কাজী শরীফ:
বাংলাদেশের অধিকাংশ মা বাবাই সন্তান জন্মের পর চিন্তা করে তার সন্তান ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। স্বপ্ন দেখায় এক প্রকার আনন্দ আছে। আনন্দই যেহেতু আছে এবং স্বপ্ন দেখতে বাড়তি কোন ঝক্কিও পোহাতে হয়না সেহেতু বড় স্বপ্নতো দেখাই যায়। আমার মত অভাজনের মা বাবাও এমন স্বপ্ন দেখতো । আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর আবদুল্লাহ আবু সায়িদ স্যার একটা কথা তাঁর প্রায় প্রতিটি বক্তব্যেই বলেন- “মানুষের জীবন তার আশার সমান বড়।”
নন্দিত অভিনেতা ও বিজ্ঞাপননির্মাতা আফজাল হোসেন ডাচ বাংলা ব্যাঙ্কের একটি বিজ্ঞাপনে বলেন –“মানুষ বাঁচে আশায় দেশ বাঁচে ভালোবাসায়।” আমাদের মা বাবারা আসলে প্রকৌশলী হওয়ার চেয়েও সন্তানদের সন্দেহাতীতভাবে চিকিৎসক হিসেবে দেখতে বেশি পছন্দ করেন । আমার মা বাবার ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি । মানের দিক থেকে এ পেশাটির চেয়ে হয়তো অন্য অনেক পেশাই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তবে তৃপ্তির দিক থেকে এ পেশাটি অনন্য ।
জীবন বাঁচানো কিংবা রক্ষা করার পুরো ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার আছে বলেই আমার মত আস্তিক বিশ্বাস করে। আমি এও বিশ্বাস করি তিনি চাইলে যেকোনো ব্যক্তিকে সুস্থতা কিংবা অসুস্থতা দান করতে পারেন। পৃথিবীতে দুটো পেশাই জীবন মৃত্যুর বিষয়ে সরাসরি স্রষ্টার প্রতিনিধিত্ব করে। প্রথমটি চিকিৎসা দ্বিতীয়টি আইন পেশা। আইনজীবীরা নানা কারণে নন্দিত আবার নিন্দিতও । আইনজীবীদের কারণে অপরাধী শাস্তি পায় কিংবা নিরপরাধ ব্যক্তি বেঁচেও যায়। কিন্তু আইনের কার্যক্রম ধীরগতির বলে ও ঘটনা পরম্পরায় অনুমেয় বলে দু একটি ক্ষেত্র ছাড়া তিরস্কৃত কিংবা পুরস্কৃত ব্যক্তি আগেই ফল আঁচ করতে পারে। নিম্ন আদালতের রায়ে সংক্ষুব্ধ হলেও উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকে।
কিন্তু একজন ব্যক্তি তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তের একটিতেই একজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। এক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের মত উচ্চ ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সুযোগ সবসময় হয়না। রোগীর জীবনের সে ক্রান্তিলগ্নে একজন ডাক্তার কী মহৎ ভুমিকা পালন করতে পারেন তা ভাষায় বর্ণনাতীত! আকস্মিক সড়ক দুর্ঘটনা কিংবা রাত বিরাতে লেবার পেইন অথবা হার্ট অ্যাটাকের রোগী নিয়ে আপনি, আমি যখন হাসপাতালে যাই তখন একজন ডাক্তার হয়ে উঠেন আমাদের সবচেয়ে আপনজন ।
রাত বিরাতে পুলিশ যদি আপনাকে বা আমাকে ধরেও নিয়ে যায় পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে আপনার বা আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে। কিন্তু কখনও কখনও একজন ডাক্তার এমন সময়েও রোগী পান যখন থেকে ২৪ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা না দিলে রোগী ইহলোক ছাড়বেন এ ব্যপারে ডাক্তার থাকেন নিঃসন্দেহ ! তখন একজন ডাক্তার হয়ে উঠেন সাক্ষাৎ আল্লাহর প্রতিনিধি।
এমন দুঃসময়ের বন্ধুর প্রতি আমাদের আচরণ অনেকক্ষেত্রেই আশাব্যঞ্জক নয়। আমি জানি আপনি বলবেন ডাক্তারেরা মাঝে মাঝে কসাই হয়ে যান । আমরা ভুলে যাই সেটা মাঝে মাঝে! আমরা ধরে নিই সবসময়ই এমন হয়।
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত যে রক্তাক্ত রোগী দেখলেই আপনার বা আমার মত অনেক দুর্বল হৃদয়ের মানুষের মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয় সে রোগীকেই সুস্থ করতে ডাক্তারদের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে আমি অন্তত দেখেছি। বছর কয়েক আগে এদেশে ৯২ দিনের অবরোধ তাণ্ডবে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ রোগীদের জন্য ডাক্তার সামন্ত লাল সেন ও তাঁর সহযোগীরা যে অবদান রেখেছে তা কি আমরা ভুলে যাবো ?
