এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার:
সামগ্রিক কল্যাণ আজ বড়ই প্রাসঙ্গিক ভাবনা। বিগত কাল বিবেচনার পুরোটা জুড়েই কল্যাণের কেবলমাত্র খন্ডিত অংশ মানবজাতি বিদ্যাবুদ্ধি, বিবেচনা ও গবেষনা দ্বারা লব্দ করে তার চর্চা করেছে এবং চেতনায় কেবল মাত্র সেটুকুই খুব ভাল করে আত্নস্থ করতে পেরেছে। ফলে মানবজাতি এত বেশি আত্নকেন্দ্রিকতা চর্চা করেছে যে প্রত্যেকেই তার নিজেকে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থাপন করার অশুভ প্রতিযোগীতায় মত্ত হয়ে নিজেদের সুখ শান্তি আর ক্ষমতাকে দৃশ্যমান করার কাজেই আদি হতে আজ পর্যন্ত ব্যস্ত থেকেছে। বিশ্ব বৈষম্য বিশ্লেষণ করলে রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত ‘সকলের তরে সকলে আমরা’- এ নীতিটাই কেবল চর্চিত হতে দেখলাম।
মানুষের হাত ধরে গোটা বিশ্ব যতটাই বিবর্তিত হয়েছে যতটাই আধুনিকতা লাভ করেছে শুরু থেকে আজও পর্যন্ত তা সামগ্রিক কল্যাণের নীতি বা শিক্ষাকে বিবেচনায় রেখে হয়নি সেটা তো খুব পরিস্কার। এটা এখন থেকে তিন মাস আগে হলে বিশ্বাস করাটা খুবই কঠিন হতো কিন্তু Covid-19 চলমান সময়ে এমন বিশ্বাসটাই যথার্থ মনে হচ্ছে।
কামিনী রায়ের সেই চিরসুন্দর সর্বজনবিদিত মানবিক ও মানবতাবাদী চিন্তাকেই আমরা আজীবন সাধুবাদ দিয়ে আসছি। যার শুরুটা ছিল নিজ কেন্দ্রিক অতঃপর সকল কেন্দ্রিক বা সামগ্রিক। ফলে নিজের কল্যাণ সাধন করা নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে জিবনের যে স্বাদ যে লাইফ স্টাইল মানবজাতি উপলব্দি করতে শিখল সেটুকুই চিরন্তন ও সর্বসুখ হিসেবে রুপ লাভ করল মানুষের মধ্যে। যাত্রা শুরু থেকে ২১ শতক পযর্ন্ত সে টুকুর চর্চাকেই গুরুত্ব দিল বিশ্বনেতারাও। দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য দ্বিতীয় বাক্যাংশের অতিমানবিক অংশটুকু ‘প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’ মানুষের মনে স্থায়ীভাবে জায়গা তৈরী কিংবা চর্চাতে খুব একটা অবস্থান করতে পারলনা। এবং এখানেই পৃথিবীর জন্য আজকের দূর্ভাগ্য অপেক্ষা করছিল। বাক্যের দ্বিতীয় অংশই ছিল সামগ্রিক কল্যাণের বার্তা আর সেটির চর্চা দিয়ে যদি মানবজাতি বিশ্ব গঠনের প্রয়াস নিত খন্ডিত অংশের চর্চা না করে হয়তো আজকের কোভিড-১৯’ র এমন তান্ডব সারা বিশ্বকে দেখতে হতো না!
