অ্যাডভোকেট শহিদুল ইসলাম সজীব

ম্যাজিস্ট্রেসি ও ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারগত দ্বন্দে ন্যায় বিচার ভূলন্ঠিত

শহিদুল ইসলাম সজীব:

“হাজার অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক কিন্তু একজন নিরপরাধীও যেন সাজা না পায়” আইনের এই শ্রুতিমধুর প্রবাদের দর্শন যাই হোক না কেন বাস্তবায়নে যে হাজারো বাঁধা আছে, সেটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ না হলেও চলে। আইন পেশায় আসার পরপরই কিছু মারাত্মক অসঙ্গতি, কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটির মুখোমুখি হয়েছি। একজন আইনজীবী হিসেবে আমার মনে হয়েছে এসব অসঙ্গতি আইনের শাসন আর ন্যায়বিচারের পথে কাঁটা হয়ে আছে। অসংখ্য অসঙ্গতি একি সাথে একি আবরণে লেখা সম্ভব নয়। তাই আজ শুধু একটি বিষয়। সেটা হচ্ছে বিশেষ আইনের মামলায় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটগণের জামিন মঞ্জুর করার এখতিয়ার আছে কিনা? যেমনঃ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, মানি লন্ডারিং কিংবা মানব পাচার প্রতিরোধ সম্পর্কিত বিশেষ আইনে আসামীর পক্ষে জামিন দেয়ার পর্যাপ্ত কারণ বা উপাদান থাকলে অন্যান্য মামলার মত প্রি-ট্রায়াল স্টেজে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দিতে পারেন কিনা?

প্রায় সারাদেশের ম্যাজিস্ট্রেসির সাধারণ প্র্যাকটিস হচ্ছে বিশেষ আইনের মামলায় আসামীর পক্ষে যত ভালো গ্রাউন্ডই থাকুক না কেন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট পারতপক্ষে জামিন দেন না। আদেশের নথিতে জামিন না-মঞ্জুরের কারণ যাই লেখা হোক না কেন, বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট প্রকাশ্য আদালতে তাদের অসহায়ত্বকে প্রকাশ করে জামিনের এখতিয়ার নেই বলে মন্তব্য করেন। তারা সাধারণত বিশেষ আইনের কিছু সেকশনের কথা উল্লেখ করেন যেখানে জামিন দেয়ার এখতিয়ার বিষয়ে ঐ আইনে গঠিত ট্রাইব্যুনালের কথা বলা থাকে। এ ধরনের মামলায় শুধু ট্রাইব্যুনালই জামিন দিবে, ম্যাজিস্ট্রেসি পারবে না, এমনটা কোথাও বলা না থাকলেও বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটগণ নিজেদের এখতিয়ারহীন ভাবতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন!

এ ধরনের জি.আর মামলা পুলিশ রিপোর্ট দাখিলের আগ পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেসি’তে থাকে। জামিন চাইলে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেই চাইতে হয়। জামিন দেয়ার এখতিয়ার না থাকলে তার কাছে জামিন চাওয়ার মানে কি? আর যিনি জামিন মঞ্জুর করতে পারবেন না, তিনি কিভাবে না-মঞ্জুর করেন? না-মঞ্জুর করার এখতিয়ার কে দিলো? এখতিয়ার না থাকলে তো মঞ্জুর কিংবা না-মঞ্জুর কোনটাই করার ক্ষমতা থাকার কথা না। মঞ্জুর কিংবা না-মঞ্জুর দুটোই এক ধরনের আদেশ। আদেশ দেয়ার ক্ষমতা কখনো একতরফা (শুধু না-মঞ্জুর করার ক্ষমতা) হতে পারে না। এখানে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট জামিন না দিলেও রিমান্ড শুনানি কিন্তু ঠিকই শোনেন এবং মঞ্জুরও করেন। এখানে তারা ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারা ঠিকই অনুসরণ করেন। কিন্তু জামিনের ক্ষেত্রেই যত আপত্তি। তখনই বিশেষ আইনের ধোঁয়া তোলা হয়! জামিন যেহেতু না-মঞ্জুর’ই হবে, তবে মনোযোগ দিয়ে শুনানি শোনার কি দরকার? এটা দেখতে হাস্যকর লাগে যে, বিজ্ঞ আইনজীবী আর বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট যেখানে নিশ্চিত যে সিদ্ধান্ত কি হবে, সেখানে নিয়মিত শুনানি হচ্ছে! আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে।

