ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম

অর্থাভাবে ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে টিউশনি করে পড়াশুনার খরচ চালিয়ে আজ ব্যারিস্টার হালিম

আমার শৈশবটা কেটেছে অত্যন্ত কষ্টকর পরিবেশে। কেননা অতি দরিদ্র পরিবার থেকে আমার উঠে আসা। যে পরিবারে শিশু বয়স থেকেই সন্তানদের উপার্জন করে সংসার ও বাবা-মাকে চালাতে হয়। এমন একটি পরিবার থেকে উঠে আসায়, আমি পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়েও বাবা মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বড় বোনের স্বামীর সাহায্যে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতে হয়েছিল। কিন্তু আমার পড়াশুনার খরচ ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকেই টিউশনি করে আমাকে নির্বাহ করতে হয়” -বহু আইনগ্রন্থের রচয়িতা ও শিশু অধিকার কর্মী ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের বিশেষ প্রতিনিধি প্রিন্স মাহামুদ আজিমের সাথে একান্ত আলাপনে এভাবেই তার জীবন সংগ্রামের কথা, প্রকট কষ্টকর পরিবেশের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠার কথা তুলে ধরেন। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের পাঠকদের জন্য বিশেষ এই সাক্ষাৎকারের ‘প্রথম পর্ব’ তুলে ধরা হল ।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : শুনেছি অত্যন্ত সংগ্রামমুখর আপনার জীবন। শৈশব, কৈশোর পার করে ধাপে ধাপে আজ এই পর্যন্ত। ফেলে আসা পথের গল্পটি একটু শুনতে চাই…

ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম : বাগেরহাট জেলার শরণখোলার বগি গ্রামে আমার জন্ম। আমার বাবা একজন বাওয়ালী ছিলেন অর্থাৎ তিনি কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করতেন। স্থানীয় ফরেস্ট অফিস থেকে অনুমতি নিয়ে সুন্দরবন থেকে নৌকার মাধ্যমে কাঠ কেটে এনে পাইকারি দরে বিক্রি করতেন । এটাই ছিল মূলত আমার বাবার পেশা। আমরা পাঁচ ভাই তিন বোন। আমি বগি প্রাইমারী স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পাই এবং পুরো উপজেলায় আমি প্রথম স্থান অধিকার করি। এরপর রাইন্দা ফাইলট হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। এর মাঝে আমি নিজ উদ্যোগে চলে যাই মটবাড়িয়া কে এম লতিফ ইন্সিটিউটে পড়াশুনা করার জন্য। কারন আমার পড়াশুনায় প্রতিযোগিতা ভাল লাগতো। মটবাড়িয়া কে এম লতিফ ইন্সিটিউটে আমি সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হই। সেখান থেকে আমি অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাই। তারপর নানা ঘটনাক্রমে নবম শ্রেণীতে আমি চলে আসি যশোর টাউন স্কুলে। সেখানে আমি এক বছর পড়াশুনা করি । সেখান থেকে আবারো মটবাড়িয়ায় ফিরে আসি। মটবাড়িয়ার প্রয়াত দলু চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে ছিদ্দিকুর রহমান ভাইয়ের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ। কেননা তিনি আমার শিক্ষাজীবনে থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে বইপত্র সহ আর্থিক দিক দিয়েও আমাকে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করেছেন। ছিদ্দিকুর রহমান ভাই আমার জীবনে ধ্রুব তারার মতো।

আমার প্রাইমারী স্কুলে ভালো পড়াশুনা ও ভালো ফলাফল করার একমাত্র প্রধান উৎস ছিল আমাদের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক রুস্তম আলী খান। তার একটা সুন্দর বৈশিষ্ট্য ছিল ক্লাসে পাঠদানের সময় সফল ব্যক্তিদের জীবনী নিয়ে আলোচনা করতেন। যা আমাকে দারুনভাবে অনুপ্রাণিত করতো এবং এই সকল গল্প শুনে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, যেভাবেই হোক আমাকে পড়াশুনায় ভাল করতেই হবে। তারপর আমি কে এম লতিফ ইন্সটিটিউট থেকে এসএসসি পরিক্ষা দিয়ে স্টার মার্ক অর্জন করি। এরপরে আমি ঢাকা কলেজে ভর্তি হই এবং ঢাকা কলেজের হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা আরম্ভ করি।

