অস্থির সময়-অস্থির বিশ্ব : চাই মানবিকতার বিশ্বায়ন

[ড. তুরিন আফরোজ, এফ এম শাহীন, বাণী ইয়াসমিন হাসি, ফারাবী বিন জহির অনিন্দ্য, রবিউল ইসলাম রূপম, মুনতাহা বিনতে নূর, খায়ের মাহমুদ, জয়নাব বিনতে হোসেন, ড. বদরুল হাসান কচি, সাবিরা ইসলাম, মামুন রশীদ, অর্ণব দেবনাথ, বাপ্পাদিত্য বসু]

 

এক ভয়ঙ্কর উদ্বেগ-অশান্তি চলছে দুনিয়াজুড়েই। মানবিক এক পৃথিবীর বদলে জাতি-ধর্ম নিয়ে হানাহানি আর রক্তপাতের মহোৎসব চলছে সবখানে। আমাদের উপমহাদেশ থেকে মার্কিন মুলুক, চীন থেকে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা থেকে ওশেনিয়া- শান্তি নেই কোথাও। যে মানুষের জন্য ধর্ম, সেই মানুষকেই আঘাত করা হচ্ছে ধর্মের নামে। হিন্দু মারছে মুসলমানকে, মুসলমান মারছে খ্রিস্টানকে-হিন্দুকে, খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-ইহুদী মারছে মুসলমানকে। আবার একই ধর্মের এক গোষ্ঠী মারছে অন্য গোষ্ঠীকে। দিনশেষে মরছে মানুষ, মারছেও মানুষ। মানুষের সেবা, মানুষের পূজাই যেখানে সৃষ্টিকর্তার আরাধনাতুল্য, ধর্মের মর্মবাণী, সেখানে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির নামে, ধর্মের নামে সেই মানুষকেই মারছে মানুষ।

ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের চিরায়ত সঙ্কটের মধ্যে আবার নতুন করে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ বিধি রদ করে জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশকে ভেঙ্গে লাদাখ অঞ্চলকে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। দুটো অঞ্চলকেই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। লাদাখের কোনো বিধানসভা থাকবে না। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা থাকবে এবং যতো দ্রুত সম্ভব সেখানে বিধানসভার নির্বাচন দেওয়া হবে বলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। এই নতুন ব্যবস্থা চালুর সাথে সাথে সেখানে কারফিউ এবং ১৪৪ ধারা জারি করে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। যদিও এখন কারফিউ ও ১৪৪ ধারা কিছুটা শিথিল হতে শুরু করেছে, কিন্তু মানুষের নিত্য চলাচল এখনও অবাধ নয়। ফারুক আব্দুল্লাহ ও মেহবুবা মুফতি-সহ কাশ্মীরের প্রধান সব রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কাশ্মীরের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে যাওয়া ভারতের দুই শীর্ষ বামপন্থী নেতা সীতারাম ইয়েচুরি ও ডি রাজাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। কংগ্রেস-সহ ভারতের সরকারবিরোধী প্রায় সব রাজনৈতিক দলই সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করছেন। তারা এই পদক্ষেপকে ‘ভারত ভাগের সূচনা’ বলেও মন্তব্য করেছেন।

জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চল ভারতের অংশ। সেখানে তারা কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা জারি করবে, কীভাবে তাদের দেশ চলবে- সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক একমাত্র ভারত সরকার ও সেদেশের জনগণ। কিন্তু নতুন শাসনব্যবস্থার নামে, সংবিধান রক্ষার নামে সেখানে কোনো ধরনের মানবাধিকার যেন ক্ষুণ্ন না হয়- মানুষ হিসেবে সে ব্যাপারে আমাদের নিশ্চয়ই কথা বলা দরকার। সেখানে নতুন ব্যবস্থা চালুর পর টেলিফোন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়ে পারস্পরিক যোগাযোগের মতো ন্যূনতম মানবিক অধিকার রদ করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই সেখানে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে বন্দী করা হয়েছে। সেখানে ভিন্ন মতাবলম্বী ও ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের উপর নানামুখী নিপীড়নের খবর পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে আসছে। আমরা পশ্চিমা গণমাধ্যমের উপর নয়, প্রতিবেশি বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারতের খবর ভারতের সরকারি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমেই পেতে আগ্রহী। আমরা মনে করি, ভিন্ন মত ও ধর্মের কারণে যেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা একজন মানুষকেও কোনোভাবেই মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত বা নিপীড়নের শিকার হতে না হয়। সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অনুসারীদের হাতে ধর্মের নামে সংখ্যালঘিষ্টদের উপর নির্যাতন ও খুনের খবরও আমাদের নজরে এসেছে। ভারতের মতো বৃহৎ বৈচিত্র্যময় উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে আমাদের চাওয়া নিশ্চয়ই এটা নয়।