অবশ্য না-মঞ্জুরের আদেশের দরকার হয়, কেননা এই না-মঞ্জুর আদেশের নকল তুলেই বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজের কাছে মিস কেস (বিবিধ মামলা) করে আসামীর জামিন আবেদন করতে হয়। পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, সরাসরি জেলা ও দায়রা জজ বা ট্রাইব্যুনালে কেন আসামীর জামিন চাওয়া হচ্ছে না? খুবই বাস্তবিক এবং স্বাভাবিক প্রশ্ন। লেখার কিছু পরেই এই প্রশ্নের উত্তর আসবে।

ম্যাজিস্ট্রেসি আর ট্রাইব্যুনালের এই এখতিয়ারগত দ্বন্দের শিকার হচ্ছে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ। ব্যাপারটা এমন, আপনার কোন দোষ থাকুক আর নাই থাকুক, এ ধরনের মামলায় জেলে যেতেই হবে। যত ভালো ভাবেই আপনি প্রমাণ করুন না কেন যে আপনি অপরাধী নন তবুও আপনার জামিন ম্যাজিস্ট্রেসি’তে মিলবে না। ম্যাজিস্ট্রেসি থেকে না-মঞ্জুর আদেশের নকল তুলে বিজ্ঞ জেলা জজের কাছে যেতে যেতে ইতিমধ্যে ৮-১০ দিন পেরিয়ে যাবে। কোন অপরাধ না করেও আপনি লাল-দেয়ালে বন্দী হয়ে যাবেন!

বিশেষ আইনের মামলায় এই ধরনের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সম্পর্কে মহামান্য হাইকোর্টও অবগত। তারাও দ্বিধাবিভক্ত! হাইকোর্টের বিভিন্ন বেঞ্চ, ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন! বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মামলার রায়ে হাইকোর্ট এই ত্রুটি নিরসনে নানান দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। এ পর্যন্ত মহামান্য হাইকোর্ট কি ধরনের নির্দেশনা দিয়েছেন সে বিষয়ে কিছু আলোচনা করা যাক।

Md. Nurul Islam Babul…Vs…The State[24 BLD (HCD) 205] এই মামলায় হাইকোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দেন নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় (বিশেষ আইন) প্রি-ট্রায়াল স্টেজে ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দিতে পারবেন না। এখানে মূল আইনের জামিন সংক্রান্ত বিধানকে তথা ট্রাইব্যুনালের একচ্ছত্র এখতিয়ারকে স্বীকার করে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে নিবৃত্ত করা হয়েছে। Fazlur Rahman and Others Vs. The State [17 BLT (HCD) 192] মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের সব সংকোচ আর এখতিয়ারহীনতার অনিশ্চয়তা দূর করে দিয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দেন। হাইকোর্ট তার সিদ্ধান্তে জানান, চার্জশীট দাখিল না হওয়া পর্যন্ত বিশেষ আইনের মামলা যতদিন জি.আর মামলা হিসাবে থাকবে ততদিন ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে জামিন দিতে পারবেন। “Sabuj Ahmed (Md) @ Ahmed Shamim Sabuj…Vs…The State reported in 23 BLC (HCD) 199” মামলাতেও হাইকোর্ট একই মনোভাব দেখান।

হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্তে সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু নতুন করে ভিন্ন সমস্যা তৈরী হয়। ট্রাইব্যুনাল ও ম্যাজিস্ট্রেসির মধ্যে নিরব দ্বন্দ তৈরি হয়। ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পর্যাপ্ত উপাদান থাকলে বা মানবিক কারণে আসামীর জামিন দিলেও ট্রাইব্যুনালের বিচারকগণ তা ভালোভাবে নিতে পারছিলেন না। এর ফলে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলো আবার তাদের পুরনো প্র্যাকটিসে ফিরে আসে। ভালো গ্রাউন্ডেও ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জামিন দিতে আগ্রহ দেখান না। কারণ ম্যাজিস্ট্রেসি’কে ট্রাইব্যুনালে নানান ধরনের জবাবদিহিতার মধ্যে সম্মুখীন হতে হচ্ছিলো। এটা ম্যাজিস্ট্রেসি’র জন্য অসম্মানজনক আর বিব্রতকর ছিলো। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। আবার এক অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে গেলো বিচার প্রার্থীর ভাগ্য। আবার হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ পদ্ধতিগত ক্রটির জন্য ন্যায়বিচার বঞ্চিত! এদিকে ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল মহামান্য হাইকোর্ট নতুন ফর্মূলায় সমস্যার সমাধানে তাদের সিদ্ধান্ত জানান। পাঠকের মনের একটা প্রশ্নের কথা লেখার মাঝে বলেছিলাম। এখানে সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। মহামান্য হাইকোর্ট “Md. Shahjahan and Others V. State (Criminal Miscellenous Case No. 18030 of 2014)” মামলায় (নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত) গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত ও কিছু নির্দেশনা প্রদান করেন। এখানে হাইকোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের এখতিয়ারকে অস্বীকার করলেও সমস্যা সমাধানের দিকে নজর দেন। সিদ্ধান্তে জানানো হয়, জি.আর মামলার নথি আর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যাবে না, তা সরাসরি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করতে হবে। শুধু এই সিদ্ধান্তই দেননি, এই নির্দেশনা পুলিশ বিভাগকে কার্যকর করতে আদেশও দেয়া হয়েছিলো। এর মানে হলো সাধারণ মানুষ জামিন বা নারী ও শিশু বিষয়ক যে কোন আবেদন সরাসরি ট্রাইব্যুনালে করতে পারবে। বেশ ভালো সিদ্ধান্ত। এরপর তো সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু হলো না। হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত আপিল বিভাগে আটকে যায়।

