মনিরা নাজমী জাহান

জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ কারা হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে?

মনিরা নাজমী জাহান:

জঙ্গিবাদ একটি বিশ্বজনীন সমস্যা।দুনিয়ার কোনো জাতিই এ সমস্যা থেকে মুক্ত নয় এমনকি  নিরাপদ ও নয়।পৃথিবীর কোন এক প্রান্ত যখন জঙ্গিবাদে আক্রান্ত হয়  তা পৃথিবীর আরেক প্রান্তকেও নিরাপত্তাহীন করে তোলে। জঙ্গিবাদের এই ভয়াবহ বিস্তার পুরো পৃথিবীর মানুষকে ভয়াবহ উৎকণ্ঠার মধ্যে ফেলেছে। যে কোন প্রাণ নাশক সংক্রামক ভাইরাসের চেয়েও দ্রুত বিস্তার ঘটাতে সক্ষম এই জঙ্গিবাদ নামক ভাইরাস। জঙ্গিবাদের ভাইরাস এতই ভয়াবহ যে মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসি মুখে নিজের প্রান বিসর্জন দিতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা করে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধু নিজের প্রাণ না নিজের অতি প্রিয় এবং আপন জনের প্রাণ বিসর্জন করতেও কুণ্ঠিত হয় না। তবে এই জঙ্গিবাদকে ঘিরে যে প্রশ্নটি সব সময় উচ্চারিত হয় তা হল এই জঙ্গিবাদে কারা উদ্বুদ্ধ হয় এবং কেন উদ্বুদ্ধ হয় ?

প্রথম যে বিষয়টিতে আলোকপাত করা প্রয়োজন তা হল জঙ্গিবাদে কারা উদ্বুদ্ধ হয়?

অপরাধ বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েও বেশ হিমশিম খেয়েছেন। কারণ সুনির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন যে ঠিক কোন গোত্র, ধর্ম, বর্ণের বা মতবাদে বিশ্বাসী লোক জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হবে। নিবরাসের মত উদারমনা পাশ্চাত্য শিক্ষায় বিশ্বাসী ছেলের যেমন জঙ্গিবাদের সম্পৃক্ত হবার ইতিহাস আছে ঠিক তেমনি আছে রিচার্ড রেইড নামক অল্প শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল ব্রিটিশ যুবকের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হয়ে যাবার ইতিহাস যে কিনা ২০০১ সালে আমেরিকান এয়ারলাইনসের প্যারিস থেকে মিয়ামিগামী একটি বিমানে আগুন লাগাবার চেষ্টা করেছিল। নিদাল মালিক হাসান নামক যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর মেজরের জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ততারও ইতিহাস রয়েছে। যিনি ২০০৯ সালের ৫ই নভেম্বর একাই খুন করেছেন ১৩ জন মানুষকে এবং মারাত্মকভাবে আহত করেন ৩০ জন মানুষকে।আবার যদি আমরা চিন্তা করি যে কোন বিশেষ ধর্মের লোকেরাই কি জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়? তাহলে চিন্তাটা ভুল হবে কারন  বেলিজিয়ামের ১৯ বছরের তরুন অ্যাথলেট ব্রায়ান ডি মুলার যিনি ছিলেন একজন কট্টর খ্রিস্টান ক্যাথলিক পরিবারের সন্তান। সেই মুলার সিরিয়ায় আইএস জঙ্গিদের দলে যোগ দেন । রাক্কায় আইএস জঙ্গিদের খিলাফত ঘোষণারদিন  ট্যাঙ্কের মাথায় আইএস যোদ্ধাদের সাথে এই মুলার কেও দেখা গেছে। যদি চিন্তা করি যে রক্ষণশীল চিন্তা ভাবনার মানুষেরাই হয়ত জঙ্গিবাদে বেশী উদ্বুদ্ধ হয় তাও হিসাব মেলানো কঠিন কারন দুই মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফলি ও স্টিভেন সটলফ এবং ব্রিটিশ নাগরিক ডেভিড হাইনেস  এবং এলান হেনিং এর হত্যাকারী জঙ্গির নাম ছিল জন। বিশ্বব্যপি যিনি পরিচিত ছিলেন জিহাদি জন নামে । অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে এই জন ছিলেন একজন ব্যান্ড দলের র‍্যাপার। এখন ও অনলাইন খুজলে এই জনের র‍্যাপার হিসেবে অনেক ছবি খুঁজে পাওয়া যাবে। ২০১৩ সালে এই জন  সিরিয়াতে গিয়ে  আইএস যোগ দেয়।কিংবা আমরা আমরা যদি সিডনীর বাসিন্দা ৩৩ বয়স্ক মহাম্মদ আলী বারায়লির কথাই ধরি, যার হাত ধরে সিডনি থেকে বহু মানুষ সিরিয়া তে পাড়ি জমিয়েছে। তাহলেও দেখবো আইএস যোগ দেবার আগে বারায়লি ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান টিভি শো আন্ডারবেলির একজন জনপ্রিয় অভিনেতা। যিনি ছিলেন একজন ভোগবাদী মানুষ। মেতে থাকেন ভোগবাদী জীবনের রঙ্গিন দুনিয়া তে। সেই বারায়লি আইএস যোগ দিয়ে হয়েছেন শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি ।

