ফিরে দেখা সুপ্রিম কোর্ট: শেষ পর্ব

ফিরে দেখা সুপ্রিম কোর্ট: শেষ পর্ব

দেশের বিচারাঙ্গনের ইতিহাসে ঘটনাবহুল বছর ২০১৯ সাল। এ বছরে এমন সব ঘটনা সুপ্রিম কোর্টে ঘটেছে যা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সালতামামির আজকের প্রতিবেদনে থাকছে উচ্চ আদালতের একগুচ্ছ সংবাদ যা বছরের বিভিন্ন সময় মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে। বিদায়ী বছর শেষে সেইসব সংবাদ নিয়ে ‘ফিরে দেখা সুপ্রিম কোর্ট: শেষ পর্ব’

প্রথা ভাঙা ভালবাসার জয়
এক হৃদয় নিংড়ানো প্রেমের প্রেক্ষাপটে ব্রাহ্মণ বাবা-মায়ের ঘর ছেড়ে হরিজন বর্ণের ছেলে তুষারকে ভালবেসে বিয়ে করে শরীয়তপুরের মেয়ে সুম্মিতা। কিন্তু এমন প্রথা ভাঙা ভালবাসার অপরাধে সুম্মিতার মায়ের করা মামলায় প্রেমিক তুষারকে যেতে হয় কারাগারে। অন্যদিকে স্বামীকে কারামুক্ত করতে তিন মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে হাইকোর্টে ঘুরতে থাকে সুম্মিতা। অবশেষে গত ১ আগস্ট বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের জামিন আদেশের পর কারামুক্ত হন তুষার। জয়ী হয় সুস্মিতার প্রেম।

জীবন্ত সত্তার মর্যাদা পায় নদী
দেশের নদীগুলোকে জীবন্ত সত্তা এবং লিগ্যাল পারসন ঘোষণা করে এবছর এক ঐতিহাসিক রায় দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ। তুরাগ নদ রক্ষায় মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের করা রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ রায় দেয়া হয়। হাইকোর্ট তার রায়ে বলেন: ‘দূষণ ও দখলের নামে নদীকে হত্যা করা আমাদের সকলের সম্মিলিত আত্মহত্যার নামান্তর। নদীকে হত্যা করার অর্থ হলো বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হত্যা করা। আর নদী দূষণ ও দখলকারীরা দেশের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু, মানবতার শত্রু এবং সভ্যতাকে হত্যাকারী।’

আদালতে জাতির জনকের প্রতিকৃতি
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর বাঙ্গালীর মুক্তি সংগ্রামের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি এবছর টাঙানো হয়েছে দেশের সব আদালতে।

সুপ্রিম কোর্টের তরুণ আইনজীবী সুবীর নন্দী দাসের এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ দেশের সব আদালত কক্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি প্রদর্শন ও সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। এরপরই দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে শুরু করে হাইকোর্ট ও দেশের সব আদালতে জাতির জনকের প্রতিকৃতি টাঙানো হয়।

পাখির বাসায় হানা দিতে হাইকোর্টের মানা
বছর জুড়ে প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার নানা বিষয় হাইকোর্টে আসে। এবছরের অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রজ্ঞা পারুমিতা রায় পাখির বাসা ভেঙে ফেলা নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বিচারপতি এম এনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন। যেখানে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের একটি আমবাগানে কয়েক হাজার পাখির বাসা বাগান মালিক ভাঙতে চান বলে পত্রিকার প্রতিবেদন পড়ে আদালতকে জানান হয়। এরপর হাইকোর্ট ওই আম বাগানের পাখির বাসায় হানা দিতে মানা করে ওই আমবাগান এলাকাকে কেন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। সেই সাথে ওই আমবাগান এলাকাকে পাখিদের অভয়ারণ্য ঘোষণা করলে বাগান মালিক বা ইজারাদারের কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে তা নিরুপন করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন আদালত।

অপ্রয়োজনীয় সিজার রোধে নীতিমালা
বিদায়ী বছরের ৩০ জুন প্রয়োজন ছাড়া প্রসূতির সিজার কার্যক্রম রোধে একটি নীতিমালা তৈরি করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও স্টেক হোল্ডারদের এই কমিটিতে রাখতে বলা হয়েছে। এ কমিটি ৬ মাসের মধ্যে নীতিমালা তৈরি করে আদালতে দাখিল করবেন। জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

নয় মাস বয়সী শিশুর রিট
কর্মক্ষেত্র, এয়ারপোর্ট, বাসস্টপ, রেলওয়ে স্টেশনে, শপিংমলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার ও বেবি কেয়ার কর্নার স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। গত ২৭ অক্টোবর বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। বিচার বিভাগের ইতিহাসে প্রথম নিরাপদ পরিবেশে ও স্বাচ্ছন্দ্যে মায়ের বুকের দুধ পান করতে ৯ মাস বয়সী শিশু উমাইর বিন সাদীর রিটের প্রেক্ষিতে এ রুল জারি করা হয়।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার আব্দুল হালিম। সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান, অ্যাডভোকেট রাশিদুল হাসান ও জামিউল হক ফয়সাল।

কিডনি দান করা নিয়ে রায়
বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নয়, ইমোশনাল কারণে নিকট আত্মীয়র বাইরে পরিচিত কিংবা সম্পর্ক আছে এমন ব্যক্তিকে বিশেষ পরিস্থিতিতে কিডনি বা অঙ্গ দান করতে পারবেন বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালতের এই নির্দেশনা বিদ্যমান আইন সংশোধন করে ৬ মাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে।

বিদায়ী বছরের ৫ ডিসেম্বর বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খন্দকার দিলীরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। আদালতে রিটের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম।

পরকীয়ার আইন নিয়ে হাইকোর্টের রুল
পরকীয়ার সাজা সংক্রান্ত দণ্ডবিধির (পেনাল কোড) ৪৯৭ ধারা কেন অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে গত ৮ জুলাই রুল জারি করেন হাইকোর্ট। তিন সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসানের করা রিটের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন।

দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী, কোনো স্ত্রী পরকীয়া করলে যার সঙ্গে পরকীয়া করবে শুধু সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। অথচ স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর কিছুই করার নেই। একইভাবে স্বামী পরকীয়া করলে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে বা যার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত হবেন, তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার পাবেন না।

রিটকারী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, এ আইন সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এটা অদ্ভুত ও বৈষম্যমূলক।

খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের নির্দেশনা
বিচারাধীন মামলার বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন থেকে বিরত থাকতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে গত ১৬ মে বিজ্ঞপ্তি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আলোচনা তৈরি হলে ২১ মে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল ড. জাকির হোসেনের সই করা আরেক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সবসময় সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবে আদালতের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এবং বিচারকাজ প্রভাবিত করে- এমন সংবাদ পরিবেশন ও প্রচার প্রত্যাশিত নয়।

আরও পড়ুন: ফিরে দেখা সুপ্রিম কোর্ট: প্রথম পর্ব

আরও পড়ুন: ফিরে দেখা সুপ্রিম কোর্ট: পর্ব-২

আরও পড়ুন: ফিরে দেখা সুপ্রিম কোর্ট: পর্ব-৩