ইমরান শরীফ। আইনের শিক্ষার্থী। একক চেষ্টায় বিশ্বের দীর্ঘতম পেপার ক্লিপ চেইন বা শিকল বানিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পেয়েছেন তিনি। গত ২৯ জুলাই হাতে পেয়েছেন বিশ্ব রেকর্ড গড়ার স্বীকৃতিপত্র। ইমরানের ২.৫২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেই শিকল তৈরির শুরু থেকে শেষ এবং ভিন্ন বিষয়ে আরও কয়েকটি রেকর্ড গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম কার্যালয়ে সম্পাদক ড. বদরুল হাসান কচি ও ইমরান শরীফের মুখোমুখি আলাপের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
ল’ইয়ার্স ক্লাব : প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাই, পড়াশুনা, পেশা…
ইমরান শরীফ: আমি ইমরান শরীফ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করে সিটি ল’ কলেজ থেকে এলএলবি শেষ করেছি। একইসঙ্গে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের আন্তর্জাতিক প্রোগ্রামে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করছি। পাশাপাশি ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : ছোট্ট পেপার ক্লিপ দিয়ে এতো বড় শিকল তৈরির অনুপ্রেরণা কোথায় এবং কীভাবে পেলেন?
ইমরান শরীফ: অনুপ্রেরণা বলতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হঠাৎ একদিন দেখি নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী খন্দকার শিহাব স্ট্যাপলারের পিন দিয়ে চেইন বা শিকল বানিয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছেন। গিনেজ বুকে নাম লেখানো সেই তরুণই আমার প্রথম অনুপ্রেরণা। এরপর বিশ্ব রেকর্ড গড়ার স্বপ্ন থেকেই শুরু করলাম পেপার ক্লিপ দিয়ে চেইন বানানো। দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে প্রতিদিন আধঘণ্টা-এক ঘণ্টা সময় বের করে বসে যেতাম পেপার ক্লিপ হাতে নিয়ে। প্রায় একবছরের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ধৈর্য্যের ফসল এটি।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : অদ্ভুত এই কাজটি করতে গিয়ে কোন বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন কি?
ইমরান শরীফ: সকল কাজেই কম বেশি বাধা আসে। তেমনি আমার এ কাজও অল্পদিনের মধ্যে অযথা কাজ বলে পরিচিতি পেল নিকটজনদের কাছে। তবে আমার মা-বাবা বেঁচে না থাকায় এবং অবিবাহিত বলে সাংসারিক ঝামেলাতে পড়তে হয়নি। কিন্তু পরিচিতরা হাসত আর পাগলামি বলে ভেবে নিত। আড়ালে অনেকে কটু কথাও বলত। তবে মানুষের কথায় দমে যাইনি আমি। প্রতিদিন একটু একটু করে কাজ করে গেছি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পেপার ক্লিপে বানানো আমার শিকলের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ২.৫২৭ কিলোমিটার। তাতেই যুক্তরাজ্যের আয়ারল্যান্ডের বেন মুনের ১.৯৯৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পুরোনো রেকর্ডকে টেক্কা দিয়ে বিশ্ব রেকর্ড নিজের করে নিলাম।
এছাড়া আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, সেটা হল – একটার সঙ্গে আরেকটা পেপার ক্লিপ জোড়া দিয়ে শিকল বানানো কঠিন নয়, ধৈর্যের কাজ। কারণ, পেপার ক্লিপগুলো খালি হাতেই জোড়া দিতে হয়েছে। কোনো যন্ত্রের সুবিধা নেওয়া যায়নি। আবার কতটুকু চেইন বানানো হলো, তার ভিডিও প্রতিদিন পাঠাতে হতো গিনেস কর্তৃপক্ষকে। মাঝেমধ্যে তো ধৈর্য্যহারা হয়ে বলতাম ধ্যাত! সব বাদ দিয়ে দিবো। পরে আবার নিজেকে বোঝাতাম, দেশের জন্য একটা রেকর্ড বয়ে আনার মতো সম্মান অর্জনের জন্য কষ্ট তো করতেই হবে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : কবে কখন এ কাজ শুরু করেন, ঠিক কতগুলো পেপার ক্লিপ লেগেছে এবং এসব সংগ্রহ করেছেন কীভাবে?