১৯৮৮ সালে ঢাকা বিভাগে আমি মেধা তালিকায় এইচএসসিতে ৩য় স্থান অধিকার করি। ঢাকা কলেজে থাকাকালীন সময়ে আমাকে সর্বাধিক সহযোগিতা করেছেন ঢাকা ম্যাজিস্টেট কোর্টের বরগুনার আলী আহম্মদ নামক এক ব্যক্তি। যিনি পেশায় ঢাকা ম্যাজিস্টেট কোর্টের একজন সামান্য করণিক হিসাবে কাজ করতেন। আমার দুঃসময়ে ওনার বাসায় থাকার জায়গা দিয়েছেন এবং ঐ সময় আমি আমার ছোট দুই ভাই জামাল এবং হাবীবকে ঢাকায় নিয়ে আসি। কারণ আমার মধ্যে একটা চেতনা কাজ করতো। আমি যেহেতু ভালো ফলাফল করছি, আমার ছোট দুই ভাইকে যদি ভালো পরিবেশ দিতে পারি ওরাও ভালো করবে। এইক্ষেত্রে আমার সাথে সাথে আমার ছোট দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নিলেন ঢাকা ম্যাজিস্টেট কোর্টের করনিক আলী আহম্মদ ভাই। সর্বসাকুল্যে আমার জীবনে এতদূর আসার পিছনে মটবাড়িয়ার ছিদ্দিকুর রহমান ভাই, আলী আহম্মদ ভাইয়ের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না।

ঢাকা কলেজ থেকে আমি ঢাকা বিভাগের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকে তৃতীয় স্থান অধিকার করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ তম অধিকার করে আইন বিষয়ে ভর্তি হই। মহসিন হলে থেকে আমি আইন বিষয়ে পড়াশুনা করি এবং একই সাথে আমার ছোট দুই ভাইকে মহসিন হলে রেখে একজনকে ধানমন্ডি বয়েজ ও অপরজনকে গভঃ ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে ভর্তি করি। তৎকালীন সময়ে ভর্তি প্রক্রিয়া এতোটা কঠিন ছিল না। পরবর্তীতে আমার ছোট দুই ভাই ঢাকা কলেজ তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা সম্পন্ন করে। বর্তমানে আমার এক ভাই জনতা ব্যাংকের উদ্ধতন কর্মকর্তা ও অপরজন বিএডব্লিওটি এর কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত রয়েছেন। তাই আমি অনেকটাই ধন্য যে একমাত্র পড়াশুনার কারনে তারা এতো ভালো পর্যায়ে আসতে পেরেছে। পড়াশুনা না করলে তারা সেটা কখনই পারতো না। আমার অনাকাঙ্ক্ষিত অসুস্থতা ও ইয়ার লস যাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এল.এল.বি তে ফাস্ট ক্লাস পাই নাই কিন্তু মাস্টার্সে আমি প্রথম স্থান অধিকার লাভ করি।

তারপর আমি ব্যারিস্টার মওদুদ সাহেবের জুনিয়র হিসাবে প্রথম আইন পেশায় পদার্পণ করি। ঠিক তখন আমি ব্রিটিশ সেভেনিং স্কলারশিপের জন্য আবেদন করি এবং ভাইভা দেওয়ার মাধ্যমে স্কলারশিপ পাই। ব্রিটিশ সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসেল আপন টাইনে আমি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ল এর উপর পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যাই এবং এই স্কলারশিপ নিয়ে আমি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ল এর উপর এল.এল.এম সম্পন্ন করি। লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে আমি দ্বিতীয় বার এল.এল.বি সম্পন্ন করি। তারপর লিংকনস ইন থেকে বার-অ্যাট-ল শেষ করে আমি ঢাকায় ফিরে এসে বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়ন কমিটির মধ্যে অন্যতম একজন সদস্য ব্যারিস্টার আমিনুল ইসলামের সাথে প্র্যাকটিস আরম্ভ করি। তিনি এখনো অনেক স্বনামধন্য বিখ্যাত সিনিয়র আইনজীবী হিসাবে সুপরিচিত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে। ২০০৯-১০ সালে আমি নিজস্ব চেম্বার করে আইন পেশায় একক ভাবে প্র্যাকটিস শুরু করি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আইন পড়ার আগ্রহ নিজ থেকেই ছিল, নাকি সেখানে কোন গল্প লুকিয়ে আছে?

ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম : শিক্ষা জীবনে আইন পড়ার আমার কোন ইচ্ছা ছিল না বরং উচ্চ মাধ্যমিক থেকেই সাহিত্যের উপর পড়াশুনা করার অদম্য ইচ্ছা ছিল। অবসর সময় পেলেই আমি বইয়ের জগতে ডুবে থাকতাম। আমি ইংল্যান্ডে না গেলে জ্ঞানের বিকাশ যে কত দ্রুত ও সহজে হতে পারে, সেটা আমি বুঝতে পারতাম না। ইংল্যান্ডের প্রতিটি লাইব্রেরী শুধু লাইব্রেরী হিসাবে নয় বরং সকল সামাজিক কর্মকাণ্ডের সোর্স হিসাবে কাজ করে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ১১ তম মেধাতালিকায় উর্ত্তিন্ন হওয়ার পর যখন ইন্টারভিউ দিতে যাই তখন ইন্টারভিউ বোর্ডে একজন শিক্ষক জানতে চান, আমি কোন বিষয়ে পড়তে আগ্রহী। আমি সাহিত্যে পড়াশুনা করার আগ্রহ প্রকাশ করি। তখন শিক্ষক আমাকে বলেন, সাহিত্য পড়া ভালো কিন্তু তুমি সাহিত্যে পড়ে কি চাকুরি করবে? তার চেয়ে ভালো তুমি আইন নিয়ে পড়াশুনা করো। তোমার রেজাল্ট ভালো এবং তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি আইন বিভাগে ভালো করবে। এতে করে তুমি ভবিষ্যতে যেমন আইনজীবী হতে পারবে পাশাপাশি সমাজসেবাও করতে পারবে। তখন আমি ইন্টারভিউ বোর্ডের শিক্ষকের কথা শুনে আইন বিভাগে পড়ার আগ্রহ পোষণ করি। তারপর আমি আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে পড়াশুনা আরম্ভ করি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব : আপনি শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করছেন অনেক দিন ধরে; শিশুদের পক্ষে উচ্চ আদালতে লড়ছেন, আবার তাদের শিক্ষা নিয়েও কাজ করছেন। এর পেছনে বিশেষ কোন কারণ আছে কি?

ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম : আমার শৈশবটা কেটেছে অত্যন্ত কষ্টকর পরিবেশে। কেননা অতি দরিদ্র পরিবার থেকে আমার উঠে আসা। যে পরিবারে শিশু বয়সে উপার্জন করে সংসার ও মা বাবাকে চালাতে হয়। এমন একটি পরিবার থেকে উঠে আসায় আমি পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার পরও বাবা মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বড় বোনের স্বামীর সাহায্যে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। কিন্তু আমার পড়াশুনার সমস্ত খরচ ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে টিউশনি করে আমাকেই জোগাড় করতে হতো। আমাকে গাইডলাইন দেওয়ার মতো কেউ ছিল না তাই আমি নিজ ইচ্ছায় যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছি সেখানে পড়াশুনা করেছি। এই শিশু বয়সে অন্যের ছেলেমেয়েকে পড়িয়ে নিজের শিক্ষার জন্য টাকা পয়সা উপার্জন করা এটা যে কতটা কষ্টকর আমি একজন ভুক্তভোগী হিসাবে বুঝতে পারি। আমি শিশুদের জন্য কাজ করার অন্যতম কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশে অসংখ্য মেধা অচিরেই ঝরে যায় পঞ্চম শ্রেণী পাসের পর। যেদিকে আমাদের খেয়াল থাকেনা। অথচ শিশুদের মধ্যে মেধা বিকশিত হয় পঞ্চম শ্রেণীর পর থেকে মাধ্যমিক এর গণ্ডির মধ্যে। এই সময়টায় যদি এই সকল মেধাগুলোকে লালন করা যায় তবে তাহলে প্রতিটি শিক্ষার্থী অনেক বড় মানুষ হয়ে উঠতে পারে। এই চেতনাবোধ থেকে আমি ২০০৪ সালে চিল্ড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন(সিসিবি) প্রতিষ্ঠা করি।

(চলবে…)