কোনভাবেই যেন সমস্যা দূর হচ্ছিলো না। শুধু নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রই না, সব বিশেষ আইনের মামলাতেই ম্যাজিস্ট্রেসি সিদ্ধান্ত জানাতে (জামিন সংক্রান্ত) দ্বিধায় পরে গেলো। সারাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই একি অবস্থা। এর মাঝেও যে দু’একজন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট সাহসী সিদ্ধান্ত দেন নি, তেমনটা নয়। তবে সেটা উল্লেখযোগ্য নয়।

সম্প্রতি বিশেষ আইনে দুদকের করা এক মামলায় (মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন’ ২০১২) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, নং ২৫, এক সাহসী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। অর্থ পাচারের ঐ মামলায় এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক ও কর্মকর্তা আবু হেনা মোস্তফা কামালকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গ্রেফতার হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন ঘন্টার মধ্যে জামিন দেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে হাইকোর্ট স্ব-প্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। [Criminal Revision (Suo Moto) 246 of 2018]

রুল নিষ্পত্তিতে মহামান্য হাইকোর্ট ২০১৮ সালের ৬ ডিসেম্বর ১১২ পেজের জাজমেন্ট প্রকাশ করেন। হাইকোর্টের সর্বশেষ অবস্থান এই জাজমেন্টে পরিষ্কার করা আছে। একটু নজর দেয়া যাক সেই বিশাল জাজমেন্টে কি আলোচিত হলো…
দু’টো প্রশ্নকে সামনে রেখে আলোচনা এগিয়ে যায়…

১. বিশেষ বিচারক দ্বারা বিচার্য ২০১২ সালের আইনে (বিশেষ আইন) অভিযোগ আমলে নেয়ার আগে প্রি-ট্রায়াল স্টেজে মেট্রোপলিটন বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কি জামিন দেয়ার ক্ষমতা রাখেন?

২. মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ১ এবং ২ নম্বর আসামীকে দেয়া ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এর জামিন কি আইন অনুযায়ী বৈধ?

রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি এটর্নী জেনারেল মি. বশির আহমেদ, বিশেষ আইন সাধারণ আইনের উপরে স্থান পাবে জানিয়ে ঐ আইনের ১৩ ধারায় উল্লেখিত বিশেষ বিচারকের জামিন সংক্রান্ত একচ্ছত্র এখতিয়ারকে স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি তার বক্তব্যের সমর্থনে “State of Tamil Nadu…Vs…V. Krishnaswami Naidu and another, (1979) 4 SCC 5” “Gautam Kundu…Vs…Directorate of Enforcement (Prevention of Money-Laundering Act), Government of India Through Manoj Kumar, Assistant Director, Eastern Region, (2015) 16 SCC 1” “Union of India…Vs…Hassan Ali Khan and another, (2011) 10 SCC 235 and A. R. Antulay…Vs…Ramdas Sriniwas Nayak and another, 1984 SCC (Cri) 277” ইত্যাদি মামলায় আদালতের সিদ্ধান্ত ও পর্যবেক্ষণ হাইকোর্টের নজরে আনেন। উল্লেখিত মামলাগুলোর রায়ে বিশেষ আইনের মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের জামিন এখতিয়ারকে অস্বীকার ও প্রদত্ত আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এছাড়াও তিনি দেশের গুরুত্বপূর্ণ “Md Nurul Islam Babul…Vs…The State, 24 BLD (HCD) 205” Ges “Shahjahan (Md) and others…Vs…The State, 19 BLC (HCD) 372” মামলার রায় সঠিক ছিলো বলে মন্তব্য করেন। যেখানে মূল আইনে বর্ণিত বিশেষ বিচারক বা ট্রাইব্যুনালকে জামিনের একমাত্র এখতিয়ার সম্পন্ন হিসেবে স্বীকার করা হয়েছিলো। ম্যাজিস্ট্রেটদের এ ধরনের মামলায় জামিন দেয়াকে এখতিয়ার বহির্ভূত বলা হয়েছিলো।