রাতের পর রাত জেগে যেভাবে এ পোড়া মানুষগুলোর ক্ষত নিয়ে কাজ করেছেন তাই আমরা মনে রাখিনা। এই ডাক্তারই যদি কোনদিন আপনি বা আমি কর্তৃক লাঞ্ছিত হয় তবে দেহের ক্ষত হয়তো মুছবে কিন্তু ডাক্তারের হৃদয়ের ক্ষত মুছবেনা কোনদিনও ।
আপনি বা আমি বলি ডাক্তাররা মাঝে মাঝেই সেবা দানে খামখেয়ালিপনা দেখায়। আমি স্বীকার করছি এটা হয়। কিন্তু সবাই তা করেনা। আর বাংলাদেশের এমন কোন পেশা কি আছে যেখানে শতভাগ লোক শতভাগ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ?
অনেক আইনজীবী কোন কোন মামলা দশ বছর পরিচালনা করেও অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড ঠেকাতে পারেন না , আমরা কজন আইনজীবীর উপর মক্কেলকে হামলে পড়তে দেখি? কত পুলিশই তো কত নিরপরাধ ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যায়। বহুদিন পর প্রমাণিত হয় তিনি নির্দোষ! আমরা ক’জন পুলিশের উপর জনতার হামলা দেখেছি? বুকে হাত দিয়ে বললে তা দেখিনা বললেই চলে!
আমি ডাক্তারদের পক্ষে সাফাই গাইছি বিষয়টা তেমন নয়। উনাদের ভুল নেই তাও নয়। কিন্তু আমরা লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিচ্ছি কিনা তাও ভাববার বিষয় !
রাসঙ্গিকভাবে মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ সুরাইয়ার কথা বলতে পারি। নোংরা রাজনীতির শিকার মেয়েটি ও তার মায়ের জন্য উদ্বিগ্ন ছিল সারা বাংলাদেশ। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি। কিন্তু মা মেয়েকে নিয়ে টানা ২৫ দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন ডাক্তার কানিজ ও তাঁর দল। ২৫ দিন পর যখন সুস্থ অবস্থায় ডাক্তার কানিজ সুরাইয়াকে তার মায়ের কোলে তুলে দিয়েছেন তখন টেলিভিশনের পর্দায় আমি বা আমরা ডাক্তার আপার মুখে যে হাসি দেখেছি তাতে আমার বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল সন্তানের আসল মা কে?এই যে ডাক্তার কানিজ আমার চোখে সন্তানের মায়ের মত হয়ে উঠেছেন এ ক্ষমতা পৃথিবীর আর কোন পেশার মানুষের আছে বলতে পারেন?
বেশ কিছুদিন আগে প্রথম আলোতে পড়েছিলাম পরিচয়বিহীন জন্মের সময় ত্রুটিযুক্ত একটি বাচ্চাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বারান্দায় পেয়ে ডাক্তার তাহমিনার অপারেশন করার কথা,সেবিকাদের সেবা দেয়ার কথা। হাজার বার কসাই বলছেন যে ডাক্তারদের তারাই আপনার আমার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যে কষ্ট করে যাচ্ছেন তা কি আমরা এত সহজেই ভুলে যাবো ?