যদি এইভাবে চিন্তা করি যে, শুধু পুরুষরাই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে তাহলে আসলে একেবারেই ভুল ভাবা হবে । শাহ্‌রা মেহেন্নি, ১৭ বছর বয়সী ফ্রান্সের হাই স্কুলের ছাত্রী।ইহুদি পরিবারের মেয়ে হয়ে তিনি বান্ধবি নোরার সাথে পাড়ি জমিয়েছিলেন সিরিয়াতে। যোগ দিয়েছিলেন আইএস জঙ্গি গোষ্ঠীতে । বিশ্ব গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে খবর বেড়িয়ে ছিল যার শিরোনাম ছিল “ জিউস গার্ল ইন আইএসআইএস।” আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরন হচ্ছে গ্লাসগো তে বেড়ে ওঠা ২০ বছর বয়সী আকসা মাহমুদ।যিনি হতে চেয়েছিলেন ডাক্তার। ভালোবাসতেন স্কটিশ ব্যান্ড কোল্ডপ্লের গান, হ্যারি পর্টারের বই আর ক্রিকেট খেলার দারুন ভক্ত ছিলেন। সেই মেয়েটি ২০১৩ সালে সিরিয়া তে গিয়ে আইএস জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেন । এমনকি সম্প্রতি সময় আমরা দেখেছি আয়েশা জান্নাত মোহনা ওরফে জান্নাতুত তাসনিম নামের ২৫ বছর বয়সের এক তরুণীকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এই তরুণীর পূর্বের নাম ছিল প্রজ্ঞা দেবনাথ।

জঙ্গিবাদে কারা উদ্বুদ্ধ হয় এই কথার উত্তরে নির্দ্বিধায় বলা যায়, যে কোন কোন গোত্র ধর্ম বর্ণ বা মতবাদের লোক জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হতে পারে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টিতে আলোকপাত করা প্রয়োজন তা হল জঙ্গিবাদে কেন বা কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়?