‘প্রত্যেকে মোরা পরের তরে অত:পর যদি হত সকলের তরে সকলে আমরা।’ তাহলে মানুষ নিজের স্বার্থটা দেখার আগে অন্যের বা অন্য সকলের কল্যাণটা মাথায় রেখে নিজের কাজটা করতে শিখতো এবং শুরু থেকে আজ পর্যন্ত চর্চিত হলে নিশ্চয়ই সামগ্রিক অর্থেই প্রকৃত কল্যাণমূখী মানবিক বিশ্ব উপহার দিতে পারত মানব জাতি।
শিক্ষার্জন করে আত্নকর্ষনের মেশিনে ফিল্টার না করলে একজন মানুষ সে শিক্ষা থেকে দীক্ষা অর্জন করতে পারেনা। কেননা শিক্ষার সাথে দীক্ষাযুক্ত হয়ে কার্য সম্পাদিত হলে সেটি অবশ্যই অধিক উৎকর্ষ লাভ করে। শিক্ষা থেকে দীক্ষা পর্যন্ত আসতে ফিল্টারিং ম্যাকানিজমে অন্তত অশুভ টুকু বিনাশ হতেই হয়। অন্যথায় প্রকৃত দীক্ষা অর্জন করা সম্ভব নয়। আজ কবি জননী বেঁচে থাকলে তাকে অনুরোধ করতাম আপনি বাক্যের শেষাংশকে প্রথমাংশ করুন আর প্রথম অংশটুকু দ্বিতীয় বাক্যাংশ করে দিন তাহলেই কেবল কারোনাত্তোর পৃথিবী জ্ঞানের চর্চায় ‘প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’ এ বাক্যাংশের অর্থ দিয়ে যাত্রা শুরু করলে স্বাভাবিক সুন্দরের চর্চা শুরু হবে। তখন রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে ব্যক্তি মানস একযোগে মানবিক বিশ্ব গড়ার মিছিলে অংশগ্রহণ করবে। এভাবেই কেবল এক নতুন যাত্রা নতুন মাত্রার অনিন্দ্য সুন্দর মানবিক বিশ্ব গড়ে উঠবে খুব সহজে। অতি প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করতে শিখবে মানুষ ভূপেন হাজারিকার অনবদ্য মানবিক উচ্চারণ- বল কি তোমার ক্ষতি/জীবনের অথৈ নদী/পার হয় তোমাকে ধরে/দূর্বল মানুষ যদি।
মানবজাতির এই একমুখী নিজ বা স্বার্থকেন্দ্রিক ভাবনা এবং কর্মই আজ মানুষকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছে তাতে কোনাে সন্দেহ নাই। কাজেই সময় এসেছে সুন্দরের চর্চায় অভ্যস্ত করা অন্যথায় আর কোন বিকল্পই নাই। মানব জাতিকে নতুন করে একটি মানবিক বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত ধ্যান ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে ‘প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’ এই লক্ষে কাজ শুরু করতে হবে।
বদ মনোবৃত্তি গুলোকে মানুষ এই কোয়ারেন্টাইনের মধ্যে যদি গলাচিপে ধরে বাধ্য করাতে পারে আর কোন অপরাধে অংশগ্রহণ করবে না কোনভাবেই। তাহলে একটি ভাল ফল প্রত্যাশা করা যায়।সেটি কিন্তু সম্ভবও ।আপনাকে আমাকে এই বদরিপুর সাথে যুদ্ধ করে বোঝাতে হবে তাদের কারনেই মানুষ হিসেবে আমরা আজ গৃহবন্দী। আর করোনার প্রভাব ভয় আতংক এমনিতেই এখন এক্ষেত্রে আপনাকে আমাকে অনেক বেশি সহযোগীতা করছে। ভেবে দেখুন আপনি আমি কিন্তু আর কোন অপরাধ করছি না বরং ভয়ে ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছি এই কোয়ারেন্টাইন সময়ে।
