আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ

কোর্ট এখন বলছে- NO LICENCE, NO BAIL / NO PROPER PAPER, NO VEHICLE

আবদুল্লাহ আল মামুন :

কেন যেন মনে হয় আমাদের দেশটা Seasonal মৃত্যুর দেশে পরিণত হচ্ছে। “প্রথম আলো” প্রতিদিন একটা হিসাব দেয়। সকালে অফিসে গিয়ে আমি প্রথমেই ঐ কাউন্টিংটা দেখি। আগের দিনের সড়ক দূর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যাসহ একটা যোগ করা সংখ্যা থাকে তাতে। ৬৫০০/৬০০০। গত এক/দুই বছরে। সংখ্যাতাত্ত্বিক কেউ হয়তো বিদেশের উদাহরণ টেনে বলবেন এটা কিছুই নয়।

আমি শিউরে উঠি। আমার মত হয়তো আরো কেউ সংখ্যাটা দেখে থাকবেন। হয়তো সবারই একই অনুভূতি থাকে। যে নির্মম অবস্থার মধ্য দিয়ে আহতদের যেতে হয় তা শুধু ভুক্তভোগী বা তার আত্মীয় স্বজনরা জেনে থাকবেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। আবার থেমে যায়। আবার নতুন কোন ঘটনা হয়। এখন শুরু হয়েছে আগুন আতঙ্ক। সারাদেশে কোথায় কোথায় আগুন লেগেছে আর তাতে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে মিডিয়া সয়লাব। কিছুদিন আগে ছিলো সড়ক দূর্ঘটনায় ছাত্র আবরারের মৃত্যু নিয়ে তোলপাড়। এর আগে ছিলো ধর্ষণ। সারা দেশের ধর্ষণের খবরে সয়লাব মিডিয়া। সাথে হারকিউলিস, ক্রসফায়ার ইত্যাকার সব খবর। জনগণ খাচ্ছে। মিডিয়া খাওয়াচ্ছে। এর আগে কি ছিলো মনে করতে পারছি না। আপনি কি মনে করতে পারছেন?

এই দেশে এত ঘটনা ঘটে যে, নাগরিকের ব্রেইন খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা!! সামনে বর্ষা আসছে। এবার শুরু হবে লঞ্চ ডুবে, বজ্রপাতে, পাহাড় ধ্বসে মৃত্যুর খবর। আমরা গোগ্রাসে খবর গিলবো। আমরা সবাই খবর খাই। সামনের ঈদেও বাড়ি যাওয়ার পথে বা ফিরতে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাবে। হয়তো এই পোস্ট দেখে আপনাদেরও মনে পড়বে যদি আমি নিজেই খবর হয়ে যাই।

ঋতুগত এই মৃত্যুর ফাঁকে ফাঁকে সড়কে মৃত্যুর মিছিল চলছে, চলবে। সাথে হতাহতের সংখ্যা বাড়বে। হতভাগ্যের মিছিল কখনোই থামবে না। প্রাকৃতিক কারণে মৃত্যু ছাড়া এই সড়কে মৃত্যু যদি অন্য কোন দেশে হতো তবে হয়তো এটাকে “জাতীয় দূর্যোগ” ঘোষণা করা হতো। জাতি হিসেবে আমরা অপার্থিব ক্ষমতার অধিকারী। আমরা সব সয়ে যাই। ভুলে যাই যতক্ষণ না নিজেই শিকার হই।

গরু আর মানুষ চেনার যোগ্যতা থাকলে আমরা ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে দিই। দালাল ধরে ২/৩ হাজার টাকা বেশি দিলেই লাইসেন্স মিলে যায় হোক সেটা ভারী গাড়ি চালনার বা হাল্কা বাহন চালনার। আর ড্রাইভিং লাইসেন্স বা লাগবে কেন? যার ইচ্ছা সে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়ছে। লাইসেন্স ছাড়াই কিশোররা গাড়ি চালাচ্ছে। পরিবার চালাচ্ছে। পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে। আমরা সবাই সহানুভূতিশীল।

