বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদী যোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রসঙ্গে

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান:

১৯৭০ সাল। পাকিস্তানজুড়েই বাজছে নির্বাচনী ডামাডোল। এরই মধ্যে ডিসেম্বর মাসে ইয়াহিয়া খান প্রদত্ত Framework Order (LFO) এর অধীন অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন। এ নির্বাচনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের ১২০ দিনের মধ্যে জাতীয় পরিষদ কর্তৃক পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করা। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের পাশাপাশি পাকিস্তানের সব প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭০-এর ডিসেম্বরেই। জাতীয় পরিষদের ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ ১৯৭০ এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল ছয় দফার ভিত্তিতে। বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৬৬ সালে রচনা করেন ছয় দফা। এই ছয় দফার প্রথম দফাতেই প্রণীত হয়- “ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনাকরতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে। তাতে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইনসভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে।”

১৯৭০ এর নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তার দলীয় মেনিফেস্টো প্রকাশ করে। সেখানেও তারা নির্বাচিত হলে কী ধরনের শাসনতন্ত্র তৈরি করবেন উল্লেখ করা হয়। যেহেতু, নির্বাচনটি হয়েছিল LFO এর অধীনে, মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র চরিত্র ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগণের স্বার্থ, এ দুটি বিষয় সামনে রেখেই সেদিন আওয়ামী লীগকে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করতে হয়েছিল। শাসনতন্ত্র বা সংবিধানে কী কী বিষয় সন্নিবেশিত হবে তা উল্লেখ করা হয়েছিল এই ইশতেহারে। সেখানে এটি স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে, দেশে একটি সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, যার মাধ্যমে দেশের মানুষ সত্যিকারের স্বাধীনতা ভোগ করবে, ন্যায়বিচার ও সাম্যের ভিত্তিতে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠিত হবে। ইশতেহারে ধর্ম সম্বন্ধে বলা হয়- আল কোরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না। সংখালঘুদের ক্ষেত্রেও বলা হয়েছে, তারা সম্পূর্ণ সমতার ভিত্তিতে অন্য ধর্মাবলম্বীরা অনুরূপ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবেন। সমতার ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়- ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ভাষা নির্বিশেষে দেশের প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার ভোগ করবে। মৌলিক অধিকার সম্বন্ধে ওই ইশতেহারে উল্লেখ ছিল, প্রত্যেক নাগরিকের বাক, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারসহ অন্যান্য বেশ কিছু মৌলিক নাগরিক অধিকারকে সাংবিধানিক অধিকার বলে নিশ্চিত করা হবে। ইশতেহারে আরও উল্লেখ করা হয়, দেশে একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা হবে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ আলাদা থাকবে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুত উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আরও অনেক বিষয়ের প্রতিও আলোকপাত করা হয়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় সক্রিয় হন মূলত তাদের দলীয় ইশতেহার ও ছয় দফার ওপর ভিত্তি করেই। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ও নির্বাচন-পরবর্তী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানিদের দৃশ্যমান অনীহা ও সর্বোপরি ২৫ মার্চ এর ভয়াল রাতের নজিরবিহীন বর্বর হত্যাযজ্ঞের ঘটনা বর্তমানের ষাটোর্ধ্ব প্রতিটি বাঙালিরই কমবেশি জানা আছে। আর ঐতিহাসিকদের বদৌলতে বাকি জনগোষ্ঠী ইতিমধ্যে এই নৃশংস ইতিহাস অনেকটাই জেনে গেছে। আমি ইতিহাসবিদ নই। তাই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস রচনা আমার উদ্দেশ্য নয়। ইতিহাসের অনিবার্য সত্যটুকুই শুধু বলতে চাচ্ছি। নতুন প্রজন্মের ইতিহাসের সত্যকে জানার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করার প্রয়াসে আমার এ লেখা। ১০ এপ্রিল ১৯৭১, মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেন ১৯৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ী জনপ্রতিনিধিরা। একই দিনে অর্থাৎ ১০ এপ্রিল ১৯৭১, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ‘আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়োগ আদেশ’ (Laws Continuance Enforcement Order) প্রবর্তন করেন। এইচ টি ইমামের লেখা ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’-এ উক্ত ‘অর্ডার’-এর নিম্নরূপ বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে।