একজন বিচারক, আইনজীবী , পুলিশ, সরকারী কর্মকর্তা বা শিক্ষক ভুল করলে বা ভুল পড়ালে যদি তিনি মানুষ বলে বেঁচে যান ( মানুষ মাত্রই ভুল এ যুক্তিতে) তবে একজন ডাক্তার কেন সে হিসেবের বাইরে থাকবে? তবে কি তিনি মানুষ নন? যে রোগীর স্বজন রোগী সুস্থ হলে ডাক্তারের হাত ধরে বলেন ডাক্তার স্যার/ আপা , আপনি ফেরেশতা তিনিই আবার তাঁর গায়ে পর্যন্ত হাত তুলে ফেলেন হয়ত ঠিক পরের দিনই ।
আমার বন্ধু আবির ভাই, ফয়সাল, নাজমুস সালেহ ও সদ্য পরিচয় হওয়া মুকিত ওসমান আমার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরও বন্ধু। এ লেখা তাঁরা পড়বেন কিনা জানিনা।কিন্তু আমরা অসুস্থ হলেই কিংবা পরিবারের কেউ অসুস্থ হলেই রাত বিরাতে তাঁদের পরামর্শ নিই।
বলতে পারেন আর কোন পেশার মানুষকে এভাবে সময়ে অসময়ে মানুষের সেবা দিতে হয়?আমার বন্ধু ফয়সালকে একবার বন্ধু সেতু গভীর রাতে ওর ছোট চাচাতো ভাইয়ের অসুস্থতার জন্য ফোন দিতে হয়। ফয়সাল ফোন ধরেই বলে কিরে কার অসুখ ? কী অসুখ? সেতু পরের দিন দোকানে ওকে জিজ্ঞেস করে – বুঝলি ক্যামনে ? উত্তরে ও বলল ডাক্তাররা বুঝে একজন মানুষ কেন ডাক্তারকে ফোন করে ? আমি আনন্দ পেয়েছিলাম আমার ডাক্তার বন্ধুর উত্তরে। আবির ভাইকে আমার নানা প্রয়োজনে ফোন করেও বিরক্ত করেছি ও করে যাচ্ছি। শুধু আমি নই এমন একজনও কি আছেন যিনি ডাক্তারের শরণাপন্ন হননি ?
একজন নিঃসন্তান দম্পতি সন্তানের মা বাবা হতে পারলে একজন ডাক্তারের কাছে যেভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তি জীবন ফিরে পেলে যে আনন্দ প্রকাশ করে করে তাতে মনে হয় ঐ ডাক্তারের মাঝে তিনি স্রষ্টাকে খুঁজে পেয়ছেন।
একজন ডাক্তার মানুষের ভালোবাসায় অনন্য। এ ভালোবাসার মর্যাদা দেয়ার দায়িত্ব একজন ডাক্তারেরই । তাঁর অবহেলায়, টাকার প্রতি লোভে একজন সন্তান তার মাকে হারাক, একজন পিতা তার সন্তানসম্ভবা কন্যাকে হারাক এটা নিশ্চয়ই তিনি চাইবেন না। অর্থ আপনি উপার্জন করতে পারেনই কিন্তু কসাই বলে ডাক শুনতে দায়ী হবেন কেন? রাতের পর রাত জেগে আপনি পড়াশুনা করে ডাক্তার হয়েছেন বলে এ গরীব দেশের মানুষ এখনও সুস্থভাবে বেঁচে আছে। এ আনন্দটুকু কী পর্যাপ্ত নয়!
আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে ডাক্তারদের একটা সমালোচনা করতে চাই। এ সমালোচনার জেরে ফোনে রাতে বিরাতে আবির ভাইদের সেবা বন্ধ হয়ে যেতে পারে এ আশংকা মাথায় রেখেও বলছি আমার মনে হয় ডাক্তার ভাইবোনেরা আত্নসমালোচনা সহ্য করার বেলায় খাঁটি বাঙ্গালি হয়ে যান। বাঙ্গালি সমালোচনা সহ্য করতে পারেনা বলে যে চিরন্তন অভিযোগ আছে আপনারাও তার বাইরে নন। একটা পরিবারে দুইজন ছেলে থাকলে যে সফল সমাজ তার প্রতিই বেশি আবদার করে। যে ছেলে উচ্ছন্নে গেছে সে মা বাবাকে খাওয়াতে না পারলে সমাজ তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায় না, যে পরিশ্রম করে লেখাপড়া করেছে সে মা বাবাকে না দেখলে সমাজ জেগে উঠে। আপনারা লেখাপড়া করা ভালো সন্তান। আপনারা রেগে গেলে আমরা কোথায় যাবো বলেন! আর একটা কথা মানুষ মাত্রই ভুল করে। মানুষ মাত্রই কেউ কেউ অন্যায় করে, অনৈতিক আচরণ করে। আপনাদের মধ্যে যে চুমু দিয়ে ব্রণ পরীক্ষা করে, যে টাকার আশায় অপ্রয়োজনে টেস্ট দেয়, যে ডাক্তার কোন রোগীর সাথে অমানবিক আচরণ করে তাকে অন্যায্য সমর্থন দেয়ার দরকার কী! একজন শিক্ষক অনৈতিক হলে কী সব শিক্ষক তাকে সমর্থন করে? করেনা। যার পাপ তার। আপনি শুধু একই পেশার বলে তাকে সমর্থন দিয়ে নিজেও সে অন্যায়ের ভাগিদার কেনো হবেন?
আমি কদরের রাতে ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে যাই। রাত সাড়ে চারটায় হাসপাতালে যেতে হয়। আগ্রাবাদ মা, শিশু ও জেনারেল হাসপাতালে মাত্র ১০০ টাকা টিকেট কেটে যে সেবা পেয়েছি তা অকল্পনীয়। যে দেশে ১০০ টাকা দিয়ে একবেলা ভাত খাওয়া যায়না সেদেশে ১০০ টাকায় যে সেবা একটা হাসপাতাল ও একজন চিকিৎসক দিয়েছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কোন শব্দই যথেষ্ট নয়। আপনাদের ভালোবাসি বলে প্রত্যাশা বেশি। আপনাদের প্রতি আমাদের অনেকের নিষ্ঠুর আচরণের জন্য দু:খিত।
এদেশের মুক্তিযুদ্ধে ডাক্তারদের যে অবদান তা ইতিহাস সেভাবে কী মূল্যায়ন করে? আমার ছোটবোনের নাকের সমস্যার জন্য ডাক্তার ললিত কুমার দত্ত স্যারের কাছে গিয়েছিলাম। স্যারের রুমে দেখি মুক্তিযুদ্ধে রোগীদের শুশ্রুষা করার জন্য তাকে আগরতলা সরকার সম্মাননা দিয়েছে। সে সম্মানসূচক পত্রটি তিনি বাঁধাই করে রেখেছেন! আমরা কী আগরতলায় রাতের পর রাত জেগে যারা ৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছিলেন তাদের সেভাবে স্বীকৃতি দিতে পেরেছি?
বাংলাদেশের জন্মলগ্নে যে পেশার মানুষের এত অবদান তাদের প্রতি আমাদের প্রদর্শিত সম্মান কি পর্যাপ্ত? নিজেকেই প্রশ্ন করুন। আসুন আমরা ডাক্তারদের সমালোচনা করার আগে তাঁর শ্রম , মেধা, ত্যাগ বিবেচনা করি। আর একজন চিকিৎসকও সচেতন থাকা উচিত তাঁর কারণে যেন কাঁদতে না হয় একজন সাধারণ হত দরিদ্র মানুষকে,তাঁর নিম্ন মনোভাবের কারণে যেন বিতর্কিত না হন ডাক্তার কানিজ, ডাক্তার তাহমিনা , ডাক্তার এম আর খান, ডাক্তার প্রাণ গোপাল দত্ত, ডাক্তার সামন্ত লাল সেন, ডাক্তার অরুপ রতন চৌধুরী কিংবা ডাক্তার ইব্রাহীমের মত মানুষেরা !
লেখক : সহকারী জজ, নোয়াখালী।