আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বান্দরবান

তদন্তকালীন মিন্নি ১৬৪ ধারায় প্রদানকৃত দোষ স্বীকারোক্তির নকল পাবেন কি?

আবদুল্লাহ আল মামুন:

সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যা মামলার মূল সাক্ষী এবং পরে অভিযুক্ত হিসেবে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর নিকট ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তি প্রদান করা মিন্নিকে জামিন প্রদান করেন নি। মহামান্য আদালত মিন্নির ১৬৪ ধারার জবানবন্দী দেখতে চাইলে অভিযুক্ত পক্ষ জানান তাদেরকে মিন্নির ১৬৪ ধারার দোষ স্বীকারোক্তির নকল কপি সরবরাহ করা হয়নি। তারা চাইলেও দেয়া হয়নি। মহামান্য হাইকোর্ট তখন জবানবন্দী দেখা ব্যতীত জামিন প্রদান করবেন না মর্মে জানালে মিন্নির আইনজীবী জামিনের আবেদন ফেরত নেন। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী মিন্নির আইনজীবী পুনরায় দোষ স্বীকারোক্তির নকলের জন্য আবেদন করবেন বা না দিলে লিগ্যাল নোটিশ প্রদান করবেন মর্মে জানিয়েছেন।

প্রশ্ন হলো অভিযুক্ত মিন্নি তার ১৬৪ ধারার দোষ স্বীকারোক্তির নকল বা certified copy পাবেন কিনা?

আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার একজন অভিযুক্তদের সাংবিধানিক অধিকার। নিঃসন্দেহে মিন্নির এই অধিকার রয়েছে। তার বিরুদ্ধে আপাততঃ একমাত্র প্রমাণ হলো তার দেয়া দোষ স্বীকারোক্তি। মিন্নি ইতোমধ্যেই তার দেয়া দোষ স্বীকারোক্তি অস্বীকার করেছেন। আইনের ভাষায় যেটাকে বলা হয়- Retraction. কিন্তু, তদন্ত শেষ এবং বিচার শুরু না হওয়া পর্যন্ত এই Retraction এর কোন আইনগত মূল্য নেই। মিন্নি দাবী করছেন তিনি পুলিশের শেখানোমতে বক্তব্য দিয়েছেন বা তিনি দোষ স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় করেননি। যেহেতু এগুলো মিন্নি দাবী করেছেন সেহেতু এই বিষয়গুলো তাকেই প্রমান করতে হবে বিচারের সময়। কিন্তু, মামলার তদন্তাধীন পর্যায়ে এর কোন ফলাফল নেই। এটি বিচারের বিষয়।

প্রশ্ন হলো- Retraction কিভাবে হবে?
অর্থাৎ অভিযুক্ত ১৬৪ ধারার বক্তব্য retract বা অস্বীকার করতে চাইলে দোষ স্বীকারোক্তি মূলক বক্তব্য পুনরায় দেখার দরকার আছে কিনা?

Retraction অভিযুক্ত যে কোন পর্যায়ে করতে পারেন। এটা তার ডিফেন্স। আর ডিফেন্স ঠিক আছে কিনা বা যৌক্তিকতা আছে কিনা সেটা বিচারকারী বিজ্ঞ আদালত দেখবেন। সুতরাং,আমলী বা অন্য কোন আদালতের এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের কোন সুযোগ নেই। Retraction এর জন্য ১৬৪ ধারার দোষ স্বীকারোক্তি দেখার কোন দরকার নেই। কারন Retraction এর মূল বিষয় হলো ম্যাজিস্ট্রেট ঠিক ভাবে ১৬৪ ধারার দোষ স্বীকারোক্তি গ্রহন করেননি। আইন মানেননি। অভিযুক্তকে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে প্রভৃতি। ম্যাজিস্ট্রেট একটি নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ করে দোষ স্বীকারোক্তি মূলক বক্তব্য লিপিবদ্ধ করে থাকেন। অর্থাৎ এটা procedural বিষয়ে দাবী করা হচ্ছে। একই সাথে অভিযুক্ত ১৬৪ ধারায় যা বলে সেটাও অস্বীকার করে। ম্যাজিস্ট্রেট ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তি নেওয়ার সময় শুধু প্রসিডিউরাল বিষয় দেখেন। যেমন- অভিযুক্তকে বুঝিয়ে বলা যে, তিনি ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ নন। তিনি আদালতের হেফাজতে আছেন,পুলিশের হেফাজতে নেই। তিনি যদি দোষ স্বীকার করেন, তবে বিচারের সময় সেটি তার বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে। আদালত এই বিষয়গুলো বুঝিয়ে বলেন অভিযুক্তকে যে কোন ধরনের ভয় ভীতি, প্রলোভন প্রভৃতি থেকে বের করে আনার জন্য। অভিযুক্তকে চিন্তা ভাবনার জন্য ৩ ঘন্টা সময়ও দেয়া হয়। এরপর, অভিযুক্ত বলতে চাইলে জুডিসিয়াল বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেন। ভিন্ন কিছু প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত এই দোষ স্বীকারোক্তি, সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী যথাযথভাবেই করা এবং লিপিবদ্ধ হয়েছে বলে গন্য করা হয়। “ভিন্ন কিছু” প্রমাণ করার সুযোগ একজন অভিযুক্ত বিচার কালে পান, তদন্তকালে নয়।