আমরা যদি বদ রিপুকে শাসন করতে চাই তাহলে এখনই উপোযুক্ত সময়। এখন পরিস্থিতি কিন্তু আপনার আমার অনুকুলে। করোনা না আসলে এই শাসন করার কাজটা আমাদের উপলব্ধিতে আনাটাই সম্ভব ছিল না। এ শাসন যদি মানুষ হিসেবে করতে অভ্যস্ত হতে পারি সেক্ষেত্রে মন্দ প্রবৃত্তি গুলো কোনঠাসা হবে এবং মন্দ প্রবৃত্তি গুলি ধিরে ধিরে তাদের কার্যক্ষমতা হারাতে থাকবে। মন্দ কিংবা অশুভ তাদের কার্যক্ষমতা হারাতে থাকলে বিপরীতে ভালোগুন গুলি দিয়ে বৃত্তের খালি জায়গা পূরণ হতে থাকবে। এক পর্যায়ে সুন্দর দিয়ে বেশির ভাগ বৃত্ত ভরে গেলেই আমরা মানবিক বিশ্বের সূচনা করতে পারব নিঃসন্দেহে।
মানুষ শুধু প্রকৃতির গাছ পালা বা বনায়ন ধ্বংস না করা, পানি দূষিত না করা, বণ্য প্রাণী ধ্বংস না করা, বাতাসে দূষণ না করার মত কাজ গুলি থেকে বিরত থাকার প্রত্যয়ী হলে ভেবে দেখেছেন এইভাবেই প্রকৃতি তার ভারসাম্য ফিরে পাবে এবং আমাদেরকে কতটাই না সুন্দর রাখতে পারে! অভিশপ্ত প্রাণীকুল আজ স্বাধীনভাবে কোলাহল করতে পারছে। আমরাই এ সকল জীবকুলকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলাম তাই আজ আমরা ঘরবন্দী আর মুক্ত স্বাধীন ওরা। এ স্বাধীনতা ওর প্রাপ্যছিল সব সময়ই কিন্তু আমরা ওদের এ স্বাধীনতায় বাধা দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করেছি ওদের সাথে। মনে করিনি একবারও যে ওরাও প্রকৃতির অনন্য সম্পদ।
মন্দ চর্চায় মানুষের মস্তিস্ক এতটাই অভ্যস্ত যে মৃত্যু জেনেও আমরা নিজেকে নিরাপদ করার চেষ্টায় অনেক বেশি গাফিলতি করছি। মানুষ হিসেবে নিজেকে মেরে ফেলাটাও ধর্মমতে পাপ আর খোলা চোখে তা দন্ডনীয় অপরাধ। সেখানে নিজে আক্রান্ত হলে সে যে অন্য আরো অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে সেই শুভ বোধ জাগ্রত করার কেউ কেউ এখনও নূন্যতম চেষ্টাই করছেনা।
কারন একটাই, মন্দ দিয়ে এখনও বৃত্ত ভরা। তাই বলি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখন কোভিড-১৯’র চুড়ান্ত পর্যায় অর্থাৎ মৃত্যু পর্যায় চলছে। তাই আবারো বলছি এখন আর সরি বলার কোন সুযোগ নাই। আমরা সবাই চাই নতুন পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে । নতুন পৃথিবী হোক প্রত্যাশিত মানবিক বিশ্ব যার সবটুকুই গড়ে উঠুক যা কিছু অন্যের জন্য কল্যানকর শুভ তা আমার জন্য ও কল্যাণকর শুভ এরকম শিক্ষা দীক্ষা ও উপলব্ধি দিয়ে।
সকল অশুভ যা মানুষ ও প্রকৃতির অকল্যাণ করে, সুন্দর ও শুভ চর্চার মধ্যে দিয়ে তা যেন বিনাশ করতে পারি। আর সুন্দরের চর্চা দিয়ে নতুন মানবিক বিশ্ব গড়ে তুলতে পারি সে লক্ষে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছেও প্রার্থনা করি আমাদেরকে সে শক্তি দিন সাহস দিন সামর্থ্য দিন এবং এ প্রত্যাশা ও প্রার্থনা আপনি কবুল ও মঞ্জু করুন।পরিশেষে বলতে চাই হে মানুষ ! চলুন সকলে মিলে এ ক্ষেত্রে আমরা আত্মস্থ করি সেই সাথে অতিপ্রাসঙ্গিক বিবেচনা করি ভুপেন হাজারিকার অনবদ্য মানবিক উচ্চারন ও মানবতার জয়গান –
মানুষ মানুষের জন্যে
জীবন জীবনের জন্যে
একটু সহানুভূতি
মানুষ কি পেতে পারে না…………….ও বন্ধু ……….!