মুজিবনগর

১০ এপ্রিল, ১৯৭১

আমি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রপতি ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমাকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই মর্মে আদেশ প্রদান করছি যে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে যেসব আইন ও বিধিবিধান কার্যকর ছিল সে-সমস্তই প্রয়োজনীয় অবস্থাগত পরিবর্তনসহ আগোক্ত ঘোষণা সাপেক্ষে বলবৎ থাকবে এবং সকল সরকারি, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বেসামরিক, সামরিক, বিচার বিভাগীয়, কূটনৈতিক যাঁরা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করবেন তারা সকলেই তাদের স্ব স্ব পদে চাকুরিবিধির শর্তানুযায়ী যেভাবে কর্মরত ছিলেন তারা সেভাবেই কর্মরত থাকবেন এবং বাংলাদেশ ভূখন্ডের সকল জেলা জজ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যত্র কর্মরত কূটনৈতিক প্রতিনিধিবৃন্দ তাদের আওতাধীন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনুগত্যের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার ব্যবস্থা করবেন।

এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে।

স্বা: সৈয়দ নজরুল ইসলাম

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি

১০ এপ্রিলে জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র এবং একই তারিখের প্রদত্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রদত্ত ‘আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়োগ আদেশ’ এ দুটি দলিলেরই কার্যকারিতা দেওয়া হয় ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দিন থেকেই। মুজিবনগর সরকার পরবর্তী নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ এবং সরকার পরিচালনার দৈনন্দিন কাজ এই দুটি ঐতিহাসিক আইনি দলিলের ওপর ভিত্তি করেই অদম্য দৃঢ়তায় এগিয়ে নিয়ে যান।

১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি অবশেষে চূড়ান্ত বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করে। জাতি অর্জন করে স্বাধীনতা। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পায় স্বাধীন বাংলাদেশ। তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি দখলদার সেনা মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপর শুরু হয় অপেক্ষার পালা। জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে স্বাধিকার আন্দোলনের পুরোধা সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য। অবশেষে প্রতীক্ষার পালা শেষে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশে প্রত্যাবর্তন করেন একটি স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাতা জনক হিসেবে। পরদিন ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু জারি করেন বাংলাদেশের সাময়িক সংবিধান আদেশ, ১৯৭২ (Provisional Constitution of Bangladesh Order,1972) । আর এটিই ছিল বর্তমান সংবিধান না আসা পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর আমাদের গণপরিষদ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করে, যা কার্যকারিতা পায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সাল থেকে। সেই থেকে এই সংবিধানই হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ভিত্তি ও আইন।

সবই ঠিকঠাক চলছিল। বঙ্গবন্ধুর অদম্য নেতৃত্বে এগিয়ে চলছিল দেশ। সদ্য স্বাধীন দেশের সাধারণ মানুষ নানারকম প্রতিকূলতার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে দিনাতিপাত করছিল। কিছু দিনের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বিপর্যস্ত আর্থিক অবস্থা কাটিয়ে যখন প্রিয় স্বদেশ ধীরে ধীরে একটু একটু করে এগোচ্ছে, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টায় যখন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকার দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন ঠিক তেমনই সময়ে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালরাতে কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তার সহায়তায় বিশ্বাসঘাতক ষড়যন্ত্রকারী একটি রাষ্ট্রদ্রোহী সুবিধাবাদী গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এটি আসলে দায়িত্ব গ্রহণ ছিল না, এটি ছিল অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল। দুঃখজনক হলেও সত্য, জাতীয় চার নেতাসহ অল্প কিছু দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা ছাড়া আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই সেদিন অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। স্বাধীনতার চেতনায় এটি ছিল কুঠারাঘাত।

আরও পরিতাপের সঙ্গে বিস্মিত হই যখন দেখি যে, ৮ নভেম্বর ১৯৭৫ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম প্রধান বিচারপতির পদে আসীন থেকে তিনি রাষ্ট্রপতি এবং মুখ্য সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই নতুন রাষ্ট্রপতি ৭৫ এর ১৫ আগস্টে ঘটে যাওয়া একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির হত্যাকান্ড সম্পর্কে এতটুকু টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। বিষয়টি ভেবে একজন বিচারপতি হিসেবে আমি চরমভাবে লজ্জাবোধ করি। কষ্ট পাই, হতবাক হই। এটি হয়তো সবাই জানেন যে, প্রধান বিচারপতি বা যে কোনো বিচারপতিকে তার পদে যোগদানের আগে তাকে একটি শপথ নিতে হয়। শপথ নেওয়ার সময় আরও কিছু কথার সঙ্গে উচ্চারণ করতে হয় :

“আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করিব; আমি বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব; এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিব”।

