মো: জাহিদ হোসেন

মুসলিম বিয়েতে দেনমোহর নির্ধারণ ও বাস্তবতা

দেনমোহর মুসলিম নারীর একটি আইনগত অধিকার। সব সময়ই স্ত্রীর কাছে তা স্বামীর ঋণ যত দিন না তা পুরোপুরি পরিশোধ করা হয়। এমনকি কোনো মুসলিম নারী আদালতের মাধ্যমে বা কাবিননামায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তার স্বামীকে তালাক দিলেও ওই নারীর দেনমোহর পাওয়ার এই অধিকার লোপ পায় না। দেনমোহর আইন এবং দেনমোহর উদ্ধারে মুসলিম নারীর করণীয় সম্পর্কে লিখেছেন মো: জাহিদ হোসেন।

একটি মুসলিম বিয়েতে কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত হলো কনের জন্য দেনমোহর নির্ধারণ। এ ব্যাপারে জোর দিয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা স্ত্রীদের তাদের মোহর দিয়ে দাও খুশিমনে’ (সুরা নিসা : ৪)। আরো বলা আছে, ‘তাকে তার নির্ধারিত মোহর অর্পণ করবে’ (সুরা নিসা : ২৪)। দেনমোহর হলো কিছু টাকা বা অন্য কোনো সম্পত্তি যা স্বামী তার স্ত্রীকে বিয়ের চুক্তি অনুযায়ী দিয়ে থাকে। এটি স্ত্রীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নিদর্শন হিসেবে স্বামীর উপর আরোপিত একটা দায়িত্ব। বিয়ে করলে প্রত্যেক মুসলিম মেয়েই তার স্বামী থেকে এমন টাকা বা সম্পত্তি দেনমোহর হিসেবে পাওয়ার হকদার। স্বামী তা দিতে বাধ্য।

কোনো বিয়েতে দেনমোহরের পরিমাণ কত হবে তা নির্দিষ্ট নয়। কিন্তু কোনো অবস্থায় দেনমোহর নূ্ন্যতম ১০ দিরহাম (প্রায় ২১০ টাকা) বা সমপরিমাণ অর্থের চেয়ে কম নির্ধারণ করা যাবে না। বাস্তবে আমাদের দেশে দেনমোহরের পরিমাণ প্রায়ই বেশ উচ্চ হয়ে থাকে। অনেকের মতে স্বামী যাতে সহজে স্ত্রীকে কারণে-অকারণে তালাক দিতে না পারে তাই সমাজে এই প্রবণতার সৃষ্টি। আর দেনমোহরের পরিমাণ যাই হোক, প্রকৃতপক্ষে বিবাহিতা নারীরা ঠিকভাবে তাদের প্রাপ্য দেনমোহর আদায় করতে পারছে কিনা তা দেখতে হবে! নাকি বিয়ের দেনমোহরের পরিমাণটা এখন সমাজে লোক দেখানো বিষয়ে পরিণত হয়েছে মাত্র! যেন আগে-পরে কনের দেনমোহর আদায় হোক বা না হোক দেনমোহরের পরিমাণ লোক দেখানোর জন্য অনেক বেশি হতেই হবে এমন!

অথচ অনেক সময় দেখা যায় শুধু মোহরের পরিমাণ ঠিক করা নিয়ে কোনো বিয়ে শুরুতেই ভেঙে যায়। তবে দেনমোহরের পরিমাণ যুক্তিসঙ্গত ও বরের সামর্থ্যের মধ্যে হওয়া উচিত। এটি উভয়পক্ষ মিলে ঠিক করবে। এটি নির্ভর করে পাত্র-পাত্রীর পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা, পাত্রের সম্পদের পরিমাণ, পাত্রীর সৌন্দর্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে। এছাড়াও পরিবারের বিবাহিত অন্যান্য নারীর জন্য ধার্য দেনমোহরের সঙ্গে তুলনা করেও তা নির্ধারণ করা যেতে পারে। কাবিনে দেনমোহরের পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। তবে কোনো কারণে দেনমোহর ঠিক না করে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলে বিয়ের পরে তা নির্ধারণ করে নেয়া যাবে উপরিউক্ত বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখে।

