অ্যাডভোকেট মুরাদ মোর্শেদ:
মনে আছে, বর্তমান বার কাউন্সিলের কমিটি তথা যারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে ৩ বছরের জন্য বিজয়ী নেতৃবৃন্দ, নির্বাচনের আগে তাদের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিলো – প্রতি দফায় আইনজীবীদের তালিকাভুক্তি সম্পন্ন হবার পর অথবা যারাই নবীন আইনজীবী আছেন, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এই প্রশিক্ষণ পূর্বে নিয়মিত প্রতি তালিকাভুক্তি চূড়ান্ত হবার পর ঢাকায় নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হতো। তো, সেই প্রতিশ্রুতি দেবার পরে আমরা ২০১৮ সালে উৎসাহের সাথে ভোটও দিলাম, বার কাউন্সিলের বর্তমান কমিটিকে নির্বাচিত করলাম। কিন্তু, বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হবার সময় হয়ে এলেও উক্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য ন্যূনতম কোনো পদক্ষেপ দেখা গেলো না যা অত্যন্ত পীড়াদায়ক।
এই কথার অবতারণা হলো এই কারণে যে, বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তির লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষানবিশগণ সাম্প্রতিককালে আন্দোলন করছেন। আইনজীবীগণের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি তারা রাখছেন না, অন্যদিকে, ভবিষ্যতের আইনজীবীদের নিয়েও কোনো যত্ন বা উদ্বিগ্নতা নেই। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের আন্দোলনের মূল দাবি গত কয়েকমাস ধরে ভিন্নভিন্নরকম থাকলেও তাদের বিভিন্ন ধরনের সংগঠন এবার ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের একটি মঞ্চ ঘোষণা করে দাবিগুলো সুনির্দিষ্ট করেছে। তাদের মূল দাবি হলো – যেহেতু বার কাউন্সিল নিয়মিতভাবে পরীক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছে বিগত কয়েক বছরে, উপরন্তু সদ্য এমসিকিউ পরীক্ষার পরপরই বিশ্বব্যাপী করোনার সংক্রমণে বাংলাদেশেও লকডাউন শুরু হয়েছে এবং এখনো পরীক্ষাটি অনির্দিষ্টকালের জন্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, সেহেতু, এবারের অবশিষ্ট লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষা বাতিল করে দিয়ে সরাসরি বার কাউন্সিল কর্তৃক বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে এমসিকিউ পরীক্ষার্থীদের তালিকাভুক্ত করে ফেলা হোক।
উপরোক্ত দাবিটি অনেক যৌক্তিক দাবি কোনো সন্দেহ নেই। বস্তুত, আপনারা যদি লক্ষ করেন যে, বার কাউন্সিলের নির্বাচিত কমিটির একটি গুরুদায়িত্ব হলো নিয়মিতভাবে আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষাটি অনুষ্ঠিত করা। বার কাউন্সিল অর্ডারে ১০ নং অনুচ্ছেদে বার কাউন্সিলের কমিটির যে ১১টি দায়িত্ব পালন করার কথা নির্দেশিত আছে তার একেবারে প্রথমটিই হলো – আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করা। আর, এই প্রথম দায়িত্বটিই সঠিকভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উদাসীনতা লক্ষ্যণীয়।
বার কাউন্সিলের পরীক্ষা নেবার বিধান আগে বছরে দুইটি করে থাকলেও বর্তমানে একটি করে পরীক্ষা হবে এমনটিই ধারণা করে থাকে সবাই। কিন্তু, মজার ব্যাপার হচ্ছে এ ব্যাপারে কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই বার কাউন্সিল অর্ডারে – যা আমরা অনেকেই জানিনা। ২০১১ বা ২০১০ সালের সংশোধনীর আগে বার কাউন্সিল অর্ডারটি হাতের কাছে নেই। তাহলে, এ বিষয়ে আরো সুনির্দিষ্ট রেফারেন্স সহকারে এই কথা বলা যেতো। ধারণা করি যে, বার কাউন্সিলের তৎকালীন কমিটি ইচ্ছাপূর্বকই এ বিষয়ে যেন কোনো আইনী বাধ্যবাধকতায় না পড়তে হয় সেজন্য বর্তমান আইনে প্রতি বছর বছর যে তালিকাভুক্তির পরীক্ষা নেবার কোনো বিধান যুক্ত করা নাই বা অনির্দিষ্ট রাখা হয়েছে। আইন এমন অনির্দিষ্ট হতে পারেনা প্রকৃতপক্ষে। আইন অনির্দিষ্ট হলে আইনের মৌলিক দর্শনকেই বা ন্যায়বিচারকে তা কোনো না কোনোভাবে ব্যাহত করে।