শপথনামায় বিধৃত উল্লিখিত শব্দসমূহ বা বাক্যগুলো মন্ত্রীদের শপথের বেলায়ও উচ্চারণ করতে হয়, শুধু ‘আইনের রক্ষণ’ শব্দগুলো ব্যতীত। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার যে মন্ত্রীরা ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রীরূপে শপথ নিলেন তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন যে, ‘সংবিধান সংরক্ষণের’ যে শপথে তারা আবদ্ধ ছিলেন পূর্বদিন পর্যন্ত কি অবলীলাক্রমে পরের দিনই তারা সেই শপথ ভঙ্গ করলেন? শপথ ভঙ্গ করে নতুনভাবে শপথ নিয়ে একটি সাংবিধানিক সরকারের বদলে একটি অসাংবিধানিক সরকারকে সমর্থন করে তারা বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে করেছেন বেইমানি। আর জাতির সঙ্গে করেছেন প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাকতা।

এরপর ১৯৭৫ সালের ৮ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি সায়েমও মোশতাকের মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের মতোই একটি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নেন। হায়রে দুর্ভাগা স্বদেশ! জাতির ক্রান্তিলগ্নে যাদের দায়িত্ব ছিল সংবিধানের সংরক্ষণ করা তারাই সংবিধানকে অবলীলায় পদদলিত করে অসাংবিধানিক পন্থাকে বেছে নেয় ক্ষমতার শিখরে আরোহণের জন্য। দেশের এগিয়ে যাওয়াকে প্রতিহত করার জন্য।

পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল ৫ম সংশোধনী প্রণয়নের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পর্যন্ত বন্ধ করা হয়। বিচারহীনতার এই সুযোগে হত্যাকারীরা অব্যাহতি পায়। এ কথা সবারই জানা। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর সরকার ছিল একটি সাংবিধানিক সরকার। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে খন্দকার মোশতাক, জিয়া গং আর একটি অসাংবিধানিক এবং মূলত সামরিক সরকার গঠন করেন। আর সামরিক শাসনকে দৃশ্যমান সমর্থন দিয়েছেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের মতো ব্যক্তি এবং আরও কিছু সুবিধাবাদী চরিত্রের রাজনৈতিক নেতা।

উপরে ১৫ আগস্ট পরবর্তী যে ঘটনাগুলো স্বল্প পরিসরে তুলে ধরলাম তা এক নির্মম ইতিহাসের চিত্র। এর বিপরীতেও একটি চিত্র রয়েছে। সেটি হলো- ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট দেশের বেশ কিছু জায়গায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠিত হয় গায়েবি জানাজা। সঙ্গত কারণেই তখনকার আকস্মিক বিরূপ পরিস্থিতিতে সেসব খবর জাতীয় পত্রিকায় স্থান পায়নি। স্থান পেতে দেওয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, দেশের বেশ কিছু অঞ্চল থেকে বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যুব সমাজ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ও প্রতিশোধ নেওয়ার মানসে ভারত সরকারের আশ্রয় ও সমর্থন চান। তখন এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম। সম্প্রতি আমি আমার গ্রামের বাড়ি মোহনগঞ্জ ঘুরে এসেছি। আমার সঙ্গে সুকুমার সরকার নামের এক ভদ্রলোক আরও ৩/৪ জনসহ দেখা করেন, এদের মধ্যে ছিলেন মির্জা আবদুল গণি, সুবোধ রায়, আক্কেব আলী, প্রমোদ মল্লিক ও শাহ মাহবুব মুর্শেদ কাঞ্চন। সুকুমার সরকারের বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানায়। কথা হয় সবার সঙ্গেই। জানতে পারি অনেক কিছু। সুকুমার সরকার ’৭১-এর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বদলা নিতে ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের ভিতরে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি স্থানে যুদ্ধেও লিপ্ত হয়েছিলেন তিনি ও তার দল। তিনিই আমাকে জানান, তাদের সঙ্গে আমার বাবা ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদের যোগাযোগ ছিল। আমরা শুধু এটুকু জানতাম যে, ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে আমার বাবা স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর লাশের গায়েবানা জানাজার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং পরবর্তী করণীয় ঠিক করার জন্য কয়েকটি গোপন বৈঠক করেছিলেন। যার কারণে তাকে সামরিক বাহিনীর লোকজন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায় এবং বেশ কিছু দিন নিজ বাসায় তাকে অন্তরীণ রাখে।

