পের একটি টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে। যদিও ‘খ’ ওই টেন্ডার পায়নি, তারপরও ‘ক’ এর বিরুদ্ধে এই আইনের আওতায় স্বার্থ সংঘাতের অভিযোগ আনা যেতে পারে।
খসড়া অনুযায়ী কোনো প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে নিয়োজিত কোনো সরকারি বা বেসরকারি কর্তৃপক্ষ বা দফতর ওই প্রকল্পে এমন কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী বা পরামর্শককে নিযুক্ত করবেন না বা কাজে লাগাবেন না যার সঙ্গে প্রকল্প সম্পর্কিত স্বার্থ সংঘাত রয়েছে। এ বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
প্রকল্পে নিয়োজিত কোনো কর্মকর্তার স্বার্থ সংঘাত নজরে আসলে কর্তৃপক্ষ ওই প্রকল্প থেকে তাকে বাদ দেবে। কোনো সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা কোনো প্রকল্পে উপদেশ বা সুপারিশ বা সিদ্ধান্ত দেবে না যদি তার ওই প্রকল্পে স্বার্থ সংঘাত থাকে বা সে অবগত থাকে যে তার সুপারিশ বা সিদ্ধান্তের ফলে অন্য কারও ব্যক্তিগত লাভের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এই নিয়ম না মানলেও একই শাস্তি পেতে হবে।
শাস্তি পেতে হবে, যদি কোনো সরকারি বা বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পদাধিকারবলে বা ক্ষমতায় প্রাপ্ত তথ্য নিজের বা অপর কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করেন।
স্বার্থ সংঘাত থাকা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে আইনগত ক্ষতিপূরণ ছাড়া কোনো ধরনের অর্থগত বা বস্তুগত সুবিধাদি (যা কেবল পারিশ্রমিক, পাওনা, উপহার, সেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং আতিথিয়তা যাতে ভ্রমণ ব্যয়, ব্যক্তিগত সুবিধা, গবেষণা অর্থায়ন, পরিবারের সদস্যদের প্রতি উপহার) সুবিধাদি গ্রহণ করতে পারবেন না। এক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড পেতে হবে।
কোনো ব্যক্তি ফৌজদারি অপরাধ সংগঠনের উদ্দেশ্যে এ আইনের কোনো ধারা লঙ্ঘন করলে তাকে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা এবং অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।
কোনো কমিটি, প্যানেল, বোর্ড কর্তৃপক্ষ, কমিশন বা অন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বা বাস্তবায়নকারী সংস্থার কোনো সদস্য স্বার্থ সংঘাত সৃষ্টি করে এমন কোনো ব্যবসা, বৃত্তি, চাকরি বা অন্য কোনো পেশায় জড়াতে পারবেন না। এমনকি কোনো কর্পোরেশন বা কোনো লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত হতে পারবেন না। এ বিধান না মানলে দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।
এছাড়া কমিটি ও কর্তৃপক্ষের সদস্য অংশীদারী বা একক মালিকানায় কোনো ব্যবসা পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না; এমন কোনো সিকিউরিটি, স্টক, পণ্য বা বাণিজ্যিক এন্টারপ্রাইজের অধিকারী হবেন না বা এমন কোনো ব্যবসায় অংশগ্রহণ করবেন না যাতে তার গ্রহণ করা কোনো রীতি বা এর বাস্তবায়ন তাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লাভবান করবে। এ নিয়মের ব্যত্যয়েও একই শাস্তি।
কোনো কর্তৃপক্ষ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও বাস্তবায়নকারী সংস্থায় নিয়োজিত কোনো সদস্য জ্ঞাতসারে ওই সংস্থার সাবেক কোনো সদস্য যার ওই দফতর থেকে অবসর নেয়ার পর কমপক্ষে ২৪ মাস অতিবাহিত হয়নি তার সঙ্গে কোনো চুক্তি করবে না বা কোনো চুক্তির অনুমোদন করবে না বা তার অনুকূলে কোনো অনুদান বরাদ্দ করবে না। করলে দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে।
কোনো কমিটি, প্যানেল, বোর্ড, কর্তৃপক্ষের সদস্য চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার ২৪ মাস পার হওয়ার আগে কোনো মঞ্জুরি অনুদান অনুমোদন সংক্রান্ত কোনো চুক্তির সুবিধা গ্রহণ করবে না। এ বিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
এ আইনে শাস্তির কথা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই, এমন কোনো ধারা বা বিধান লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে বা লঙ্ঘনে কাউকে প্ররোচিত করা হলে তাকে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থ দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
স্বার্থ সংঘাত প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা আইনের আওতায় কোনো কোম্পানির অপরাধের ক্ষেত্রে ওই কোম্পানি বা কোম্পানির ব্যবসা পরিচালনার জন্য দায়িত্ব পালনরত ও অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িত প্রত্যেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। তবে যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি প্রমাণ করতে সক্ষম হবে যে অপরাধ তার অজ্ঞাতে হয়েছে এবং অপরাধ প্রতিরোধে সে যথাসাধ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল সেক্ষেত্রে সে এ আইনে শাস্তির আওতায় আসবে না।
এ আইন ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন- ২০০৪’ এর তফসিলভুক্ত একটি আইন হবে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন এ আইনের অধীন অপরাধগুলো তদন্ত ও অনুসন্ধান করতে পারবে বলে খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে। সূত্র : জাগোনিউজ