সহকারী জজ ছগির আহমেদ

ফৌজদারি মামলায় কখন অব্যাহতি, কখন খালাস

ছগির আহমেদ: 

একটি ফৌজদারি মামলায় কখন অব্যাহতি ও কখন খালাস প্রদান করা হয় সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে অব্যাহতি (Discharge) এবং খালাস (Acquittal) এর মধ্যে মূল পার্থক্যটি আলোচনা করে নেয়া একান্ত আবশ্যক। কাউকে যদি ফৌজদারি মামলা ( Criminal case) থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়ে থাকে পরবর্তীতে একই মামলায় তাকে আবার অভিযুক্ত করা যায়। তার মানে আসামী এই মামলা থেকে পুরোপুরি মুক্ত নন। পক্ষান্তরে কাউকে যদি কোন ফৌজদারী মামলা থেকে খালাস দেয়া হয় তাহলে সে ঐ মামলা থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে যাবে। পরবর্তীতে আসামীকে একই মামলায় আর ডাকা যাবে না। যথাসম্ভব সহজ ভাষায় নিম্নে বিষয়টি ব্যাখা করার চেষ্টা করেছি।

এখন জেনে নেয়া যাক, কখন ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়রা আদালত একজন আসামীকে ফৌজদারী মামলা হতে অব্যাহতি (Discharge) দিবেন এবং কখন খালাস (Acquittal) প্রদান করবেন।

ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা-২৪১(ক) তে বলা হয়েছে, আসামীকে ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট হাজির করার পর, ম্যাজিস্ট্রেট মামলার নথি ও নথির সাথে দাখিলকৃত যাবতীয় কাগজপত্র বিবেচনা করবেন। তারপর ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজন মনে করলে আসামীর জবানবন্দী গ্রহণ করবেন। তারপর ফরিয়াদী ও আসামীকে বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দান করবেন। তারপর আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন মনে হলে আসামীকে উক্ত মামলা হতে অব্যাহতি দিবেন। তারপর তিনি আসামীকে অব্যাহতি দেয়ার কারণটি লিপিবদ্ধ করে রাখবেন। ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬৫(গ) ধারায় দায়রা আদালত উপরোক্ত কারণে একজন আসামীকে অব্যাহতি দিয়ে থাকেন।

ফৌজদারী কার্যবিধির বেশ কয়েকটি ধারায় ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে আসামীকে খালাস প্রদানের কথা বলা হয়েছে। নিম্নে সেগুলো ছোট ছোট করে আলোচনা করা হয়েছে, যেন পুরো বিষয়গুলো খুব সহজে আয়ত্তে আনা যায়।

ধারা-২৪৫
এখানে বলা হয়েছে,আদালত সকল সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে এবং আসামীকে পরীক্ষা করে যদি দেখে আসামী নির্দোষ তাহলে আসামীকে খালাস প্রদান করবেন। তার মানে এই ধারায় বলা হয়েছে আদালত সকল সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে মামলার শেষ পর্যায়ে আসামীকে নির্দোষ পেলে তাকে খালাস প্রদান করবেন।

ধারা-২৪৭
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪৭ ধারা কেবলমাত্র নালিশী মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। পুলিশী মামলার ক্ষেত্রে ২৪৭ ধারা কখনো প্রযোজ্য হবে না।

এবার জেনে নেয়া প্রয়োজন নালিশী এবং পুলিশি মামলা কি?

নালিশী মামলা
যে সকল মামলা থানায় এফ.আই.আর এর মাধ্যমে ফাইল না করে সরাসরি অভিযোগ দায়েরের মাধ্যমে আদালতে দাখিল করা হয় তাকে নালিশী মামলা বলে। নালিশী মামলায় ফরিয়াদীকে মামলার খরচ বহন করতে হবে। ফরিয়াদী মানে হল মামলার অভিযোগকারী ব্যক্তি।

পুলিশি মামলা
যে সকল মামলা এফ.আই.আর এর মাধ্যমে থানায় দাখিল করা হয় তাকে পুলিশী মামলা বলে। FIR মানে হল First Information Report. পুলিশি মামলায় মামলার সমস্ত খরচ বহন করবে রাষ্ট্রপক্ষ।

এখানে আসামীকে আদালতে হাজির করার জন্য সমন দিতে হবে। যদি আসামীকে হাজির করার জন্য আদালত ওয়ারেন্ট ইস্যু করে তাহলে এক্ষেত্রে ২৪৭ ধারা প্রযোজ্য হবে না। নালিশী মামলায় শুনানির জন্য ধার্য তারিখে ফরিয়াদী অনুপস্থিত এবং আসামী উপস্থিত থাকলে আসামী খালাস পাবে। তবে এক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক আসামীকে সমন দিতে হবে। তার মানে আসামীকে আদালতে হাজির করার জন্য সমন দিতে হবে, ওয়ারেন্ট দিলে চলবে না।

এখন কথা হলো, ২৪৭ ধারা শুধুমাত্র সমন ইস্যুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ওয়ারেন্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না কেনো? আমরা জানি কোন কোন ক্ষেত্রে আসামীকে আদালত কর্তৃক ধার্য তারিখে আদালতে হাজির করার জন্য সমন বা ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হবে সেটা ফৌজদারী কার্যবিধির শিডিউল -২, কলাম-৪ এ বলা আছে। সাধারণত ছোটখাটো অপরাধের ক্ষেত্রে আসামীকে আদালতে উপস্থিত করার জন্য সমন ইস্যু করা হয়ে থাকে। আর বড় ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে আসামীকে উপস্থিত করার জন্য ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়ে থাকে। এখন ছোটখাটো অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক ধার্য তারিখে ফরিয়াদী অনুপস্থিত থাকলে এবং আসামী উপস্থিত থাকলে। এক্ষেত্রে আসামীকে আদালত খালাস দিতে পারবে। খুন (murder) একটা বড় ধরনের অপরাধ। এক্ষেত্রে আসামীকে আদালতে উপস্থিত করার জন্য ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়ে থাকে। খুনের মামলায় আদালত কর্তৃক ধার্য তারিখে ফরিয়াদীকে অনুপস্থিত থাকলেই কি আসামীকে আদালত খালাস দিতে পারবে? না, পারবে না। এজন্য ২৪৭ ধারা ওয়ারেন্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আশা করি ২৪৭ ধারার তত্ত্বটা আপনাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি।

২৪৫ ধারা এবং ২৪৭ ধারার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল, ২৪৫ ধারায় সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহন শেষে এবং আসামীকে পরীক্ষা করার পর ম্যাজিস্ট্রেট আসামীকে নির্দোষ পেলে তাকে খালাস প্রদানের আদেশ দিবেন। আর ২৪৭ ধারায় শুনানীর দিন আসামী উপস্থিত আর ফরিয়াদী অনুপস্থিত থাকলে আসামীকে ম্যাজিস্ট্রেট খালাস প্রদান করবেন। ২৪৫ ধারায় আসামী মামলার শেষ পর্যায়ে খালাস পায় আর ২৪৭ ধারায় আসামী ফরিয়াদীর ত্রুটি (Default) এর কারনে মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে খালাস পেয়ে যায়। এখানে ফরিয়াদী বলতে অভিযোগকারীকে বুঝানো হয়।

ধারা-২৪৮
ফৌজদারী কার্যবিধির এই ধারাটি শুধুমাত্র সি.আর মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। জি.আর মামলার ক্ষেত্রে এই ধারাটি প্রযোজ্য হবে না। এই ধারাটি কেন শুধুমাত্র সি.আর মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, সেটা বুঝার একটা উপায় আছে। এই ধারার প্রথমেই ফরিয়াদী (complainant) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। জি.আর মামলায় মামলা করে রাষ্ট্রপক্ষ। আর সি.আর মামলায় মামলা করে ফরিয়াদী। জি.আর মামলা এফ.আই.আর (FIR) এর মাধ্যমে থানায় দায়ের করা হয়। আর সি.আর মামলা ফরিয়াদী সরাসরি আদালতে দায়ের করে থাকেন। ২৪৮ ধারায় বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক চূড়ান্ত আদেশ (final order) দেয়ার আগে যেকোন সময় ফরিয়াদী তার অভিযোগ তুলে নিতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে ফরিয়াদীকে অভিযোগ তুলে নেয়ার যথোপযুক্ত কারণ ম্যাজিস্ট্রেটকে জানাতে হবে। তারপর ম্যাজিস্ট্রেট কারণে সন্তুষ্ট হলে আসামীকে খালাস (acquittal) প্রদান করবে।

ধারা-২৬৫(জ)
বাদীপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ এবং আসামী পক্ষের জবানবন্দী নিয়ে দায়রা আদালত যদি মনে করে আসামী নির্দোষ তাহলে আদালত আসামীকে খালাস (Acquittal) প্রদানের আদেশ দিবেন।

ধারা-২৪৫,২৪৭,২৪৮ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। আর ধারা-২৬৫(জ) দায়রা আদালতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

আইনগতভাবে আদালত কখন একজন আসামীকে খালাস প্রদান করে এবং কখন অব্যাহতি প্রদান করে, আশা করি উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে তা তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে।

লেখক : সহকারী জজ, শরীয়তপুর জজ কোর্ট