মনজিলা সুলতানা ঝুমা, আইনজীবী
মনজিলা সুলতানা ঝুমা, আইনজীবী

বিবাহ, মোহরানা ও তালাক নিয়ে ভ্রান্ত ধারণায় আইন কি বলে?

মনজিলা সুলতানা ঝুমা :

আমাদের দেশে এখনও অধিকাংশ মানুষ বিবাহ, মোহরানা এবং তালাক সম্পর্কে ভুল ধারনা পোষণ করেন, যা নারী নির্যাতনের অন্যতম একটি কারন।

সাধারণ মানুষ বিবাহ ও মোহরানা নিয়ে যে ভুল ধারণাগুলো পোষন করেন তা হলো,

১। কোর্ট ম্যারেজ শক্ত একটা জিনিস এর মাধ্যমে বিয়ে করলে বিয়ে শক্ত এবং আইনগত হয়।

২। অনেকেই ভেবে থাকেন মোহরানা বা দেনমোহর ইচ্ছে মত কাবিনে বসিয়ে দিয়ে বাসর রাতে বউয়ের কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিলেই হবে।

৩। স্ত্রী ডিভোর্স দিলে মোহরানা বা কাবিনের টাকা দিতে হয় না।

এই সকল বিষয় ভেবে অনেক পুরুষ নারী নির্যাতন করেন এবং স্ত্রীকে বাধ্য করান যাতে স্ত্রী ডিভোর্স দেন। অপরদিকে, অনেক নারী ভাবে যত অন্যায় হোক আমি ডিভোর্স দিব না, সে তার সেইফটির বা নিরাপত্তার কথা ভেবে অত্যাচার সহ্য করে।

আসুন উপরের বিষয়গুলো সম্পর্কে আইন কি বলে বিস্তারিত জেনে নেই।

বিভিন্ন ধর্মে বিয়ে এবং প্রচলিত কোর্ট ম্যারেজ :

মুসলিম বিবাহ:

বিবাহের আরবি শব্দ হলো ‘নিকাহ’ যার অর্থ একত্রে অংশগ্রহন। ইসলামে বিবাহ হলো একটি দেওয়ানি চুক্তি এবং বিবাহের অন্যতম দুইটি প্রধান শর্ত হলো এক পক্ষ কর্তৃক প্রস্তাব প্ৰদান এবং অন্য পক্ষ কর্তৃক প্রস্তাব গ্রহণ। মুসলিম বিবাহ প্রাপ্ত বয়স্ক দুই জন পুরুষ বা একজন পুরুষ ও দুইজন নারী সাক্ষীর উপস্থিতিতে সম্পাদন করতে হয়। মুসলিম আইনে সাবালকত্ব বা বয়ঃসন্ধি বিবাহের যোগ্যতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ অনুযায়ী ছেলে ও মেয়ের বিয়ের বয়স যথাক্রমে ২১ ও ১৮ বছরে নির্ধারণ করা হয়েছে। উল্লেখিত বয়সের চেয়ে কম বয়সে ছেলে বা মেয়ের বিবাহ হলে বিবাহটি বৈধ তবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

মুসলিম বিবাহ নিবন্ধন :

মুসলিম বিবাহ ও বিচ্ছেদ নিবন্ধন আইন, ১৯৭৪ এর ৩ ধারা অনুযায়ী মুসলিম বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। এই আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী বিবাহ নিবন্ধক নিজেই যদি বিবাহ সম্পাদন করেন তাহলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবেই বিবাহ নিবন্ধন করবেন। তবে অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক বিবাহ সম্পাদিত হয়ে থাকলে, বর বিয়ে সম্পাদনের ৩০ দিনের মধ্যে বিবাহ নিবন্ধকের কাছে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করে নিবেন। বিবাহ নিবন্ধন না করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং ২ বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।

হিন্দু বিবাহ:

হিন্দু বিবাহ বলতে বোঝায় রাষ্ট্রে বসবাসকারী হিন্দুদের বিবাহ-সংক্রান্ত নিজস্ব প্রথা ও রীতিনীতি অনুযায়ী সম্পাদিত বিয়ে। হিন্দু বিবাহ হচ্ছে একটি পবিত্র আচার অনুষ্ঠান। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সপ্তপদী ও অগ্নি-সাক্ষী হিন্দু বিবাহের অন্যতম দুইটি প্রধান শর্ত হিসাবে গণ্য করা হয়। হিন্দু বিয়ের বয়সের ক্ষেত্রেও বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭ প্রযোজ্য হবে, অর্থাৎ ছেলে ও মেয়ের বিয়ের বয়স যথাক্রমে ২১ ও ১৮ বছর। উল্লেখিত বয়সের চেয়ে কম বয়সে ছেলে বা মেয়ের বিবাহ হলে বিবাহটি বৈধ হবে, তবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন:

হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়। হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন, ২০১২ এর ৩ ধারা অনুযায়ী অন্য কোন আইন, প্রথা ও রীতি-নীতিতে যা কিছুই থাকুক না কেন, হিন্দু বিবাহের দালিলিক প্রমাণ সুরক্ষার উদ্দেশ্যে হিন্দু বিবাহ, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, নিবন্ধন করা যাবে। তবে নিবন্ধন না করলেও সেই কারণে কোন হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সম্পন্ন বিবাহের বৈধতা ক্ষুণ্ন হবে না।

খ্রিস্টান বিবাহ:

বাংলাদেশের খ্রিস্টান নাগরিকদের বিবাহ খ্রিস্টান বিবাহ আইন ১৮৭২-এর বিধান মোতাবেক সম্পন্ন হয়ে থাকে। বিবাহে পাত্রপাত্রীর একজন বা উভয়ে খ্রিস্টান হলে তাদের বিবাহে এমন এক ব্যক্তি পৌরোহিত্য করেন যিনি বিশপের দীক্ষা পেয়েছেন কিংবা যিনি স্কটিশ চার্চের একজন যাজক বা এ আইনের আওতায় অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো ধর্মযাজক। কোনো বিবাহ-নিবন্ধক বা এ আইনের আওতায় নিযুক্ত/লাইসেন্সপ্রাপ্ত অপর কোনো ব্যক্তির উপস্থিতিতে বিবাহ সম্পন্ন করতে হয়।

খ্রিস্টান বিবাহ নিবন্ধন:

খ্রিস্টান বিবাহ আইন ১৮৭২ অনুযায়ী খ্রিস্টানদের জন্য বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। খ্রিস্টান বিয়ে যিনি বিয়ে সম্পাদন করেন তিনিই বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করবেন।

বৌদ্ধ বিবাহ:

বৌদ্ধ বিয়ে, বাংলাদেশে বৌদ্ধ বিয়ে লোকাচার ও বৌদ্ধ শাত্র অনুসারে সম্পাদিত হয়। পাত্র পাত্রী নির্বাচনের পর সামাজিকভাবে সবাইকে জানিয়ে তারিখ ঠিক করে বৌদ্ধ বিহারে পাত্র-পাত্রীকে নিয়ে আসা হয়। এখানে মঙ্গল প্রদিপ জ্বালিয়ে বুদ্ধের পুজা করা হয়। ত্রি স্বরণ পঞ্চশীল পুজার মাধ্যমে বৌদ্ধ ভিক্ষুকের আশির্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন হয়।

বৌদ্ধ বিবাহ নিবন্ধন:

অন্যান্য সম্প্রদয়ের বিবাহ ও বিবাহ নিবন্ধন আইন থাকলেও বৌদ্ধদের জন্য সুনিদির্ষ্ট কোন বিবাহ বা বিবাহ নিবন্ধন আইন নেই। বৃটিশ আমল থেকেই হিন্দু পারিবারিক আইন বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের  জন্য প্রযোজ্য ছিল। বর্তমানেও হিন্দু পারিবারিক আইন বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

ভিন্ন ধর্মালম্বীদের বিবাহ/বিশেষ বিবাহ:

বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ অনুযায়ী ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিয়ে সম্পাদিত হয়। এ আইনের অধীনে বিয়ের ক্ষেত্রে প্রথমেই দুই পক্ষকে আলাদাভাবে ধর্ম ত্যাগের ঘোষণা দিতে হয়। বিয়ের সময় কোন পক্ষেরই স্বামী/ স্ত্রী জীবিত থাকা যাবে না। বিয়ের সময় ছেলের বয়স ১৮ বছর এবং মেয়ের বয়স ১৪ বছর পূর্ণ হতে হবে।

বিশেষ বিবাহ নিবন্ধন:

বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ অনুযায়ী বিয়ে সম্পাদনের ১৪ দিন পূর্বেই পূর্বেই বিয়ের ইচ্ছে পোষণ করে খ্রিস্টান বিবাহ নিবন্ধকের কাছে নোটিস দিতে হয়। নোটিস প্রদানের পর নিবন্ধক বিয়ের বিষয়ে খোঁজ খবর নিবেন এবং ১৪ দিনের মধ্যে যদি কোনো ব্যক্তি বিয়ের বিষয়ে আপত্তি না করেন, তাহলে নোটিস প্রদানের ১৪ দিন পর তিনি বিয়ে নিবন্ধন করতে পারবেন।

কোর্ট ম্যারেজ:

আইনে কোর্ট ম্যারেজ বলে কোনো বিধান নেই। আইন অনুযায়ী কোর্ট ম্যারেজের মাধ্যমে কোনো বিবাহ হয় না। এটি একটি লোকমুখে ব্যবহত প্রচলিত শব্দ। প্রচলিত অর্থে কোর্ট ম্যারেজ বলতে সাধারণত হলফনামার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিয়ের ঘোষণা দেওয়াকেই বোঝানো হয়ে থাকে। এ হলফনামাটি ২০০ টাকার ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে লিখে নোটারি পাবলিক কিংবা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। এটি বিয়ের ঘোষণামাত্র। অর্থাৎ এ হলফনামার মাধ্যমে বর-কনে নিজেদের মধ্যে আইন অনুযায়ী বিয়ে হয়েছে, এ মর্মে ঘোষণা দেয় মাত্র। কেউ চাইলে বিয়ে সম্পাদন ও নিবন্ধনের পরে হলফনামার মাধ্যমে বিয়ের ঘোষণা দিতে পারে।

মোহরানা ও তালাক নিয়ে আইনের বিধান:

আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় তালাকের নোটিশ পাঠান অর্থাৎ স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক দিলে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে না। এটি একটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। স্ত্রী তালাক দিলেও স্বামীকে মোহরানা পরিশোধ করতে হবে। স্ত্রী তালাক প্রদানের পর মোহরানা, ইদ্দতকালীন ভরণপোষণ ও বকেয়া ভরণপোষণ (যদি থাকে) এর জন্য পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন। স্ত্রী যদি বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে চান তাহলে তখন দেখতে হবে কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামটিতে তালাকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে কিনা (যেটি তালাক-ই-তৌফিজ নাম পরিচিত), যদি ১৮ নম্বর কলামে কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়, তাহলে খুব সহজেই মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর বিধান অনুসরণ করে নোটিশ প্রদানের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। তবে ক্ষমতা প্রদান করা না থাকলে, মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ এর ২ ধারায় উল্লেখিত ৯ টি কারণের এক বা একাধিক কারণে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। এছাড়াও আরো ২ভাবে স্ত্রী কর্তৃক বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো যায়, একটি হলো খুলা তালাক ও অপরটি হলো মুবারাত। খুলা তালাকের ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীকে তালাকের প্রস্তাব প্রদান দেন এবং স্বামী উক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এই ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীকে প্রতিদান দেন। সাধারণত স্ত্রী প্রতিদানস্বরূপ সম্পূর্ণ বা আংশিক মোহরানার দাবি পরিত্যাগ করে থাকেন। মুবারাত হচ্ছে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই বিবাহ বিচ্ছেদ চায়, উভয়ে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে চুক্তির মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটান।

নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন জানা খুবই জরুরি। সমাজে প্রচলিত এসকল ভ্রান্ত ধারণা থেকে আমাদের সকলকে বের হয়ে আসতে হবে। দেনমোহর যে নারীর প্রাপ্য অধিকার এই সম্পর্কে নিজে সচেতন হবার পাশাপাশি অন্যকে সচেতন করতে হবে। কোর্ট ম্যারেজের এর আইনগত ভিত্তি সম্পর্কে ও জানতে হবে। এই সকল প্রচলিত ধারণা থেকে বের হয়ে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই।

মনজিলা সুলতানা ঝুমা : আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা ও খাগড়াছড়ি।