গাড়ির রকম আবার বিভিন্ন হয়ে গিয়েছে। এখন আপনি পথে নামলেই কাগজপত্র, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি পাবেন। যেমন- বান্দরবান সদর থেকে কেরানীহাট জনপ্রতি ৬০ টাকায় সিএনজিতে যাওয়া যায়। এই গাড়িগুলোর অধিকাংশের কোন কাগজপত্র নেই। রেজিস্ট্রেশন নেই। ড্রাইভারের কোন লাইসেন্স নেই। রুট পারমিট থাকারতো প্রশ্নই আসেনা। এছাড়াও রেইচা বাজারের আগ পর্যন্ত কেরানীহাট থেকে লোকাল সিএনজি পাওয়া যায়। মানুষ সময় এবং সহজে যাতায়াতের জন্য এগুলো ব্যবহার করছে। এটা মানুষের প্রয়োজন। রাস্তায় চললে তাতে মানুষ চড়বেই। এই সড়কটা চট্টগ্রাম,কক্সবাজারের সাথে যোগাযোগের জন্য মহাসড়ক। কিছুদিন আগে আদেশ জারী হয়েছিলো নসিমন, করিমন, ভটভটি, টুকটুকি মহাসড়কে চলবে না। তাহলে প্রশ্ন হলো কিভাবে এবং কেন মহাসড়কে তিন চাকার বাহন চলছে? প্রশ্নটা করেছিলাম পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তাকে। তার সহজ উত্তর ছিলো- ভাই, আপনারা বই আর আইনের মধ্যে বাস করেন। বাস্তবতা জানেন না। এই গাড়িগুলো বন্ধ হলে যে বিক্ষোভ, আন্দোলন হবে তা আপনারা থামাতে পারবেন?? উনি আরো কিছু বলার আগে আমি থেমে গেলাম। এর চেয়ে সহজ উত্তর আর কি হতে পারে??

বান্দরবান শহরের অলিতে গলিতে ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা চলছে। আপনার এলাকায়ও নিশ্চয় চলছে। এগুলো, আবার বিদ্যমান মোটরযান আইন অনুযায়ী “মোটরযান” নয়। আসন্ন মোটরযান আইনে এগুলোর কি স্বীকৃতি তা জানি না। এখন মোটরযান আইনে না পড়লে এগুলো যারা চালাচ্ছে সে ড্রাইভারের কি লাইসেন্স দরকার?? এগুলো যথেষ্ট গতিময়তার সাথে চলে।এগুলো পর্যটকসহ স্থানীয় অধিবাসীদের কাজে লাগছে। মোটরযান আইনেই যদি না চলে তবে এগুলো রাস্তায় চলছে এবং যাত্রী বহন করছে কি করে? কি ভাবে এগুলো দেশে আসলো? কারা আনলো? কারা এগুলো রাস্তায় চলতে দিচ্ছে?? পুলিশ কর্মকর্তা ভাইয়ের উত্তর স্মরণ করে নিশ্চুপ থাকাই উত্তম। সিএনজি, অটোগুলো একটা সমিতি করে নেয়। সম্ভবত সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকরা অনেক বেশি ক্ষমতাবান হবেন। আইনে না থাকলেও মানুষের প্রয়োজনের উপরে যেহেতু আইন নেই তাই কোন কথাও নেই। মানুষ ড্রাইভিং লাইসেন্স নেবে কেন যদি এটা ছাড়াই গাড়ি চালানো যায়? লাইসেন্সিং অথরিটির গ্যাড়াকলে সে কেন পড়বে??

সম্ভবত গত পরশু মহামান্য হাই কোর্টের একটি মাননীয় বেঞ্চ জানতে চেয়েছেন বাংলাদেশে কত গাড়ি কাগজপত্র ছাড়া চলে?? বান্দরবানে বা তিন পার্বত্য জেলায় চান্দের গাড়ি নামে একটা বাহন আছে। এই গাড়ির কোন কাগজপত্র নেই। এগুলো প্রায় সবই সেনাবাহিনী বা সরকার থেকে নীলামে কেনা। মালিক কেনার পরে বডি বা ইঞ্জিন পাল্টে নেয়। এগুলো ঐ সিএনজি, টুকটুকির মতোই সরকারের খাতায় নেই।এগুলোর জন্য সরকার কোন টাকা পায় না। এদের ফি বৎসর কাগজপত্র নবায়নের কোন প্রয়োজন নেই। এগুলো কেন চলছে? কারণ প্রয়োজন। বাহনের অপ্রতুলতা। ইলেকশনের সময় এগুলো ইলেকশন ম্যাটেরিয়াল, কর্মী, পুলিশ বহনের এবং টহল দেওয়ার জন্য এবং অন্য সময় যাত্রী পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। বান্দরবানে এমন অনেক জায়গা আছে যেগুলোতে এগুলো ছাড়া যাওয়া যায় না। পর্যটকরাও হাওয়া খেতে এগুলোই বেশি ভাড়া করেন। এগুলোতে একসাথে ১২ জন উঠতে পারেন। সাশ্রয়ী ও বটে?? কেন চলছে? কারণ বিকল্প নেই। লাইসেন্স?? দরকার আছে কি??

