আপিলে এক বছরের বেশি সাজা বহাল রয়েছে—এমন কোনো আসামিকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬(২ক) অনুযায়ী কোনো দায়রা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জামিন দেওয়ার এখতিয়ার নেই। এর পরও এই আইন লঙ্ঘন করে ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়রা জজ আদালত থেকে জামিনের ঘটনা ঘটছে।
এমন ঘটনা নজরে আসায় হাইকোর্ট ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এমন আসামিদের জামিন দেওয়াটা বেআইনি। এর পরও অধস্তন আদালত এমন মারাত্মক অবৈধ কাজ করে যাচ্ছেন। দায়রা জজ আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে এমন জামিন দেওয়ার ঘটনা বিচারিক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। ভবিষ্যতে এ ধরনের জামিন না দিতে অধস্তন আদালতের প্রতি নির্দেশনা জারি করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের প্রতি হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালত বলেছেন, এ ধরনের জামিনের ঘটনা জনগণের কাছে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।
তিন বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের দেওয়া জামিনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি এই নির্দেশা দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ধরনের আসামিকে জামিন দেওয়ার ঘটনায় আদালত সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিচারিক দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
আদালত বলেছেন, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে বিচারকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। হাইকোর্টের এই রায়ের আলোকে সব অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রতি নির্দেশনা জারির প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। চলতি সপ্তাহে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. মো. জাকির হোসেন বলেন, হাইকোর্টের রায়ের কপি পেয়েছি। এই কপি পাওয়ার পর প্রধান বিচারপতির অনুমোদন নিয়ে অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রতি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারির কাজ চলছে।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, এক বছরের কম সাজা হয়েছে—এমন ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ দিতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬(২ক) ধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আসামিকে জামিন দিতে পারেন দায়রা আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। তবে এক বছরের বেশি সাজা হয়েছে এবং আপিল আদালতে সেই সাজা বহাল রয়েছে—এমন ক্ষেত্রে কোনোভাবেই জামিন দিতে পারেন না দায়রা জজ আদালত বা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।
রায়ে বলা হয়েছে, ঊর্ধ্বতন আদালতে সাজা বহাল রয়েছে—এমন যেকোনো আসামিকেও ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জামিন দিতে পারেন না।
জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত গত বছর ১১ জানুয়ারি মো. সেলিম নামের এক ব্যক্তিকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে আপিল করেন সাজাপ্রাপ্তরা। ওই আদালত একই বছরের ২০ নভেম্বর রায়ে তাঁদের সাজা বহাল রাখেন। এ অবস্থায় গত ২৬ জুলাই মো. সেলিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. মোস্তফা কামাল গত ৩১ জুলাই মো. সেলিমকে এক মাসের জামিন দেন। জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই গত ২৯ আগস্ট সেলিমের জামিনের মেয়াদ ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। একই বিচারক এই মেয়াদ বৃদ্ধি করেন। আগামী ২৯ অক্টোবর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। এ অবস্থায় ওই সাজা বাতিল চেয়ে নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন মো. সেলিমসহ সাজাপ্রাপ্তরা। এই আপিলের ওপর শুনানিকালে বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ দেখতে পান, আইন লঙ্ঘন করে মো. সেলিমকে জামিন দিয়েছেন এবং জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের মুখ্য বিচারিক হাকিম মো. মোস্তফা কামাল। এ অবস্থায় তাঁকে তলব করেন হাইকোর্ট।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে হাজির হন মোস্তফা কামাল। তিনি বিচারপতিকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে সরল বিশ্বাসে তিনি মামলার নথি না দেখেই জামিন দিয়েছেন।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট তাঁর রায়ে এ বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আশ্চর্যান্বিত হয়েছি যে বিচার বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আইন পর্যালোচনা না করে এবং মামলার নথি না দেখেই জামিন দিয়েছেন। এই কাজে প্রমাণিত হয় যে তাঁর বিচারিক দক্ষতার অভাব রয়েছে।’ সূত্র- কালের কণ্ঠ