যাহোক, মুসলিম আইনে দেনমোহরকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নগদ দেনমোহর আর বাকি দেনমোহর। কোনটা কতটুকু প্রদান করা হবে তা পাত্র ও পাত্রী উভয়পক্ষ আলোচনা করে ঠিক করে নেবে। বিয়ে সম্পন্ন করার সময় কাজির উপস্থিতিতে নগদ দেনমোহর স্বামী সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধ করবে, যদি স্ত্রী তেমনটি চায়। পুরোটা পরিশোধ না করলে বাকি দেনমোহর স্ত্রী ইচ্ছা করলে পরে আদায় করতে পারবে। দেনমোহর কিভাবে পরিশোধ করা হবে, তা স্পষ্ট করে ঠিক করা না হলে পুরোটাই নগদ দেনমোহর হিসেবে ধরা হবে। তখন স্ত্রী দেনমোহর চাওয়া মাত্র স্বামী দিতে বাধ্য থাকবে। প্রয়োজনে স্বামীর কাছ থেকে দেনমোহরের অর্থ আদায় করার জন্য আইনের আশ্রয় নেয়া যাবে। তাছাড়া স্ত্রী তার সম্পূর্ণ দেনমোহর আদায় না করা পর্যন্ত স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য-মিলন করতেও অস্বীকার করতে পারবে। তাই একবার বিয়ে ঠিকভাবে সম্পন্ন হলে এবং স্বামী দেনমোহর দিতে অস্বীকার করলে, নির্ধারিত মোহর আদায় করতে স্ত্রী আইনের দ্বারস্থ হতে পারবে।

মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ অনুযায়ী সালিশি পরিষদের অনুমতি ছাড়া আরেকটি বিয়ে করলে স্বামীকে অবিলম্বে তার বর্তমান স্ত্রীর বা স্ত্রীদের তাৎক্ষণিক (নগদ) অথবা বিলম্বিত (বাকি) দেনমোহরের যাবতীয় টাকা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু অর্থ পরিশোধ করা না হলে তা বকেয়া রাজস্বের মতো আদায় হবে। বিয়ের চুক্তিতে দেনমোহর পরিশোধের পদ্ধতি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলে দেনমোহরের সমগ্র অর্থ ‘চাওয়া মাত্র প্রদেয়’ বলে ধরে নিতে হবে। আবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য-মিলন অর্থাৎ সহবাসের আগে বিবাহবিচ্ছেদ হলে কিংবা স্বামীর মৃত্যু হলে, সম্পূর্ণ দেনমোহরের অর্ধেক পরিশোধ করতে হয়। ১৯৮৫ সালের মুসলিম পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুসারে, দেনমোহরের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, তা আদায়ের জন্য স্থানীয় পারিবারিক আদালতে মামলা করতে হয়। বিবাহ-বিচ্ছেদের তিন বছরের মধ্যে এই মামলা করতে হয়।

তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর কারণে বা অন্য কোনো কারণে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন হলেও স্ত্রী তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার উত্তরাধিকারীদের কাছে এই দাবি করতে পারবে। আবার স্বামীর আগে স্ত্রী মারা গেলেও দেনমোহর মাফ হয় না। স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা এই দেনমোহরের হকদার। তারাও মামলা করার অধিকার রাখে। যদি স্ত্রীর মোহরানা পরিশোধ করা না হয়ে থাকে, তবে অন্যান্য ঋণের মতোই প্রথমে স্বামীর মোট রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে মোহরানা পরিশোধ করতে হবে। বাকি সম্পত্তি ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করা হবে যেখানে মোহরানা দেয়ার পরেও স্ত্রী আবার উত্তরাধিকারী স্বত্বে তার অংশ পাবে। মোহরানা পরিশোধ করায় যদি মৃত স্বামীর সম্পত্তি আর অবশিষ্ট না থাকে, তবে অন্যান্য ঋণের মতো সম্পূর্ণ সম্পত্তি মোহরানা বাবদ স্ত্রীকে সমর্পণ করতে হবে। ফলে ওয়ারিশরা আর কোনো অংশ পাবে না।

