আশফাকুর রহমান:
বাংলাদেশের আর্থ-সমাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার নিরিখে সামাজিক মূল্যবোধ বা নৈতিকতার ভিত্তি স্থাপনের পাশাপাশি সামগ্রিক সমৃদ্ধিতে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবনের ফলে দেওয়ানি প্রকৃতির পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে প্রণীত হয় পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ নামে বিশেষ আইন এবং সে আইনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয় পারিবারিক আদালত নামে পৃথক ও স্বতন্ত্র আদালত। পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কারণে একটি পরিবারের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তথা স্বামী-স্ত্রী যাদের ওপর একটি পরিবারের অস্তিত্ব নির্ভরশীল; তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব যখন পরিবারের সব সদস্য, এমনকি স্থানীয়দের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন সেই দ্বন্দ্ব নিরসনের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিবারের সদস্য আদালতের দ্বারস্থ হয়। দ্বন্দ্ব যাতে বিশেষ ক্ষেত্রে অধিকতর তিক্ততা, জটিলতা ও হয়রানির কিংবা পরিবার ভাঙনের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সে উদ্দেশ্যে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ আইনের ১১ ও ১৩ ধারায় পারিবারিক মামলার শুরুতে ও শেষে দুটি পর্যায়ে প্রি-ট্রায়াল ও পোস্ট-ট্রায়াল নামে আদালতভিত্তিক বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়েছে। আদালতভিত্তিক বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির এ বিধান যেমন প্রতিকারপ্রাপ্তি সহজীকরণে ও মামলা জট এড়াতে কার্যকরী, তেমনি একটি পরিবারের অস্তিত্ব রক্ষায় এক অগ্রণী প্রয়াস।
দুঃখজনক হলেও সত্য, পারিবারিক মামলার পদ্ধতিগত বিভিন্ন ধাপের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অবাস্তবায়িত ও উপেক্ষিত ধাপ হলো প্রি-ট্রায়াল ও পোস্ট-ট্রায়াল পর্যায়ের আদালতভিত্তিক বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির ধাপটি। আদালত যখন পারিবারিক মামলায় প্রি-ট্রায়াল ও পোস্ট-ট্রায়াল পর্যায়ে বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি তারিখ ধার্য করেন, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পক্ষগণসহ উভয় পক্ষের আইনজীবীরা সেই ধার্য তারিখে কোনো পদক্ষেপ ছাড়াই অনুপস্থিত থাকেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির ধাপটি ব্যর্থ হয়, দীর্ঘায়িত হয় বিচারপ্রার্থী জনগণের বিচারপ্রাপ্তি। অথচ আদালতভিত্তিক বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির এই বিধান সম্পর্কে বিচারপ্রার্থীর অজ্ঞতা, আইনজীবীদের অনীহা, প্রতিকারপ্রাপ্তি সহজীকরণের প্রয়াসে প্রণীত এই বিধানটিকে কার্যত আইনের কালো অক্ষরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। স্বল্প সময়ে, দ্রুত প্রতিকার প্রদানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও উপর্যুক্ত অসহযোগিতা, বিধানটির শিথিলতা ইত্যাদি কারণে আদালতকে প্রতিকার প্রদানে দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে পড়তে হচ্ছে; সঙ্গে অনাবশ্যকভাবে ব্যয় হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা।
উপর্যুক্ত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পারিবারিক বিরোধে যেখানে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান, সেক্ষেত্রে প্রি-ট্রায়াল পর্যায়ে যেদিন আদালতভিত্তিক বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দিন ধার্য থাকবে, সে ধার্য তারিখে পক্ষদ্বয়সহ আইনজীবীদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করে বিবাদীর উপস্থিতি ব্যর্থতায় একতরফা ও বাদীর উপস্থিতি ব্যর্থতায় মামলা খারিজের বিধান করে সংশোধনী আনা আবশ্যক। এ সংক্রান্ত বিধানকে আরও যুক্তিযুক্ত এবং কার্যকর করার মাধ্যমে মামলার প্রাথমিক পর্যায়ে সিংহভাগ মামলার নিষ্পত্তির লক্ষ্যে প্রি-ট্রায়াল ধাপে এডিআর পর্যায়ে প্রতিটি পক্ষের একটি করে সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ দুটি মুলতবির বিধান রাখা যেতে পারে। এতে করে প্রি-ট্রায়াল পর্যায়েই অধিকাংশ মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব হবে, হয়তো ঠেকানো যাবে একটি পরিবারের অনাকাঙ্ক্ষিত ভাঙন। বিশেষ করে সরকারি আইনগত সহায়তায় পরিচালিত পারিবারিক মামলার ক্ষেত্রে কম খরচে, হয়রানি এড়িয়ে দ্রুত প্রতিকার প্রদানে এ বিধান হবে অত্যন্ত কার্যকর।
এডিআর পদ্ধতিতে পারিবারিক মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে আইনজীবীদের উৎসাহিত করতে এডিআর কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সর্বোচ্চ সংখ্যক মোকদ্দমা নিষ্পত্তিতে সহায়তা ইত্যাদি বিবেচনায় প্রতিটি জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের শ্রেষ্ঠ তিনজন আইনজীবীকে জেলা পর্যায়ে বার্ষিক বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে এবং প্রতি বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা প্রদানের ব্যবস্থা চালু করা বাঞ্ছনীয়। আদালতভিত্তিক মধ্যস্থতা অনুষ্ঠানের নিমিত্তে প্রতিটি আদালতে একটি মধ্যস্থতা কক্ষ স্থাপন করা যেতে পারে। এজলাস বা বিচারকের খাস কামরা অপেক্ষা মধ্যস্থতা কেন্দ্রে বসে বিরোধ নিষ্পত্তি এডিআরকে অবশ্যই আলাদা মাত্রা ও মর্যাদা দেবে।
প্রি-ট্রায়াল ও পোস্ট-ট্রায়াল পর্যায়ে আদালতভিত্তিক বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনি পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা, ২০১৫-এর অধীনে লিগ্যাল এইড অফিসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনি পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা, ২০১৫-এর বিধি-৩-এর অধীনে লিগ্যাল এইড অফিসার বিচারপ্রার্থীকে বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আইনি পরামর্শ প্রদান করে থাকেন এবং বিধি-৪-এর অধীনে আপস-মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন। আইনি পরামর্শ প্রদান এবং আপস-মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহণ উভয় ক্ষেত্রে লিগ্যাল এইড অফিসার প্রি-ট্রায়াল ও পোস্ট-ট্রায়াল পর্যায়ে আদালতভিত্তিক বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান সম্পর্কে বিচারপ্রার্থীকে অবহিত তথা সচেতন করতে পারেন।
তাছাড়া প্যানেল আইনজীবীদের এই বিষয়ে বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে এলে এবং বিচারক এই বিষয়টি তদারকি করতে সক্ষম হলে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ আইনের ১১ ও ১৩ ধারায় বর্ণিত আদালতভিত্তিক বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির বিধানটি আরও ফলপ্রসূ হবে। স্বল্প ব্যয়ে স্বল্প সময়ে নিশ্চিত হবে ন্যায়বিচার।
লেখক: সহকারী জজ ও বিচারক পারিবারিক আদালত, রংপুর।
সূত্র- সমকাল