বার কাউন্সিলের কমিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেমন সুনির্দিষ্টভাবে দিন তারিখ উল্লেখ করে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে, তেমনিভাবে বার কাউন্সিলে নতুন আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষার ব্যাপারেও দিন তারিখ উল্লেখে নির্দিষ্ট আইন থাকা বাঞ্ছনীয়। আমি অনেক আগেই যখন কিনা এই শিক্ষানবিশগণ ২০১৯ সালে এমসিকিউ পরীক্ষা দ্রুততার সাথে অনুষ্ঠিত করার দাবিতে আন্দোলন করছিলেন, তখন এই ওয়েবসাইটেই আরেকটি লেখায় প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম যে, বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তির পরীক্ষা প্রতিবছর অনুষ্ঠিত করতে হবে এবং এর একটি পরীক্ষার সিডিউল নির্দিষ্ট করা থাকতে হবে। যেমন, প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে এমসিকিউ পরীক্ষা, মে/জুন মাসের ভেতরে লিখিত পরীক্ষা এবং নভেম্বর বা ডিসেম্বরের ভেতরে ভাইভা পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করা। তো, সেই দাবি সকল অংশের সমর্থন পেয়েছিলো।
বার কাউন্সিলের পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয় আপিল বিভাগেরও দৃষ্টিগোচর হয়েছে বিধায় আপিল বিভাগ বার কাউন্সিল সংক্রান্ত একটি রায়ে তার পর্যবেক্ষণে মতামত জানিয়েছিলো এভাবে –
‘It is seen that the Bar Council cannot perform its responsibilities properly. It cannot conduct the enrollment process of advocates properly and accordingly, the Judges of the Supreme Court have been entrusted with the responsibility.’ [Civil Appeal 235 of 2014]
২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এই রায়ের সারসংক্ষেপ করতে গিয়ে ১২ টি পয়েন্টের সবশেষ পয়েন্টে আরো বলা আছে –
‘The Bar Council shall complete the enrollment process of the applicants to be enrolled as advocates in the district courts each calendar year.’
বার কাউন্সিলের তালিকাভুক্তির লিখিত পর্বে বার কাউন্সিল অর্ডার ও রুলস অংশ থেকে এরকম একটি প্রশ্ন থাকে যে, ‘আইনজীবীদের পেশাগত দক্ষতা, সম্মান, শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে ইহা কতটুকু সফলকাম হয়েছে?’ – আইনজীবীগণের সম্মান ও শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে বার কাউন্সিল যথেষ্ট ভূমিকা নিঃসন্দেহে রাখে, তবে, দক্ষতা বিকাশে ভূমিকা দেখা যায় না বললেই চলে। আইনজীবীদের পেশাগত দক্ষতার প্রশ্নটি শুধুই তালিকাভুক্ত আইনজীবীদের ক্ষেত্রের প্রশ্ন নয়; এখানে আসন্ন নবীন আইনজীবীগণকেও তথা শিক্ষানবিশগণকেও যুক্ত করেই ভাবনাটি ভাবতে হবে।
বস্তুত, যদি নিয়মিতভাবে বার কাউন্সিল তালিকাভুক্তির পরীক্ষা না নেয়, তবে সমাজের মেধাবী এবং যোগ্যতর শিক্ষার্থীদের আইন শিক্ষার্থী হিসেবে পাবেনা বার কাউন্সিল। একজনের পেশাজীবী জীবনের নিশ্চয়তা না থাকলে তো একজন অভিভাবক কোনোভাবেই তার সন্তানকে আইন বিভাগে ভর্তি করাবেন না। বার কাউন্সিলের শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের গতি করে দেবার ক্ষেত্রে এই ব্যর্থতা এবং উদাসীনতা সমাজের ভেতরে অভিভাবক স্তরেও বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে। আজকের এই অনলাইন যুগে সকলেই এই আন্দোলনের এবং বিক্ষুব্ধ অবস্থার কথা জানে। ফলে, বার কাউন্সিলের প্রতি বিরূপ মনোভাব সকল স্তরেই ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং এই ব্যর্থতার দায়ভার বার কাউন্সিলকেই নিতে হবে বলে আমি মনে করি।