অভিযুক্ত সত্য বলেছেন কিনা সেটা পুলিশ রেগুলেশন অব বেংগল (পি আর বি) অনুযায়ী তদন্তকারী কর্মকর্তা দেখবেন। ১৬৪ ধারার দোষ স্বীকারোক্তির সব বক্তব্য সত্য নাও হতে পারে। সেটা দেখা তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব। এর জন্য তিনি আবার রিমান্ডও চাইতে পারেন। সুতরাং, Retraction এর জন্য ১৬৪ ধারার জবানবন্দির কপি দরকার নেই। এছাড়াও অভিযুক্ত নিজেই বলেছে বলে সে জানে কি রেকর্ড করা হয়েছে। সে পড়তে পারলে মেমোরেন্ডাম অনুযায়ী সে নিজেই পড়ে তার বক্তব্য সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে স্বীকার করে স্বাক্ষর করেছে। সে পড়তে না পারলে তাকে পড়িয়ে শোনানো হয়েছে। বিষয়টা তার একান্তই জ্ঞানের বলে ১৬৪ ধারার দোষ স্বীকারোক্তির কপি তদন্তকালে পুনরায় দেখার কোন সুযোগ নেই।

মিন্নি তার দেয়া জবানবন্দীর অনুলিপি পাবেন কিনা?

উত্তর হলো- অবশ্যই পাবেন। কিন্তু সেটি তদন্ত সমাপ্তির পরে। অর্থাৎ পুলিশি তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবং আদালত তদন্ত রিপোর্ট গ্রহন না করা পর্যন্ত মিন্নি তার দেয়া দোষ স্বীকারোক্তির কপি পাবেন না।

পুলিশি তদন্ত একটি গোপন বিষয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্তকালে তার করা সব কাজ বা নেয়া সব পদক্ষেপ একটি ডায়েরিতে সংরক্ষণ করেন যেটাকে বলা হয় কেস ডকেট (সি ডি). তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেস ডকেটের সব তথ্য গোপনীয়। ১৬৪ ধারার বক্তব্য তদন্তের অন্যতম অনুসঙ্গ। এটি সিডি এর অংশ। ফলে এটা মামলার নথির সাথে থাকতে পারে না। এটা মামলার তদন্তকারী অফিসার বা কোর্ট ইন্সপেক্টরের কাছে থাকে যা পিআরবি এর বিধান অনুযায়ী শুধুমাত্র আদালত, তদন্তকারী কর্মকর্তা, তদন্ত তদারককারী কর্মকর্তা, কোর্ট ইন্সপেক্টর বা তাদের উর্ধতন কর্মকর্তা ব্যতীত অন্য কেউ বা অভিযুক্ত বা তাদের আইনজীবী দেখতে পারেন না।
এর মূল কারণ হলো- তদন্তের গোপনীয়তা রক্ষা করা। তদন্তের সময়ে যদি এর নকল কপি সরবরাহ করা হয় তবে তদন্তের কোন কিছুই আর গোপন থাকবে না। সাক্ষ্য প্রমান ধ্বংস করাসহ অন্য অভিযুক্তরা সাবধান হয়ে যাবেন বা পালিয়ে যাবেন বা আরো অনেক কিছুই হতে পারে। সুতরাং, তদন্তের স্বার্থেই ১৬৪ ধারার দোষ স্বীকারোক্তির নকল সরবরাহ করা বা পিআরবিতে উল্লেখিত ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গ ব্যতীত অন্য কাউকে দেখতে দেয়া যাবে না।

অপর একটি কারন হলো- তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ১৬৪ ধারার দোষ স্বীকারোক্তি নথির অংশ নয় (Part of the record)। নথির অংশ না হওয়ায় এটার নকল দেয়া যাবে না। তদন্ত শেষে আদালত রিপোর্ট গ্রহন করলে এটি নথির অংশ হবে। তখন অভিযুক্ত অবশ্যই এর নকল পাবে।

এই বিষয়ে আমরা The Criminal Rules and Orders ( Practice and Procedures for subordinate Court), 2009 এর রুল-২৪৩ দেখা যেতে পারে। একটি ক্রিমিনাল বা ফৌজদারী মামলায় কারা কারা নকল পাবেন সেটি এখানে বলা হয়েছে।

মিন্নির ১৬৪ ধারার জবানবন্দীর certified copy না দেওয়ায় হাইকোর্ট জামিন দেননি। আমলী আদালত ১৬৪ ধারার জবানবন্দীতে নাম আসায় এবং মিন্নি নিজেই ১৬৪ ধারার জবানবন্দী প্রদান করায় জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। মিন্নি ১৬৪ ধারার বক্তব্য retract করেছে যেটা বিচারিক আদালত বিবেচনা করবেন অন্যান্য সাক্ষ্য প্রমাণের সাথে মিলিয়ে।১৬৪ থাকছে কোর্ট ইন্সপেক্টর আর আই ও এর কাছে। নথিতে নয়। তাহলে মিন্নি এখন কি করবে?