ইমরান শরীফ: আমি রেকর্ডটি গড়ার জন্য ২০১৮ সালের জুন মাসে গিনেস কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করি। আবেদন করার তিন মাস পর অনুমোদন মেলে। তবে আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের অপেক্ষায় বসে থাকিনি, জুন মাস থেকেই শিকল বানানোর কাজটি শুরু করি। শিকল বানানো শেষ হলে এ বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর সড়কে এটি মাপা হয়। ভোর ৬টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত লেগেছিল পরিমাপ করতে, প্রমাণ হিসাব করতে হয়েছে ভিডিও, তুলতে হয়েছে ছবি। এরপর গিনেস কর্তৃপক্ষ সেসব যাচাই-বাছাই করে আনুষ্ঠানিকভাবে ফলাফল ঘোষণা করে ১১ জুলাই। গিনেস রেকর্ডসের স্বীকৃতির সনদ আমার ঠিকানায় এসে পৌঁছায় ২৯ জুলাই।
আর চেইনটি বানাতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৭১৫টি পেপার ক্লিপ লেগেছে। এসব পেপার ক্লিপ আমি সংগ্রহ করেছি স্থানীয় স্টেশনারি দোকান থেকেই। পুরো কাজটি সম্পন্ন করতে খরচ হয়েছে লাখখানেক টাকা।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : একটি রেকর্ড তো নিজের করে নিলেন, ভিন্ন কোন রেকর্ড গড়ার পরিকল্পনা আছে কি?
ইমরান শরীফ: পরিকল্পনা তো অবশ্যই আছে। ইতোমধ্যে আরও সাতটি ক্যাটাগরিতে আমার অনুমোদন নেওয়া আছে। এরমধ্যে জাতীয় পতাকা নিয়ে শুরু করা কাজটি শেষের দিকে। এছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে নিয়ে একটা কাজ শিগগিরই শুরু করব। উনাকে নিয়ে তো গিনেজে কোন রেকর্ড নাই তাই জাতির পিতাকে নিয়ে শুরু করতে যাওয়া কাজটি আমার ড্রিম প্রজেক্ট বলা যেতে পারে। এছাড়াও বাংলাদেশের সংস্কৃতি–সম্পর্কিত নতুন আর অভিনব কোনো বিষয়ে রেকর্ড গড়ার পরিকল্পনা আছে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।
ইমরান শরীফ: ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকেও ধন্যবাদ।
উল্লেখ্য, রেকর্ডস বিচিত্র বিষয়ে রেকর্ড সংরক্ষণ করার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী পরিচিত তাদের গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস নামে রেকর্ড নথিবদ্ধ করার বার্ষিক প্রকাশনার জন্য। ১৯৫১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এই রেকর্ড সংরক্ষণের বইটি। ২০০০ সালে পর্যন্ত প্রকাশনাটি বের হতো দ্য গিনেস বুক অব রেকর্ডস নামে। বিশ্বের ২৩টি ভাষায় প্রকাশিত বই ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে প্রতিনিয়ত রেকর্ড হালনাগাদ করা হয়। এ পর্যন্ত প্রায় ৪৭ হাজার বিষয়ের ওপর রেকর্ড সংরক্ষণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কোনো রেকর্ড নতুন করে গড়ার ক্ষেত্রে প্রথমে প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আবেদন করতে হয়। এরপর আবেদন গৃহীত হলে রেকর্ডটি গড়ার নিয়মনীতি পাঠানো হয়। এসব নিয়মনীতি মেনে রেকর্ড গড়ার পদক্ষেপ নিতে হয়। পদে পদে গিনেস রেকর্ড কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হয়। এরপর যথাযথ তথ্য-উপাত্ত প্রমাণ হিসেবে গিনেস রেকর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে হয়। গৃহীত হলে তবেই মেলে স্বীকৃতি, সনদ। স্বীকৃতি মেলে দুটি উপায়ে—সাধারণ প্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি এবং অগ্রাধিকারভিত্তিক স্বীকৃতি। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বীকৃতি বলতে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই (স্বাভাবিক নিয়মে তিন মাস প্রয়োজন হয়) স্বীকৃতি পাওয়া। এ জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস ওয়েবসাইটে লগইন করে ‘বাংলাদেশ’ নামে বিভিন্ন বিভাগে ৮৯টি রেকর্ডের খোঁজ মেলে। তবে এর মধ্যে ব্যক্তিগত ও দলগত রে্কর্ড রয়েছে মাত্র ১৭টি। অন্য রেকর্ডগুলো গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যোগ করেছে। এই রেকর্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, জাতিসংঘে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রেরণকারী দেশের মতো স্বীকৃতিগুলো।