এই প্রশ্নের উত্তরে অপরাধ বিজ্ঞানীরা কোন সুনির্দিষ্ট ফর্মুলা বা ব্লু প্রিন্ট দিতে পারেননি। তবে মোটা দাগে পুরো প্রক্রিয়াতে ৩টি ধাপের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। প্রথম ধাপে একজন মানুষের প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় প্রতি এক ধরনের হতাশা, ক্ষোভের জন্ম নেয়। তিনি নিজেকে বঞ্চনার স্বীকার বলে মনে করতে থাকেন এবং সেই পরিস্থিতি থেকে তিনি স্বপ্ন দেখতে থাকেন এক পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থার। দ্বিতীয় ধাপে তিনি সুনির্দিষ্ট মতবাদ বা মতাদর্শ গ্রহণ করেন । তিনি বিশ্বাস করতে থাকেন এই মতবাদ বা মতাদর্শ বাস্তবায়ন করতে পারলে তিনি যে বঞ্ছনার স্বীকার তা দূর হয়ে যাবে। তিনি যে সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন তা এই মতবাদ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব। তখন তিনি এই মতাদর্শ দ্বারা গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হতে থাকেন। সর্বশেষ স্তরে যে বিষয়টি ঘটে তা হচ্ছে তিনি খুঁজে বের করেন তার সেই উদ্বুদ্ধ হওয়া মতবাদের অনুসারীর অন্যান্য মানুষদের। তিনি সেই মতবাদের অন্যান্য মানুষদের সাথে সখ্যতা গড়ে তলার মাধ্যমে তাদের দলে যোগদান করেন।তবে এই কথাও সম ভাবে সত্যি যে আই ৩ ধাপের বাইরেও অসংখ্য কারন রয়েছে যার জন্য মানুষ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। কয়েকটি উদাহরন দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

১৫ বছরের স্কুল ছাত্রী ব্রিটিশ নাগরিক ইয়ুশরা। যার স্বপ্ন ছিল ডেন্টিস্ট হবার। সেই ১৫ বছরের স্কুল ছাত্রীটি ১৭ বছরের আরেক তরুনের হাত ধরে পাড়ি জমান সিরিয়াতে আইএস জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দেবার উদ্যেশ্যে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভারে বসবাসরত ১৭ বছরের এক কিশোরীর অনলাইনে প্রেম হয় সিয়িরাতে থাকা এক জঙ্গির সাথে সেই প্রেমের টানে সিরিয়ার পথে পা বাড়ান সেই ১৭ বছর বয়স্ক কিশোরী সাথে নেন ১৫ বছর বয়সী তার এক বোন এবং ১৬ বছরের এক বান্ধবীকে।

কসোভোর ৮ বছরের শিশু ইরিয়ন বিশ্ব গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়ে উঠেছিল সেচ্ছায় জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাবার জন্য নয় বরং তার বাবা তার মার সাথে বনিবনা না হবার কারনে একরকম জোর করে ইরিয়ন কে কেড়ে নিয়ে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান।এই রকম আরেকটি ঘটনা ঘটে। খালিদ শারৌফের ক্ষেত্রে। যিনি ছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়ান নির্মাণ শ্রমিক। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন ভয়াবহ রকম দাঙ্গাবাজ এবং মাদকাসক্ত। এই লোকও তার স্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় ৭ বছরের ছেলেকে নিয়ে সিরিয়ার আইএস যোগ দান করেন।আবার ২৪ বছরের কসোভোর যুবক ব্লেরিম হেটা। ইউটিউবে জঙ্গিবাদের বয়ান শুনে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হন। ২০১৩ সালে কাউকে কিছু না বলে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান।
উপরের উদাহরন এবং কারন ছাড়াও রয়েছে পৃথিবীজোরা অসংখ্য উদাহরন এবং কারন যার জন্য মানুষ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন ।

এই কথা অনস্বীকার্য যে এখন পর্যন্ত জঙ্গিবাদে কারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে এবং কেন উদ্বুদ্ধ হচ্ছে তার প্রকৃত চিত্র নিরুপন করা সম্ভব হয়নি।বরং এই কথাই সত্য যে এখন পর্যন্ত যে কারন আমাদের সামনে চিহ্নিত হয়েছে তার বাইরেও রয়েছে আরও অসংখ্য কারন। তাই জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে একদিকে যেমন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করতে হবে আরেকদিকে সমাজে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে ।

মনিরা নাজমী জাহান: শিক্ষক , আইন বিভাগ , ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়