আজ মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ধর্মের নামে মানুষ হত্যার মহোৎসব চলছে। ইসলামের নামে, জেহাদের নামে ‘ইসলামিক স্টেট (আই এস)’ নামের একটি ভয়ঙ্কর জঙ্গিগোষ্ঠী গড়ে তুলে দেশে দেশে রক্তের হোলিখেলা চলছে। একেকটি দেশের অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নৃশংস আক্রমণ করে বিশাল জনপদকে ধ্বংসক্ষেত্র বানিয়ে ছেড়েছে। ইরাক, লিবিয়া, দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তানকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে নিজেদের নয়া উপনিবেশ বানিয়েছে। সিরিয়ার বাশার সরকারকে এখনও উচ্ছেদ করতে পারেনি বটে, কিন্তু সেখানেও যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ধ্বংসের লীলাভূমি বানিয়ে ছেড়েছে। ওসামা বিন লাদেন ও তালেবান গোষ্ঠী সৃষ্টি ও বিকাশের পেছনেও তাদেরই হাত ছিলো। আবার তালেবান দমনের নামে দেশগুলো দখলের কাজটাও তারাই সেরেছে। অধুনা যে আই এস নামের উগ্র সাম্প্রদায়িক সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ও বিকাশ, তারও পেছনে মার্কিনীদের হাত আছে বলেই মনে করা হয়।

এসবের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের স্থায়ী সঙ্কট হিসেবে ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েল নামক কৃত্রিম রাষ্ট্রটির চাপিয়ে দেওয়া স্থায়ী যুদ্ধাবস্থা তো রয়েছে। মার্কিনীরা সম্প্রতি সে আগুনে আরো ঘি ঢেলেছে। ঈদের ঠিক আগের দিনও ইসরায়েলী সেনাদের হামলায় চার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই সেখানে মরছে নিরীহ মানুষ।

তালেবানের পতনের পর মনে করা হয়েছিলো এবার বুঝি শান্তি আসবে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস এর তাণ্ডব আজ সারা দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। যে মার্কিনীরা তাদের জন্মদাতা, তারাও নিষ্কৃতি পাচ্ছে না এদের হাত থেকে। প্রতিনিয়তই মার্কিন মুলুকে অস্ত্রধারী জঙ্গিদের হামলার ঘটনা ঘটছে। জঙ্গিদের নিত্যনতুন হামলার কৌশলও বের হচ্ছে। ইউরোপের একাধিক স্থানে তারা জনসমাগমপূর্ণ স্থানে ট্রাক চালিয়ে দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে। জার্মানি থেকে ফ্রান্স- তাবৎ ইউরোপের ক্ষমতাধরেরাও আজ তটস্থ আইএস এর জঙ্গি হামলার ভয়ে। এ ভয় গিয়ে ঠেকেছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ওশেনিয়া অঞ্চলের দেশ অস্ট্রেলিয়া থেকে নিউজিল্যান্ডে। কয়েক মাস আগেই শান্তির দেশ নিউজিল্যান্ডে আইএস এর ইসলামের নামে জেহাদী কর্মকাণ্ডের পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে খ্রিস্টান অস্ত্রধারীরা মসজিদের নামাজরত মুসল্লীদের উপর হামলা চালিয়ে হত্যা করেছে। আবার তার প্রতিশোধে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কায় মুসলমান জঙ্গিরা হামলা চালিয়েছে খ্রিস্টানদের গীর্জায়।