Rule-243,Cr.R.O-2009

Parties to a criminal proceeding are entitled to obtain copies, certified or uncertified of any portion of the record of trial or inquiry including such police papers as may be used as evidence at the trial or enquiry and final report submitted by the police under section 173 of the code.

রুল ২৪৩ এ ইনকোয়ারি এবং ট্রায়ালের কথা বলা হয়েছে। সুচিন্তিত ভাবেই ইনভেস্টিগেশনের কথা বলা হয়নি। কারণ, ১৭৩ ধারা নিজেই সি আর পি সি এর ইনভেস্টিগেশন চাপ্টারের অধীনে। তাই, আলাদা ভাবে উল্লেখ করা হয়নি। ১৭৩ ধারায় যে পুলিশ রিপোর্ট তৈরি করা হয় বা তদন্ত সম্পাদন করা হয়, তা সম্পুর্ন গোপনীয় বিষয়। এটা গোপনীয় ডকুমেন্ট বলেই বিধি ২৪৩ এ উল্লেখ করা হয়নি। পি আরবিও একই কথা বলছে এ বিষয়ে। সুতরাং, এটা নিশ্চিত যে তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত ১৬৪ ধারায় করা দোষ স্বীকারোক্তির কপি পাবেন না। তবে, পুলিশ রিপোর্ট গ্রহন করা মাত্র এটি নথির অংশ এবং পাবলিক ডকুমেন্ট হয়ে যাবে বিধায় নকল দেয়া যাবে।

পুলিশ রিপোর্ট আদালতে দাখিল করার পরে সাধারণত এজাহারকারীকে আদালতে ডাকা হয় রিপোর্টের বিষয়ে তার বক্তব্য শোনার জন্য। তদন্তে অনেক সময় সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে অনেককে অব্যাহতি প্রদান করার সুপারিশ করা হয়। আদালত রিপোর্ট গ্রহন করলে অব্যাহতির সুপারিশপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রিলিজ প্রদান করা হয়ে থাকে।এজাহারকারী আদালতে উপস্থিত হয়ে এই বিষয়ে তার আপত্তি জানাতে পারেন যেটিকে প্রচলিত ভাষায় ‘নারাজি’ বলা হয়। আদালত যদি নারাজীর প্রেক্ষিতে পয়েন্ট সুনির্দিষ্ট করে অধিকতর তদন্তের আদেশ দেওয়া প্রদান করেন, তবে, তদন্ত তখনো চলমান থাকবে । সুতরাং, এই অবস্থায়ও অভিযুক্ত ১৬৪ ধারার নকল পাবেন না।

এই বিষয়ে মহামান্য হাইকোর্ট Mobarak Hossain @ Jewel Vs The State (Author Justice Amirul Kabir Chowdhury-J) 54 DLR(HCD)135= 20BLD(HCD)422 = 5MLR(HCD)334 মামলায় সুস্পষ্টভাবে ‘না’ বোধক উত্তর দিয়েছেন। এই মামলায় তদন্তের পর্যায়ে অভিযুক্তকে ১৬৪ ধারার দোষ স্বীকারোক্তির নকল প্রদান করা যাবে না মর্মে আদালত ঘোষণা করেছেন। আদালত সুস্পষ্টভাবে বলেছেন-

“Confessional Statement recorded under section 164 of The Code of Criminal Procedure, 1898 is a public document within the meaning of section 74 of the Evidence Act, 1872.
During the stage of investigation before filing of charge sheet an accused is not entitled to get copy of statement recorded under section 164 Cr.P.C.
There is no doubt that a Magistrate while recording a statement under section 164 of the Code, does so in his capacity as a judicial officer and the act so done being a judicial act we have no hesitation to state that the record so made is a public document as defined above” ……………………..(Para 7)

সুতরাং,এই রায় এবং আদেশ বলবৎ থাকা অবস্থায় মিন্নি বা তার আইনজীবী দোষ স্বীকারোক্তির সার্টিফাইড কপি পাবেন না। তদন্ত শেষ হলে এবং আদালত পুলিশ রিপোর্ট গ্রহণ করলে, তবেই মিন্নি তার দেয়া দোষ স্বীকারোক্তির নকল পাবেন।

লেখক : অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান পার্বত্য জেলা