সুকুমার সরকার প্রায় ঘণ্টাখানেক আমার সঙ্গে কথা বলেন। সীমান্তের ওপারে সে সময় তাদের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা, পরবর্তীতে ভারতে সরকার পরিবর্তনের কারণে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো এবং দেশে ঢোকার পর সেনাক্যাম্পে নিয়ে তাদের নির্যাতনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন সত্তরোর্ধ্ব সুকুমার সরকার। তিনি আরও জানান, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক প্রতিরোধ যোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন, অনেকে বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব। আমি কথাগুলো শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, যেসব লোক ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তাদের অনেকেই ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভারও সদস্য হলেন কীভাবে? তাদের বিবেক কি নাড়া দেয়নি? বঙ্গবন্ধুর প্রতি কি তাদের এতটুকু মমত্ববোধ ছিল না? দেশপ্রেম ছিল না? অথচ এই সুকুমার সরকার ও তার সঙ্গীরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন।

সুকুমার সরকারের কাছেই শুনেছি, তার মতো যারা ’৭৫-এর আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে অস্ত্র ধরেছিলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নাকি তাদের ‘প্রতিরোধ যোদ্ধা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সত্যিই তারা বীর প্রতিরোধ যোদ্ধা। কেননা তারা সেদিন শুধু কয়েকজন মানুষের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ করেননি। তারা একটি সাংবিধানিক সরকার ও তার প্রধানকে অসাংবিধানিক পন্থায় উৎখাত করার ঘটনার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে চেয়েছেন। তারা চেয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ‘আইনের ধারাবাহিকতার প্রয়োগ আদেশ ১৯৭১’, ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারির ‘সাময়িক সংবিধান আদেশের’ মধ্য দিয়ে এ ভূখন্ডে যে স্বাধীন-সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা এবং পরবর্তীতে আমাদের পবিত্র সংবিধানের অধীন ১৯৭৩ সালে পুনর্নির্বাচিত সেই জনগণের সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। যদি এই প্রতিরোধ যোদ্ধারা সেদিন সফল হতেন তাহলে কী হতো? নিশ্চয়ই বিশ্বাসঘাতক মোশতাক, জিয়া, সায়েমদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো।

প্রতিরোধ যোদ্ধারা হয়তো সেদিন তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি। কিন্তু তাদের সেই অদম্য সাহসী ও সৎ উদ্যোগটি ছিল দৃশ্যমান প্রতিবাদের অকাট্য অংশ, এটি এক ঐতিহাসিক সত্য। প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি বলে সভ্যতার ইতিহাস থেমে থাকেনি। মানুষের সাংবিধানিক অধিকার পাওয়ার বাসনা স্তিমিত হয়ে যায়নি। যে কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের’ মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, কালের আবর্তে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সেই কুখ্যাত অর্ডিন্যান্সকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে। এই বিচার ওই প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কার্মকান্ডের আংশিক বিজয়। মুন সিনেমা হলের মামলায় (Writ Petition No. 6061 of 2000, Bangladesh Italian Marble Works Limited —Petitioner -Versus- Government of Bangladesh and others —Respondents) মাননীয় বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবির মোশতাক, সায়েম ও জিয়ার শাসনকালকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন এবং তাদের সবাইকে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যা পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ অনুমোদন করেছে। এ মামলায় তাদের প্রদত্ত পর্যবেক্ষণগুলোর কিছু অংশ নিচে উদ্ধৃত করা হলো :

The taking over of the powers of the Government of the People’s Republic of Bangladesh with effect from the morning of 15th August, 1975, by Khandaker Mushtaque Ahmed, an usurper, Placing Bangladesh under Martial Law and his assumption of the office of the President of Bangladesh, were in clear violation of the Constitution, as such, illegal, without lawful authority and without jurisdiction.
* The nomination of Mr. Justice Abusadat Mohammad Sayem, as the president of Bangladesh, on November, 6, 1975, and his taking over of the Office of President of Bangladesh and his assumption of the powers of the Chief Martial Law Administrator and his appointment of the Deputy Chief Martial Law Administrators by the Proclamation issued on November 8, 1975, were all in violation of the Constitution.
* The handing over of the Office of Martial Law Administrator to Major General Ziaur Rahman B.U., PSC, by the aforesaid Justice Abusadat Mohammad Sayem, by the Third Proclamation issued on November 29, 1976, enabling the said Major General Ziaur Rahman, to exercise all the powers of the Chief Martial Law Administrator, was beyond the ambit of the Constitution.
* The nomination of Major General Ziaur Rahman, B.U., to become the President of Bangladesh by Justice Abusadat Mohammad Sayem, the assumption of office of the President of Bangladesh by Major General Ziaur Rahman, B.U., were without lawful authority and without jurisdiction.
* All proclamations, Martial Law Regulations and Martial Law Orders made during the period from August 15, 1975 to April 9, 1979, were illegal, void and non est because: i) Those were made by persons without lawful authority, as such, without jurisdiction. ii) The Constitution was made subordinate and subservient to those Proclamations. Martial Law Regulations and Martial Law Orders, iii) Those provisions disgraced the Constitution which is the embodiment of the will of the people of Bangladesh, as such, disgraced the people of Bangladesh also. iv) From August 15, 1975 to April 7, 1979, Bangladesh was ruled not by the representatives of the people but by the usurpers and dictators, as such, during the said period the people and their country, the Republic of Bangladesh, lost its sovereign republic character and was under the subjugation of the dictators. v) From November 1975 to March, 1979, Bangladesh was without any Parliament and was ruled by the dictators, as such, lost its democratic character for the said period. vi) The Proclamations etc., destroyed the basic character of the Constitution, such as, change of the secular character, negation of Bangalee nationalism, negation of Rule of law, ouster of the jurisdiction of Court, denial of those constitute seditious offence.