আমি এমন শিক্ষানবিশকে চিনি, যিনি ২০১৭ সালের একজন পরীক্ষার্থী ছিলেন এবং সফলভাবে লিখিত পরীক্ষায় পাশ করার পরেও ভাইভা পরীক্ষা না দিয়েই তাকে বিদেশে উচ্চতর আইন পড়তে যেতে বাধ্য হতে হয়েছে। অনেক দেরিতে অনুষ্ঠিত ভাইভা পরীক্ষার আগেই উক্ত বিদেশস্থ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরুর ডাক পড়ায় তিনি ভাইভা পরীক্ষাটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন! আবার এমন শিক্ষানবিশদেরকে চিনি যারা অনেকেই সকল কিছু ছেড়ে দিয়ে বার কাউন্সিলের পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছেন – তাদের স্বপ্ন যে, তারা আইনজীবী হয়ে একজন নিয়মিত প্র্যাকটিশনার হিসেবে কাজ করবেন। কিন্তু, একবার এমসিকিউ পরীক্ষায় ফেল করার পরে পরবর্তী পরীক্ষাটির জন্য তারা শুধুই অপেক্ষার প্রহর গুণে থাকেন। আজ হবে কাল হবে করে করে তাদের দিনযাপন খুবই পীড়া ও যন্ত্রনার সৃষ্টি করছে তাদের মনের ভেতরে। ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তায় অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন একজন পরীক্ষার্থী। অনেকেই পুরোদমে প্রস্তুতি শেষ করে নিয়ে আবারো পড়ছেন খুব ক্লিশে ভাব নিয়ে অথবা কেউ কেউ পড়াশোনা করা ছেড়েও দিয়েছেন। এভাবে এই সেক্টরের ভবিষ্যৎ পেশাজীবীগণ চরম অনিশ্চয়তায় আছেন তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভবিষ্যৎ নিয়ে।
একজন তালিকাভুক্ত আইনজীবী হিসেবে ভবিষ্যতের আসন্ন আইনজীবীগণ তথা শিক্ষানবিশগণের পরীক্ষার ব্যাপারে বার কাউন্সিল দ্রুতই যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন এই আশাবাদ প্রকাশ করি এই নিবন্ধের মাধ্যমে। অন্যদিকে, শিক্ষানবিশগণ যেভাবে ঢালাওভাবে বলছেন যে, পরীক্ষা বাতিল করে দিয়ে এবারের বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে সনদ দেওয়া হোক, সেটিকে আরেকটু সংশোধন করার প্রস্তাব দিয়েই এই লেখাটি শেষ করতে চাই।
দীর্ঘ ৩/৪ বছর অপেক্ষার পরে একটি পরীক্ষার প্রথম পর্ব তথা এমসিকিউ শুরু হয়েও পুরো প্রক্রিয়াটি আবারো থেমে গেছে করোনার সংক্রমণে। আপনারা দাবি তুলছেন যা সেটির প্রতিও পুরোই সমর্থন আছে একজন আইনজীবী হিসেবে। কিন্তু, আন্দোলন শুধুই নিজেদের সময় বা কালকে নিয়ে না করে সামগ্রিকভাবে এই আন্দোলনকে প্রথম ও শেষ আন্দোলন হিসেবে দেখুন। যেমন, আন্দোলনের প্রধানত দুইটি দাবি হতে পারে যাতে করে আপনাদের এবারের লিখিত পরীক্ষার্থীদের দাবিও যেমন উঠে আসবে, তেমনি ভবিষ্যতের শিক্ষানবিশগণকেও এসব নিয়ে যেন আন্দোলনের মাঠে না আসতে হয় বা তাদের অধিকারও নিশ্চিত হয়। প্রস্তাবিত দাবি দুইটি নিম্নরূপ –
১. ২০২০ সালের এমসিকিউ পরীক্ষার্থীদের লিখিত পরীক্ষা বাতিল করে দিয়ে শুধুই ভাইভা নেবার মাধ্যমে এ বছরেই তালিকাভুক্তি সম্পন্ন করতেই হবে।
২. প্রতিবছরের নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষার তিনটি স্তরের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করতে মাস উল্লেখে বার কাউন্সিল অর্ডারে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে। যেমন, ফেব্রুয়ারিতে এমসিকিউ পরীক্ষা, মে,/জুন মাসে লিখিত পরীক্ষা এবং নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরে ভাইভা পরীক্ষা।
আপনাদের আন্দোলন সফল হোক এবং বার কাউন্সিলও তার ওপর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন এই আশাবাদ রেখে আপনাদের সকলের জন্য শুভকামনা আমার পক্ষ থেকে।
লেখক: আইনজীবী ও আইনের ধারাপাত – সিরিজ গ্রন্থের রচয়িতা।