তবে একটা বিষয় না বললেই নয়। আমাদের সমাজে অধিকাংশ মানুষ মনে করে, স্বামী বা স্বামীর পরিবার থেকে দেনমোহর আদায় করার জন্য শুধু সরাসরি আদালতেই মামলা করতে হয়। তাই অনেকে সংসার ভেঙে যাওয়ার পরেও বা স্বামী অকারণে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার পরেও থানা-কোর্টের ভয়ে দেনমোহর দাবি করার সাহসটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন। এতে একদিকে যেমন ভুক্তভোগী মেয়েটি আর্থিক নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে অন্যদিকে কিছু পুরুষ এই সুযোগে ইচ্ছে মতো আরো বিয়ে করতে উৎসাহিত হয় যা পরোক্ষভাবে বিভিন্ন সামাজিক অসঙ্গতি সৃষ্টি করে। কিন্তু দেনমোহর আদায় করতে হলে সরাসরি আদালতে মামলা না করে স্থানীয় চেয়ারম্যান বা কমিশনারের সহায়তা নিয়েও তা আদায় করা যায়।

সবচেয়ে ভালো হয় কোনো মানবাধিকার সংস্থা বা এনজিও যেমন : ব্লাস্ট, বিএইচআরএফ, আসক, অধিকার, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি ইত্যাদি সংগঠনের সহায়তা নেয়া। দেশের বিভিন্ন জেলায় এসব সংগঠনের অনেক শাখা রয়েছে। এসব সংগঠন কর্তৃক পরিচালিত আপস-সালিশের মাধ্যমে সহজে ও কম সময়ে কোনো ভুক্তভোগী তার প্রাপ্য দেনমোহর আদায় করতে পারে। এছাড়া এখন সরকার পরিচালিত বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমেও দেনমোহর আদায় করার ব্যবস্থা রয়েছে।

দেনমোহর মুসলিম নারীর একটি আইনগত অধিকার। সব সময়ই স্ত্রীর কাছে তা স্বামীর ঋণ যত দিন না তা পুরোপুরি পরিশোধ করা হয়। এমনকি কোনো মুসলিম নারী আদালতের মাধ্যমে বা কাবিননামায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তার স্বামীকে তালাক দিলেও ওই নারীর দেনমোহরের পাওয়ার এ অধিকার লোপ পায় না। তবে কারো প্ররোচণা বা কোনো রকম চাপ ছাড়া স্ত্রী ইচ্ছা করলে স্বামীকে দেনমোহর সম্পূর্ণ বা আংশিক মাফ করে দিতে পারে। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে বলা আছে, ‘তারা যদি খুশি হয়ে তা (মোহর) থেকে কোনো অংশ ছেড়ে দেয়, তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দ্যে ভোগ করো’ (সুরা নিসা : ৪)। কিন্তু স্ত্রী একবার দেনমোহর সম্পূর্ণ বা আংশিক মাফ করে দিলেও পরে আবার দাবি করলে তখন স্বামী বা স্বামী পক্ষকে দেনমোহর দিয়ে দিতে হবে।

দেনমোহর নারীর একচ্ছত্র অধিকার। তিনি এই মোহরানা দিয়ে যা খুশি করতে পারেন, যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করতে পারেন। তার স্বামী, বাবা, ভাই বা অন্য কারো এ থেকে কোনো অংশ নেয়ার অধিকার নেই। নারীকে যাতে মোহরানার অধিকার থেকে কোনো রীতিনীতি বা ফাঁকফোকর দিয়ে বঞ্চিত করা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা সব সচেতন পুরুষের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।

লেখক : আইনজীবী এবং আইন কর্মকর্তা, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড। মেইলঃ zahidhossainlaw@gmail.com