উচ্চ আদালত
উচ্চ আদালত

আদালতের নির্দেশ অমান্য করেছেন রাবি উপাচার্য: হাইকোর্ট

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে (রাবি) শিক্ষক নিয়োগে আদালতের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি করে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই নিয়োগের মাধ্যমে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান আইন লঙ্ঘন, স্বেচ্ছাচারিতা ও আদালতের নির্দেশ অমান্য করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।

ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা এক রিটের রায়ে বিচারপতি আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

গত সোমবার (২৩ নভেম্বর) এর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। বুধবার (২৫ নভেম্বর) এ রায়ের কপি রিটের সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছায়।

রায়ে ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত ৩ শিক্ষকের নিয়োগ অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এক মাসের মধ্যে ওই বিভাগে ২০১৬ সালের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত মন্তব্য করেন- রিটের শুনানি চলাকালে আদালত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আইনজীবীকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছিল যে, মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিয়োগ কার্যক্রম যেন স্থগিত রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে (বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন) অবহিত করেন। কিন্তু আদালতে শুনানি চলমান জানা সত্ত্বেও এবং আদালতের মৌখিক নির্দেশ সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি নিয়োগ প্রদান সম্পন্ন করেছেন।

উপাচার্য সব শিক্ষককে অপমান করেছেন উল্লেখ করে আদালত বলেন, সর্বোচ্চ বিদ্যালয় তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সর্বোচ্চ উঁচু মানের হবেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সব কার্যক্রমের পরিচালনাকারী উপাচার্য হবেন আরো উঁচু মানের। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্মানজনক পেশা। এই পেশার কোনো ব্যক্তি আইন এবং আদালতের আদেশ ভঙ্গ করতে পারে এটা সাধারণ মানুষ চিন্তাও করতে পারে না। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সেই অকল্পনীয় কাজটি করলেন। তিনি প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সব শিক্ষককে অপমান করেছেন। যেকোনো কর্তৃপক্ষ যারা জনগণের টাকায় চলে তাদের প্রতিটি কর্মের চুলচেরা ব্যাখ্যা দিতে বাধ্যতামূলক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩-এর কয়েকটি ধারার উল্লেখ করে আদালত বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আইন পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে, সিন্ডিকেটের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণের কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নতুন পদে কোন শিক্ষাগত যোগ্যতায় শিক্ষক নিয়োগ হবে সেটা একমাত্র সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির এখতিয়ারের বিষয়। যতক্ষণ না পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বিভাগ ‘নতুন পদে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতায় শিক্ষক নিয়োগ করা হবে বিষয়ে’ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তথা সিন্ডিকেটে পাঠানো হবে ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় অপেক্ষা করবে।

আদালত বলেন, মামলায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আইন বহির্ভূতভাবে, প্ল্যানিং কমিটির ক্ষমতা খর্ব করে, পুরোনো বিজ্ঞপ্তি বাতিল না করে, নতুন করে যোগ্যতা নির্ধারণ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ২৪ ধারা মোতাবেক সিন্ডিকেটের কার্যাবলীর মধ্যে শিক্ষক নিয়োগ নিমিত্তে প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং সংশ্লিষ্ট বিভাগ কর্তৃক সেরূপ কোন যোগ্যতা নির্ধারণের প্রস্তাব অনুমোদনকারী। নির্ধারণকারী বা সুপারিশকারী এবং অনুমোদনকারী এক নয়। যিনি সুপারিশকারী তিনি অনুমোদনকারী হতে পারে না।

আদালত আরও বলেন, গত ২০১৯ সালের ২৯ জুন সিন্ডিকেটের ৪৯১তম সভায় ৪৬ নম্বর প্রস্তাবে ২০১৯ সালের ২৬ মে-এর একটি আদেশ উল্লেখ আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই আদেশ (নিয়োগের যোগ্যতা পুনঃনির্ধারণের আদেশ) আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা ইচ্ছাকৃত ভাবে উপস্থাপন করেন নাই। অর্থাৎ আদেশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ভঙ্গ করে করা হয়েছে তা প্রমাণিত এবং আদেশটি বেআইনি। এটাও স্বীকৃত হয়েছে ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগের প্ল্যানিং কমিটি আদেশটি প্রদান করেননি।

আদালত উল্লেখ করেন, ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে দরখাস্ত আহবান করেন। কিন্তু নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আবেদনপত্র গ্রহণ করে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কেন নিশ্চুপ বসে রইল তার কোনো সদুত্তর বিশ্ববিদ্যালয় আদালতকে দিতে পারে নাই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজের দেওয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কেন বিনা কারণে প্রায় ৩ বছর ফেলে রাখলেন? এটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তথা উপাচার্যের স্বেচ্ছাচারীমূলক অভিপ্রায়, অসৎ উদ্দেশ্য এবং সর্বোপরি বেআইনি কর্ম।

জানা যায়, ২০১৬ সালের নভেম্বরে ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের ৩টি শূন্য পদের বিপরীতে শিক্ষক নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেখানে প্ল্যানিং কমিটি প্রভাষক পদে প্ল্যান্ট প্যাথলজি, জেনেটিক্স অ্যান্ড প্ল্যান্ট ব্রিডিং ও এগ্রোনমি/এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারবেন বলে উল্লেখ করে।

কিন্তু পরে ওই বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক নিয়োগ না করে ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই নতুন করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু প্ল্যানিং কমিটিকে না জানিয়েই প্রভাষক পদে আবেদনের জন্য উল্লিখিত বিভাগগুলোর সঙ্গে ‘এগ্রিকালচারাল কেমিস্ট্রি’ বিভাগ যুক্ত করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এ নিয়ে বিভাগের প্ল্যানিং কমিটির সদস্য অধ্যাপক মু. আলী আসগর উচ্চ আদালতে ২০১৯ সালে রিট দায়ের করেন। রিটের শুনানি শেষে গত ২৯ জানুয়ারি আদালত রায় প্রদান করেন। পরে ২৩ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে।