ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম আশরাফ

সমাজের কাছে আইনজীবীদের দায়বদ্ধতা শতভাগ : ব্যারিস্টার আশরাফ

ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের পক্ষ থেকে আজকের এই বিশেষ সাক্ষাৎকারে আপনাকে স্বাগতম…

ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম : একজন আইনজীবী হিসাবে আমি প্রথমেই বলতে চাই, আমরা সকল আইনজীবীরা ল’ইয়ার্স ক্লাবের প্রতি কৃতজ্ঞ। কেননা ল’ইয়ার্স ক্লাব আমাদের প্রতিটা আইনজীবীদের মধ্যে একটা সেতুবন্ধনের কাজ করেছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে অনেক সময় পত্রিকা পড়ার সুযোগ না পেলেও ল’ইয়ার্স ক্লাবের নিউজগুলো প্রতিনিয়ত পড়ি। আমার বিশ্বাস ল’ইয়ার্স ক্লাব আইনাঙ্গনে সবচাইতে জনপ্রিয় এবং একমাত্র অনলাইন পত্রিকা।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: প্রথমেই জানতে চাই আপনার বেড়ে ওঠা, পড়াশুনা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়, আইন পড়া এবং পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে কারো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন কি-না?

ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম: খুব ছোট বেলা থেকে আমি মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখে বড় হয়েছি। আমার চোখে শুধুমাত্র খাবারের অভাবে মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিতে দেখেছি। এই সকল অসহায় মানুষদের জন্য সত্যিকার অর্থে যদি কিছু করতে যাই সেক্ষেত্রে যদি সমাজসেবক হই তাহলেও আমাকে কারো না কারো উপর নির্ভশীল হতে হবে। কিন্তু আমি যদি আইনজীবী হতে পারি তাহলে আমার কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার উপার্জন দিয়ে এইসকল অসহায়, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি। এই জন্যই আমার পেশা হিসাবে আইনকে বেছে নেওয়া। যেখানে দুঃখ কষ্টে নিপীড়িত মানুষেরকে সহযোগিতা করার অনেক অনেক সুযোগ রয়েছে।

আমি ছোটবেলা থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে পরিপূর্ণভাবে সম্পৃক্ত। আমি নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে তৎকালীন সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের আমলে জেলহাজতে যেতে হয়েছে। ১৯৯৩ সালে বেগম জিয়ার শাসনামলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সোচ্চার হওয়ায় আমি নির্যাতনের শিকার হই। তখন থেকে আজ অবধি আমি নিপীড়িত মানুষের হয়ে কাজ করে যাচ্ছি।

আমার মতো সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করা এক প্রকার অসম্ভব। তাই যারা সমাজের উঁচুস্থলে আছেন আমাকে তাদের মতো হতে হবে, এজন্য একটাই পথ রয়েছে সেটা হচ্ছে লেখাপড়া। এই জন্য আমি সবসময় লেখাপড়ায় মনযোগী ছিলাম। শত কষ্ট ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমি ব্যারিস্টার হয়েছি। এর জন্য কারো কাছে পাঁচ টাকা চেয়ে নিতে হয়নি। আমি পরিশ্রম করে রেস্টুরেন্টে কাজ করে ব্যারিস্টারি পড়ার টাকা যোগাড় করেছি। এখন আমি সেই সকল সাধারণ মানুষদের সাহায্যে তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি, তাদের নেতৃত্ব দিতে পারি।

মানুষ যত বড় অপরাধী হোক না কেন যদি সে আইনজীবীর কাছে আশ্রয় নিতে আসে আমাদের উচিত একজন আইনজীবী হিসেবে তার যেটুকু অধিকার রয়েছে সেটুকুর জন্য লড়াই করা। একজন আইনজীবী হিসাবে আমার সবচাইতে বেশি অনুপ্রেরণার জায়গা হচ্ছে আমার রাজনীতির ক্ষেত্র। কেননা এটি একটি স্বাবলম্বী পেশা এই পেশায় থেকে রাজনীতির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার অধিক সুযোগ রয়েছে।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনি তো একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত, দলের সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে (টাঙ্গাইল-৬ আসন) নির্বাচনে গেলেন কেন?

ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম: আমি শুধুমাত্র একটা দলের সাথে সম্পৃক্ত বললে ভুল হবে। বাংলাদেশের অপর নাম হচ্ছে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তার সুযোগ্য কন্যা আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা আমি তাদের আদর্শে অনুপ্রানিত। কেননা সারা বাংলাদেশের মানুষ একমাত্র শেখ হাসিনার উপর বিশ্বাস ও ভরসা রাখতে পেরেছে। শুধুমাত্র এই একটি কারনে আমাদের দেশে এখনো কোনও আন্দোলন নেই। কেননা শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বাংলার জনগন শান্তিতে রয়েছে। কিন্তু যেহেতু আমরা সাধারণ মানুষ সেহেতু আমাদের সকল দাবী হয়তো তার কান পর্যন্ত পৌছায় না।গত জাতীয় একাদশ নির্বাচনে আমি মনোনয়ন চেয়েছিলাম কিন্তু আমি মনোনয়ন পাইনি। কেননা আমি খুবই সাধারণ তাই আমাদের ব্যাবহার করা হয় কাজের ক্ষেত্রে গুরুত্বের ক্ষেত্রে নয়। তাই আমি স্বতন্ত্র থেকে গত একাদশ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি মূলত এটা আমার একটা প্রতিবাদ। প্রতিবাদটা হল আপনারা যাকেই মনোনয়ন দিন না কেন তাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু যারা মনোনয়ন প্রার্থী তাদের সাথে মনোনয়ন যারা পেয়েছেন তারা যেন একটা সুন্দর আলোচনায় আছে। অথচ আপনারা জানেন, আমার আসন থেকে যিনি মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি আমাদের সাথে বৈঠক তো দূরের কথা উল্টো আমার গাড়ি ভেঙ্গেছে, আমার ভাইকে গুলি করেছে, আমাকে শারীরিক ভাবে নির্যাতন করেছে। তাই আমি আমার ব্যক্তিত্ব রক্ষায় দলীয় সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে স্বতন্ত্র থেকে ট্রাক মার্কায় নির্বাচন করি। সেখানেও তারা আমাকে কোনও প্রকার প্রচারণার সুযোগ দেয়নি। আমার দলীয় কর্মীদের পোস্টার লাগাতে দেওয়া হয়নি। এমনকি আমাকে একটা বন্ধ ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে। যারা মনোনয়ন প্রার্থী তাদের মধ্যে যিনি দলীয় ভাবে মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি যেন অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীদের সাথে এক মিনিটের জন্য হলেও আলোচনায় বসেন। কেননা মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে একজন হলেও বঙ্গবন্ধুর সৈনিক রয়েছে। যিনি মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি যদি অন্যান্য মনোনয়ন প্রার্থীদের সাথে আলোচনা না করে মনোনয়ন পাওয়াটাকেই ধরে নেন সুনিশ্চিত জয় হিসাবে এবং তার বিপক্ষে যারা মনোনয়ন চেয়েছিলেন তাদের নির্মূল করে দেওয়াটাই যদি তার উদ্দেশ্য হয় তার প্রতিবাদ জানাতেই আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে গত সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলাম।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন?

ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম: যখন জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু দেশটাকে স্বাধীন করেছেন তখন ইন্টারনেট ছিলনা। কম্পিউটার কিংবা মোবাইলে মুহূর্তে ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিমেষেই পৃথিবীর এক প্রান্তের খবর অন্য প্রান্তে পৌঁছানোর ব্যবস্থা ছিল না। যা উনার নাতী সজিব ওয়াজেদ জয় নিয়ে এসেছেন। তাই আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার সাথে সজিব ওয়াজেদ জয়ের ডিজিটাল বাংলাদেশের সমন্বিত একটি উন্নত অত্যাধুনিক বাংলাদেশ দেখতে চাই।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: তরুণরা রাজনীতি বিমুখ বলে অভিযোগ আছে, এর কারণ কি?

ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম: তরুণ আইনজীবীদের ক্ষেত্রে আমি একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। কেননা ১৯৯০ সালে জেল খাটা থেকে আজকের এইদিন পর্যন্ত আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কেউ একটা প্রশ্ন তুলতে পারবে না। আমি খুবই সাধারণ একটা পরিবার থেকে ব্যারিস্টার হয়েছি। এই দেশে খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ৯৫ শতাংশ। আমি তাদেরি প্রতিনিধি। আমি মনোনয়ন চাওয়ার অপরাধে আমাকে মেরে ফেরার উদ্দেশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। যদি আমার ক্ষেত্রে এইটা হয় তাহলে আমি কীভাবে একজন তরুণ আইনজীবীকে রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত করতে পারি? এমতাবস্থায় কীভাবে একজন তরুণ আইনজীবী  যিনি কি-না সবেমাত্র মা-বাবার স্বপ্ন পূরণে পড়াশুনা শেষ করে আদালতে পা রেখেছেন তার থেকে সিনিয়র কোনও আইনজীবী কি করে তাকে রাজনীতিতে স্বাগত জানাতে পারে? ব্যক্তিগতভাবে কোনও নবীন আইনজীবী যিনি হতে পারেন আগামী দিনের অহংকার তাকে আমি বলির পাঠা হতে দিতে রাজি নই।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: এই সংকট নিরসনে আপনার পরামর্শ কি?

ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম: তরুণ আইনজীবীরা রাজনীতিতে বিমুখতা নিরসনে আমি বলতে চাই, ব্যক্তিস্বার্থে যারা রাজনীতি করে তাদের প্রথম ঘৃণা করা শিখতে হবে তাহলে দেশপ্রেমের রাজনীতি জাগরিত হবে প্রতিটি নবীন প্রাণে। তখন রাজনীতি হবে একটি সুন্দর দেশ সাজাতে, নিজের পকেট ভরতে নয়। আমাদেরকে অবশ্যই জয় করতে হবে তা না হলে অশিক্ষিত, চাটুকার, টেন্ডারবাজ, মাদকসেবীদের মতো কিছু নীচপ্রকৃতির লোক রয়েছে যারা টাকার ক্ষমতা দিয়ে নেতা-কর্মীদেরকে কিনে ফেলছে। ঐ সকল অশিক্ষিত ভণ্ডরা একজন শিক্ষিত তরুণ আইনজীবী যিনি রাজনীতিতে সক্রিয় তার সামনে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চলবে, ঐ তরুণ আইনজীবী তথা এই দেশের জন্য এর থেকে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না। তাই প্রতিটি তরুণ আইনজীবীকে সমাজের কর্ণধার হিসাবে নিজের সক্রিয় অবস্থান সৃষ্টি করতে হবে যেন কোনও সুবিধাবাদী সমাজের তথা দেশের ক্ষতি করতে না পারে, কিংবা অশিক্ষিত চাটুকার যারা টাকার ক্ষমতায় দেশটাকে নিজেদের ভোগ বিলাসের বস্তু মনে করে করতে না পারে, যেন অসৎ উপায়ে দেশের ক্ষতি সাধনের মাধ্যমে টাকা উপার্জনের চিন্তা করার আগে অন্তত দশবার তাদের ভাবতে হয়। কথায় আছে, নলেজ ইজ পাওয়ার। তাই বেশি বেশি শিখতে হবে আর এই শিক্ষার মাধ্যমে যখন শিক্ষিত তরুণরা দেশের রাজনীতির হাল ধরবে সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরাও উন্নত দেশের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারবো উন্নতির সুউচ্চ সোপানে।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আইনজীবীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কেমন, এই জায়গায় আইনজীবীরা কতটুকু আন্তরিক বলে আপনি মনে করেন?

ব্যারিস্টার আশরাফুল ইসলাম: সমাজের কাছে আইনজীবীদের দায়বদ্ধতা শতভাগ। কেননা প্রতি মুহূর্তে মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে আইনজীবীরা অবগত থাকেন যে সমাজে আসলে কি হচ্ছে। একজন অসহায় মানুষ আইনজীবীদের কাছে আসছেন অন্যজনের বিরুদ্ধে। এইভাবে সব সময় মানুষ আইনজীবীদের কাছে আসছে। তাই আইনজীবীদের দায়বদ্ধতা হচ্ছে এই সকল সমস্যাগুলোকে উদ্‌ঘাটন করে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে লড়া। শত অভাব, অবিচার দুর্নীতির মধ্যেও তরুণ আইনজীবীদের প্রতি আমার আহবান হচ্ছে নিজেকে পরিপূর্ণ একজন ভালো মানুষ রূপে পরিগণিত করা এবং আমি যতই এই অভাব, অবিচার, দুর্দশা দেখব নিজের ভিতরে যে চেতনাবোধ রয়েছে সেটাকে সবসময় ন্যায়ের পক্ষে রাখবো, আর কখনো কোনও ভাবে অন্যায়ের সাথে আপোষ নয় এটাও তাদের চেতনার অংশ হতে হবে। তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে, সমাজ এগিয়ে যাবে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের বিশেষ প্রতিনিধি প্রিন্স মাহমুদ আজিম