অন্যদিকে, আসামী পক্ষে জোরালো সাবমিশন রাখেন সিনিয়র আইনজীবী জনাব এরশাদূর রউফ। তিনি জানান, বিশেষ আইন সাধারণ আইনকে আগ্রাহ্য করলেও প্রি-ট্রায়াল স্টেজে আসামীর জামিন দিতে ম্যাজিস্ট্রেটের কোন সুনির্দিষ্ট বাঁধা নেই। তিনি “Durnity Daman Commission…Vs…Abdullah-al-Mamun and another, 21 BLC(AD) 162” মামলার সিদ্ধান্তে আস্থা রেখে জানান, আলোচিত ২০১২ সালের আইনের ১৩ ধারা কার্যকর হবে তখনই যখন অভিযোগ গঠন করে মামলাটি বিশেষ বিচারকের কাছে বিচারে বদলি হবে। এর আগে যখন মামলাটি প্রি-ট্রায়াল স্টেজে ম্যাজিস্ট্রেসি’তে থাকে তখন ১৩ ধারার কোন কার্যকারিতা থাকে না। মামলাটি প্রি-ট্রায়াল স্টেজে থাকাকালীন সময়ে, অভিযোগটি যে অপরাধের তার নির্ধারিত সাজা যদি যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদন্ড না হয় তাহলে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় জামিন দিতে কোন বাঁধা নেই।

মি. রউফ প্রশ্ন করে বলেন, যদি প্রি-ট্রায়াল স্টেজে ম্যাজিস্ট্রেট জামিন না দিতে পারেন, তাহলে তারা কিভাবে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ ধারায় রিমান্ড মঞ্জুর করেন? যদি প্রি-ট্রায়াল স্টেজে একজন ম্যাজিস্ট্রেট আসামীর রিমান্ড মঞ্জুর করতে পারেন, তবে জামিন কেন নয়?

তিনি আরো বলেন, বিশেষ আইনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যদি কার্যবিধির কার্যকারিতাকে নিষেধ না করা হয় তাহলে নিছক বিশেষ আইন এই তথ্য বলে (Ipso facto) ফৌজদারি কার্যবিধির কার্যকারিতা প্রত্যাখান করা যায় না। এই বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে তিনি “Hayder Meah…Vs…Authority appointed under section 15(1) of the Payment of Wages Act, 1936 and Chairman, 1st Labour Court, Dhaka and others, 22 BLD (HCD) (Full Bench) 244” Ges “Durnity Daman Commission…Vs…Abdullah-al-Mamun and another, 21 BLC (AD) 162” মামলায় আদালতের সিদ্ধান্তের সাহায্য নেন।

দু’পক্ষের সাবমিশন শুনে আদালত তার পর্যবেক্ষণ দেন। উপরোল্লিখিত মামলাগুলোর সিদ্ধান্ত ও পর্যবেক্ষণ পুনরায় ব্যাখ্যা করেন। জি.আর শাখা থেকে মামলা আমলে নিয়ে বিচারে বদলী হওয়ার আগ পর্যন্ত বিশেষ আইনের বিশেষ বিচারকের ঐ মামলায় কোন কিছু করার থাকে না, তার নিকট কোন আবেদন উত্থাপিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। এ সময়ে প্রি-ট্রায়াল স্টেজে মামলার দেখাশোনা করে ম্যাজিস্ট্রেসি। বিশেষ আইনে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেসি জামিন দিতে না পারলে, কার্যবিধির ১৬৭ ধারার অধীনে ম্যাজিস্ট্রেসি রিমান্ড কিভাবে মঞ্জুর করেন? পুনরায় হাইকোর্টের এমন প্রশ্নে রাষ্ট্রপক্ষ কোন জবাব দিতে পারেন নি। শেষমেষ মহামান্য বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী তার সিদ্ধান্তে জানান, “To sum up, at the pre-trial stage, that is to say, from the date of lodgment of the FIR with the concerned Police Station till taking cognizance of the offence by the Senior Special Judge under section 4(2) of the Criminal Law (Amendment) Act, 1958, the Judicial or Metropolitan Magistracy is empowered to entertain, deal with and dispose of any application for bail of an accused in a case under the Act of 2012 under section 497 of the Code of Criminal Procedure. Similarly at the pre-trial stage, in the absence of any express or implied prohibition in any other special law, the Metropolitan or Judicial Magistracy may entertain, deal with and dispose of any application for bail of an accused under section 497 of the Code.”