আসলে মূল স্বার্থ হলো অস্ত্রব্যবসা। মার্কিনী বিশাল অর্থনীতি টিকেই আছে অস্ত্র ব্যবসার জোরে। কেবল মার্কিনীরাই নয়, বিশ্বের প্রধান পাঁচ মোড়ল রাষ্ট্র তথা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের প্রত্যেকেই এই অস্ত্র ব্যবসার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তারাই বিশ্বব্যাপী উপরি নিরাপত্তার নামে আর পর্দার আড়ালের অস্ত্র ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে দুনিয়াজুড়ে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, যুদ্ধ আর জঙ্গিগোষ্ঠীরতৎপরতা জিইয়ে রেখেছে। এই যুদ্ধবাজদের যুদ্ধকৌশলের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে আজ ব্যবহৃত হচ্ছে জাতিধর্ম। সহসাই এই উত্তপ্ত বিশ্ব শীতল হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেছে।

ইসলামের নামে অন্য ধর্মের মানুষ নিধনের এই মহাযজ্ঞের পাশাপাশি একই ইসলাম অনুসারীদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যেও পারস্পরিক বিরোধও জিইয়ে আছে দেশে দেশে। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের দমনের নামে দেশটির মুসলিমদের উপর বর্বরোচিত বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র সৌদি আরব। সেখানে হাজার হাজার শিশুর লাশের মিছিল। দুর্ভিক্ষের হাহাকার।সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিরোধও তো মুসলিমদের সাথে মুসলিমদেরই। মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই তাই।

ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমানদের রাষ্ট্র হিসেবে যে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিলো ১৯৪৭ সালে, সেই পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের শাসকেরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের উপর নিপীড়ন চালিয়েছিলো সিকি শতাব্দী ধরে। মুক্তিযুদ্ধ করেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের জন্ম কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে হয়নি, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করেই হয়েছে। কিন্তু সেই পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে হানাহানি আর দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার আজও বন্ধ হয়নি। এখন সেখানে মুক্তির লক্ষ্যে লড়াই করছে বেলুচ আর পশতুরা। স্বাধীনতার দাবি উঠছে সেখানেও।

উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশি সমাজতান্ত্রিক চীনের অভ্যন্তরে ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমন পীড়নের খবরেও নজর রয়েছে আমাদের। সেখানকার উইঘুর সম্প্রদায়ের মুসলমানদের উপর দমন পীড়ন চলছে বহু বছর ধরে। আর হংকংয়ের মুক্তি আন্দোলন তো এই মুহূর্তের আলোচিত বিষয়। আবার সৌদি আরব ও পাকিস্তান মুসলিমপ্রধান দেশ হলেও চীনের উইঘুর নীতির প্রতি তাদের একচ্ছত্র সমর্থন অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে প্রতিবেশি মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শাসকেরা তাদের আরাকান অঞ্চলের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর জাতিগত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমান দেশত্যাগ করে এখন বাংলাদেশে আশ্রয়ক্যাম্পে আশ্রিত। বাংলাদেশের মতো শত সমস্যা-জর্জর একটি দেশের পক্ষে এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার ভার বহন অসম্ভব হলেও কার্যত চীন কিংবা ভারত এ প্রসঙ্গে একেবারেই নিরব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে সোচ্চার হলেও, এমনকি তাদের একজন পার্লামেন্টারিয়ান আরাকানকে মিয়ানমার থেকে কেটে নিয়ে বাংলাদেশের সাথে জুড়ে দেওয়ার পক্ষে বিবৃতি দিলেও বাংলাদেশ সরকার ও এদেশের জনগণ জানেন ভালো করেই যে, মার্কিনীরা কারো বন্ধু হলে তার আর শত্রুর প্রয়োজন পড়ে না। এই অঞ্চলেও স্থায়ী যুদ্ধাবস্থা যাতে কেউ তৈরি করতে না পারে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট সতর্ক।

কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও আজ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেই হচ্ছে। বিগত বিএনপি-জামাত সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় মদদ ও পৃষ্ঠপোষকতায় জেএমবি, হরকাতুল জিহাদের মতো যে জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ও বিকাশ হয়েছিলো এবং সারাদেশে একযোগে বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ হত্যার যে মিশন শুরু হয়েছিলো, সেসব তৎপরতা আজ নেই বটে। বর্তমান সরকারের জঙ্গিবাদবিরোধী দৃঢ় অবস্থানের কারণে মোটের উপর বড় ধরনের বিপদ কেটে গেছে বটে। কিন্তু বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে জঙ্গি মনোভাবাপন্ন পরিকল্পনা বিদ্যমান আছে। যদিও আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার এসব চূড়ান্তভাবে দমনের ব্যাপারে সদা কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বাংলাদেশের মানুষের একটা বড় অংশের মধ্যে একটা আশঙ্কাজনক চাপা মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ বাড়ছে। সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর বিভক্তি বাড়ছে। সঙ্কট বাড়ছে। রামু, নাসিরনগর, ঠাকুরপাড়া, মালোপাড়া, গড়েয়ার মতো বড় ধরনের সংগঠিত ও পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের উদাহরণ তো আছেই। এর বাইরেও প্রতিদিন বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে টুকটাক ঘটনা ঘটছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিশেষ করে নির্বাচন কিংবা এ জাতীয় বড় ধরনের কোনো রাজনৈতিক ঘটনা সামনে আসে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আতঙ্কও তখন বেড়ে যায়। এর বাইরে জাতিগত বিদ্বেষের ঘটনাও কিছু ঘটছে বটে। গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীতে সরাসরি ইউএনও’র নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের দ্বারাই আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটেছে। সমতলের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার মানুষদের নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের দ্বারা। পাহাড়েও ভিন্ন জাতিসত্ত্বার উপর খুনোখুনি আর ধর্ষণের মতো ঘটনা শূন্যে নামানো যায়নি। বাংলাদেশের মতো একটি উদার গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক মানবিক রাষ্ট্র যেন কখনোই নীতিগতভাবে নিপীড়কের ভূমিকায় চলে না যায়- সে লক্ষ্যে সরকার থেকে শুরু করে নাগরিকদেরকেও কাজ করতে হবে। পাশাপাশি বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে যেসব ধর্মীয় ও জাতিগত নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে, সেসবের বিচারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে সম্প্রীতির উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

আজ সারা দুনিয়ায় যখন অস্থিরতা, ধর্মের নামে, জাতিগোষ্ঠীর নামে বিদ্বেষ-হানাহানির মহোৎসব চলছে, তখন যেন বাংলাদেশও এই নষ্ট স্রোতে কোনোক্রমেই পা না মেলায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেসব উগ্র সাম্প্রদায়িক নষ্ট গোষ্ঠী আছে, তাদের দমন আর মুক্তিযুদ্ধের মানবিক চেতনাবোধের জাগরণ দিয়ে বাংলাদেশ এই উপমহাদেশে তথা সারা দুনিয়ায় সম্প্রীতির উদাহরণ হোক, মানবিক রাষ্ট্রের নজির গড়ুক।

আজ চারদিকে কেবল দেখছি অস্থিরতা। ভারত বলি, পাকিস্তান বলি, কাশ্মীর, বেলুচিস্তান, পশতুন, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, চীন বলি- এই অঞ্চলে চলছে অস্থিরতা। সৌদি আরব-ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, সুদান, উত্তর কোরিয়া, স্পেন-কাতালান, কলম্বিয়া, ফিলিপাইন, কুর্দিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, রাশিয়া-চেচনিয়া, ইন্দোনেশিয়া-আচেহ, পাপুয়া নিউগিনি, বসনিয়া- সারা দুনিয়াতেই আজ অশান্তির আগুন। শান্তি নেই, চারদিকে অশান্তির দামামা। রাষ্ট্রগুলো স্বয়ং নিপীড়কের ভূমিকায়। মানবিক রাষ্ট্র কোথায়? মানবিক বিশ্ব কোথায়? আজ মানবিকতার বিশ্বায়ন বড্ড জরুরি হয়ে পড়েছে।

আজ চারদিকে কেবল হিন্দু দেখি, চারদিকে কেবল মুসলমান দেখি, চারদিকে কেবল খ্রিস্টান দেখি, চারদিকে কেবল বৌদ্ধ দেখি, চারদিকে কেবল ইহুদী দেখি। অথচ মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অথচ আমাদের মানুষ হওয়ার কথা ছিলো। আজ মানুষের বড্ড বেশি প্রয়োজন। শান্তির বড্ড প্রয়োজন।

আজ সমস্বরে সবাই মিলে উচ্চারণ করা বড্ড প্রয়োজন: যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। মৃত্যু নয়, মানুষ চাই।

লেখকবৃন্দ: জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ মোর্চার কেন্দ্রীয় সংগঠক; তরুণ পেশাজীবী এবং রাজনৈতিক ও সমাজকর্মি।