এটা খুব সামান্য চিত্র। আগামী যুগটা সম্ভবত বিদ্যুতের। বিদ্যুৎ চালিত অনেক কিছুই আসছে। আমরা পড়ে আছি আগের আইনে। কারা আইন সংশোধন করবে?? আদৌ কি কখনো আইন দিয়ে এটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব? আইনের ছাত্র হিসেবে আমি অবশ্যই বলবো কেন নয়? তার আগ পর্যন্ত সবার চোখের সামনে দিয়ে এগুলো চলবে। কিছু পরিবারের অন্ন জুটবে। সেই অন্নের দাহন হয়ে কোন এক পরিবারে মৃত্যুর হাহাকার উঠবে। অন্নদাতা বা পরিবারের সদস্যরা পরপারে যেতেই থাকবে। প্রত্যেকটি ক্রিয়ার একটি সমান এবং বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে। একদিকে অন্ন জুটলে অন্য দিকে অন্ন বন্ধ হবে। একজনের পকেটে টাকা ঢুকলে অন্য দিকে খালি হবে। যত অবৈধ গাড়ি, ড্রাইভার বাড়বে সড়কে মৃত্যুর মিছিল আরো বাড়বে। যতক্ষণ উপযুক্ত বাহন না দেবেন, মানুষ তার অপশন বেছে নেবে।

আশার কথা হলো মিশুক-মুনিরের মৃত্যুর মামলায় কোর্ট যাবজ্জীবন দিয়েছেন সম্ভবত। কিন্তু যারা অবৈধ বাহন, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাচ্ছে তাদের কি হচ্ছে? মামলা হচ্ছে এবং তা জামিনযোগ্য ধারায়। কোর্ট এখন বলছে- NO LICENCE, NO BAIL.অথবা- NO PROPER PAPER, NO VEHICLE.

ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালনা এবং মৃত্যু ঘটানো হত্যাকান্ড বলে বিবেচিত হচ্ছে। থানা মামলা নিচ্ছে বা নিতে বাধ্য হচ্ছে। বৈধ কাগজপত্র ছাড়া গাড়িগুলোকে আদালত জিম্মায় দিচ্ছে না। কারণ সরকারি খাতায় যে গাড়ি নেই সে গাড়ি রাস্তায় চলতে পারে না। এরা তখনই ঝামেলায় পড়ছে গাড়ি যখন accident করছে বা মাদক নিয়ে ধরা পড়ছে। এখন প্রশ্ন হলো- অন্য অবস্থায় তাহলে চলছে কি করে?? সবদিকেই ব্যবসা। ধান্ধাময় সড়ক ব্যবস্থা। হাইকোর্ট বিভাগ বেশ কয়েকটি মামলায় ক্ষতিপূরণের আদেশ দিয়েছেন পরিবহনের মালিককে। এতে হয়তো কিছুটা টনক নড়বে। সবাই কি হাইকোর্টে যেতে পারে? যদি হাইকোর্টের কোন আইনজীবীর নজরে না পড়ে তখন?

আইন, আইন এবং শুধুমাত্র আইনই পারে এই মৃত্যুর, হতাহতের মিছিল থামাতে। একটা সকাল আশা করি যখন প্রথম আলো হাতে নিয়ে অন্য কোন চটুল, মজার খবর পড়বো। আড়চোখে মৃত্যুর এই ভয়ংকর কাউন্টডাউন দেখতে হবে না। একটা দিন বাংলাদেশের কাটুক সড়কে মৃত্যুর খবর ব্যতীত। একটা দিন সরকার, সড়কের সাথে জড়িত সবাই জেগে উঠে বলুক ” এটা জাতীয় বিপর্যয়। আসুন আমরা সবাই হাতে হাত ধরি। এই মৃত্যু থামাতে হবে।”

যে ভয়ংকর অব্যবস্থাপনা চলছে সড়কে তা থামুক। আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ হোক।

বিজ্ঞ বিচারকরা অনুসরণ করুক – NO LICENCE, NO BAIL. অথবা- NO PROPER PAPERS, NO VEHICLE. পুলিশ, বিআরটিএ সব অবৈধ গাড়ি ধরুক। আদালত সাজা দিয়ে লাইসেন্সে লিখে দিক- তোমাকে স্থায়ী ভাবে বা এত দিনের জন্য লাইসেন্স থেকে বঞ্চিত করা হলো। যে গাড়ি সরকার অনুমোদন দেয়নি সে গাড়ির আমদানি নিষিদ্ধ করা হোক। জব্দ করা হোক। গণপরিবহন আরো বাড়ানো হোক। যাতে মানুষ এই সব অবৈধ বাহনে না চড়েন। গ্রামে গঞ্জে চলমান সিএনজি গুলোকে অনুমোদন দেওয়া হোক। থানা, নেতা ম্যানেজ করে ওদের যেন চলতে না হয়।

Seasonal মৃত্যুর দেশে সড়কের মহামারী কি কারো নজরে পড়বে? কোন কবি যেন লিখেছিলেন- এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়। কে লিখেছিলো?? কবি নবারুণ ভট্টাচার্য। সড়কের মহামারি প্রতিরোধেও সংশ্লিষ্টদের বোধ জাগ্রত হোক নব অরুণের মত।

লেখক : অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান পার্বত্য জেলা