লক্ষ্য করুন, ২০১৮ সালের শেষের দিকে প্রকাশিত এই জাজমেন্টে মহামান্য বিচারপতি শুধু রিভিশনকৃত মামলায় ম্যাজিস্ট্রেসি’র জামিন দেয়ার এখতিয়ারের কথাই বলেন নি, সেই সাথে সব বিশেষ আইনের মামলায় সংশ্লিষ্ট আইনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নিষেধ না থাকলে ম্যাজিস্ট্রেসি প্রি-ট্রায়াল স্টেজে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারায় আসামীর জামিন দিতে পারবেন বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে বিচারপতি এম.এনায়েতুর রহিম সম্মত হওয়ার সাথে সাথে বৃহত্তর বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রটের দেয়া জামিন বৈধতা পায়। সেই সাথে সারাদেশের বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিশেষ আইনে জামিন এখতিয়ার বিষয়ে সঠিক দিক নির্দেশনা পান। মহামান্য হাইকোর্টের দেয়া এই রায় সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগেও সমর্থিত হয়। অর্থাৎ বিশেষ আইনে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটগণের জামিন দেয়ার এখতিয়ার বিষয়ে আর কোন সংশয় নেই।

হতাশার বিষয় হচ্ছে সুপ্রিমকোর্টের এমন স্পষ্ট রায় ও দিক নির্দেশনার পরও ম্যাজিস্ট্রেসি এখনো পুরনো জড়তা থেকে বের হতে পারছে না। কি এক অজানা আশংকা এখনো তাদের ঘিরে রেখেছে। দেশের বেশিরভাগ ম্যাজিস্ট্রেসি এই রায়ের উপর ভর করে ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এখনো বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটগণ নিজেদের এখতিয়ারহীন ভেবে বিশেষ আইনের মামলা দেখলেই তড়িঘড়ি করে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখান। বিজ্ঞ আইনজীবীগণকেও খুব বেশি সরব দেখা যায় না। বরং এই ধরনের মামলায় জামিনের আদেশ দিলে অনেক আইনজীবী বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে নানান সমালোচনার সাথে অসাধুভাবে লাভবান হওয়ার বায়বীয় অভিযোগ তোলেন। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়! পরবর্তীতে অন্যান্য ম্যাজিস্ট্রেটগণ সমালোচনা এড়াতে আর সাহসী সিদ্ধান্তের দিকে যান না।

সুপ্রিম কোর্টের রায় মানতে অধঃস্তন আদালতগুলো বাধ্য। তবুও বিশেষ আইনের মামলায় হাজারো নির্দোষ’কে যেতে হচ্ছে কারাগারে! বার-বেঞ্চ কেউ আমরা এর দায় এড়াতে পারি না। দেশের প্রত্যেকটা আদালতে এই সংকট নিয়ে বার-বেঞ্চের উপযুক্ত সিদ্ধান্তে আসা এখন সময়ের দাবি। এখতিয়ার যদি না থাকতো তবুও অন্যায়ভাবে কোন নির্দোষকে কারাগারে যেতে দেয়া কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। আর এখানে তো এখতিয়ারের বিষয়টি পরিস্কার। আইনের ত্রুটি বা এখতিয়ার সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে নিরপরাধী সাজা পেলে এর চেয়ে দুঃখজনক কিছু হতে পারে না। বার-বেঞ্চ হাত উঠিয়ে বসে থাকতে পারে না। বিশেষ আইনের মামলা নামক জুজুর হাত থেকে রক্ষা পাক সকল নিরপরাধী। জয় হোক আইনের শাসনের।

লেখক: আইনজীবী, শরীয়তপুর জজ কোর্ট; ই-মেইল: mdshahidulislam0038@gmail.com