বিলম্বে হলেও সর্বোচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত ও অভিমত দিয়েছে সেখানে নিশ্চিতভাবেই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের প্রতিরোধ যোদ্ধারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর যে কর্মকান্ড ও উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটিই প্রকারান্তরে বিচারিক ভাষায় প্রতিফলিত হয়েছে। তারা উচ্চকিতভাবে বলতেন যে, মোশতাক, জিয়ার শাসন অসাংবিধানিক, অবৈধ। বঙ্গবন্ধুর সাংবিধানিক সরকারকে উৎখাতের মাধ্যমে এরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছে। তারা সে সময় জনমানুষের মনোজগতে এসব পৌঁছে দিতে উচ্চকিত হয়েছিলেন প্রতিবাদের ভাষায়, অস্ত্র হাতে নিয়ে। আর অনেক বছর পর প্রকারান্তরে ওই প্রতিবাদ ও সত্য উচ্চারণ প্রতিফলিত হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারিক ভাষায়, আইনি কলমের সাহসী সক্রিয়তায়। তাহলে এ কথা বলতে দ্বিধান্বিত হওয়ার সুযোগ নেই যে, প্রতিরোধ যোদ্ধারা যে কাজটি করতে চেয়েছিলেন ১৯৭৫ সালে সে কাজটিকেই অনেক পরে হলেও আমাদের বিচার বিভাগ আইনি ভাষার মধ্য দিয়ে তার সমর্থন দিয়ে গেছে। তাই যে দেশপ্রেমিক বীর যোদ্ধারা একদিন একটি অসাংবিধানিক অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাহসী অবস্থান নিয়ে এ দেশের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির জনক কর্তৃক গঠিত সাংবিধানিক সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন তারা আজ নিশ্চয়ই সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থার পক্ষের যোদ্ধা হিসেবে একটি সরকারি বা রাষ্ট্রীয় ও আইনি স্বীকৃতির দাবি রাখেন। এই স্বীকৃতি জাতিকে এবং সব প্রজন্মকে জানতে সাহায্য করবে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর কার কী ভূমিকা ছিল। কে এবং কারা কীভাবে প্রতিরোধে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এই স্বীকৃতি তাদের প্রাপ্য। সত্য প্রতিষ্ঠায় এই স্বীকৃতি ভূমিকা রাখবে।

নতুন প্রজন্ম এবং সবাই জানুক কে এবং কারা কীভাবে ওই সময় প্রতিরোধ প্রতিবাদে উদ্যোগী হন। তারা জাতির সাহসী ও দেশপ্রেমিক সন্তান। তারা নিঃসন্দেহে প্রতিরোধ যোদ্ধা তাদের প্রতিরোধী কীর্তি বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মনোজগৎকে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চেতনায় করবে সাহসী।

আমি আমার এ লেখার মাধ্যমে এই আগস্ট মাসে সেই দেশপ্রেমিক প্রতিরোধ যোদ্ধাদের স্মরণ করতে চাই যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। এই আগস্ট মাস জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে শাহাদাতবরণের মাস। অবর্ণনীয় বিষণ্নতায় আক্রান্ত এ মাসেরই ২৮ তারিখ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একনিষ্ঠ অনুসারী একজন নিবেদিত কর্মী, সাবেক গণপরিষদ সদস্য, আমার পিতা প্রয়াত ডা. আখলাকুল হোসাইন আহমেদের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমার এ লেখাটি আমার পিতা ও অন্যান্য প্রতিরোধ যোদ্ধাদের স্মরণে উৎসর্গ করলাম।

লেখক : সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি।