অ্যাডভোকেট পার্থ প্রতিম বড়ুয়া

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং কিছু কথা

পার্থ প্রতিম বড়ুয়া সিংহ:

ঘটনা-১
কবির হোসেন (ছদ্মনাম) একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক। সচিবালয় থেকে শুরু করে সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি এবং অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখি করেন। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে তিনি বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ ৩ জন পুলিশ সদস্য তার পথ অবরোধ করে তাকে থানায় নিয়ে যায়। পরে তিনি জানতে পারলেন তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।

ঘটনা-২
শাখাওয়াত রিজভী (ছদ্মনাম) তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানীতে অ্যাকাউন্টেড হিসেবে কর্মরত। দেশে করোনা পরিস্থিতির পর থেকে তিনি স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতি নিয়ে তার ফেসবুকে বিভিন্ন ষ্ট্যাটাস দেন। একদিন সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য তিনি তৈরী হচ্ছিলেন, হঠাৎ কলিং বেল বাজলে তিনি দরজা খুলে দেখেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য তার সম্মুখে দাড়িয়ে। তারা তাকে এ্যারেষ্ট করতে এসেছে কারন তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।

ঘটনা-৩
সুপতি চৌধুরী (ছদ্মনাম) একটি স্বনামধন্য গনমাধ্যমের সাংবাদিক। দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে লেখালেখি করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং তিনি গ্রেপ্তার হন।

উপরোক্ত তিনটি ঘটনার সঙ্গে কমবেশি সকলেই পরিচিত। কেননা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এমন সংবাদ দেখেছেন অনেকেই। বিলুপ্ত তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়েরকৃত এমন অনেক মামলা বিচারাধীন। পাশাপাশি নতুন করে করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও এ ধরণের মামলা আমরা দেখেছি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কি? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে ২০১৮ সালের ৪৬ নং আইন। ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত একটি আইন। মূলত তথ্য প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ ৫৪, ৫৫, ৫৬ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত করে ২০১৮ সনের ১৮ সেপ্টেম্বর কন্ঠভোটের মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ পাশ হয়।

তবে এই আইনের ক্ষেত্রেও গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের কর্মীসহ বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। কেননা তাদের মতে, ৫৭ ধারায় অপরাধের ধরণগুলো একসাথে উল্লেখ ছিল। এই আইনের মাধ্যমে যা বিভিন্ন ধারায় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া এই আইনের ৩২ ধারায় সাংবাদিকরা বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে পারে বলে আশংকা করা হয়। এক্ষেত্রে আমি যেহেতু কোন রাজনীতিবীদ বা আইন গবেষক নয় সেহেতু এই আইনের পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু বলার নেই। বরং একজন আইনজীবী হিসেবে সংসদে পাশকৃত যেকোনো আইনকে আমি সমর্থন করি।

অনেকের মতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন বা জবাবদিহিতা এড়ানোর একটি কৌশল। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি সঠিক প্রয়োগ হলে এই আইন নাগরিকদের আইনী অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারে। যেমনঃ এই আইনের ২১ (২) ধারায় বলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তি প্রপাগাণ্ডা বা প্রচারণা চালালে তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা হবে। তাছাড়া ২১ (৩) ধারায় বলা হয়েছে কোন ব্যক্তি যদি উপরিউক্ত অপরাধ পুনরায় করে বা পুনঃপুন করে তাহলে সে ব্যক্তিকে যাবতজীবন কারাদণ্ড বা ৩ কোটি টাকা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা হবে। দেশের সম্মান বজায় রাখার স্বার্থে এই ধারা খুবই তাৎপর্যপূর্ন হবে বলে মনে করি।

তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সরকারী গোপনীয়তা ভঙ্গকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৩২ (১) ধারায় বলা হয়েছে যদি কোন ব্যক্তি Official Secret Acts 1923 আওতাভুক্ত কোন অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ বৎসর কারাদন্ডে বা ২৫ লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন। আবার ৩২(২) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যাক্তি উপধারা (১) এ উল্লেখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদন্ডে বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।

সংসদে পাশ হওয়ার পর থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিভিন্ন মহলে ব্যাপকভাবে সমালোচনা হতে থাকে। অনেক গণমাধ্যমকর্মীদের মতে দুর্নীতি রোধে তাদের পেশাগত নিষ্ঠাবান দায়িত্ব পালনে ব্যাপক বাধার সৃষ্টি করবে এই আইন। তাছাড়া এই আইনের মাধ্যমে গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাধীন পেশাদারীত্বর অধিকারকে খর্ব করা হবে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে অতি সম্প্রতি ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার অভিযোগে ১৪ বছরের একজন নাবালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যা রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগে সম্পূর্ণ শিষ্টাচার বহির্ভূত ঘটনা। যদিও পরে তাকে কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়।

আমার মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে এই আইন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর বিতর্কিত ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ এবং ৬৬ ধারা বাতিল করে এই আইনকে অনেকটা নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। কেননা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ৬১ (১) ধারায় বলা হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ধারা ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭, ৬৬ বিলুপ্ত, অতঃপর এই ধারায় বিলুপ্ত ধারা বলে উল্লেখিত হবে। তবে ৬১ (২) ধারায় বলা হয়েছে, উপধারা (১) এ উল্লেখিত বিলুপ্ত ধারা সমূহের অধীন ট্রাইবুনালের সূচিত বা গৃহিত কোন কার্যধারা বা কোন মামলা যে কোন পর্যায়ের বিচারাধীন থাকিলে উহা এমনভাবে চলমান থাকিবে যেন উক্ত ধারাসমূহ বিলুপ্ত হয় নাই।

অনেকে মনে করেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনেরই একটি নতুন সংস্করণ যা নাগরিকদের বাক স্বাধীনতা রুখতে আরও বেশী কঠোর করা হয়েছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধ দমনে বা ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য এই আইনের অনেক ধারায় অত্যন্ত কার্যকর। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মহলে এই আইন বাতিলে জোর দাবী উঠেছে। তবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যেকোন আইন পুরোপুরি বাতিল করা হলে তা অপরাধীদের জন্য অনেকটা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পুরোপুরি বাতিল না করে বরং কিছু ধারা বাতিল করা যেতে পারে বা সংশোধন করা যেতে পারে যাতে এই আইনের মাধ্যমে নাগরিকদের হয়রানীর বদলে তাদের আইনী অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়।

লেখক: অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট চট্টগ্রাম।