মোঃ জিশান মাহমুদ:
পটভূমি:
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকেই বছরব্যাপী পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই দেশেরই কিছু কুলাঙ্গারদের সহায়তায় পরিকল্পিতভাবে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে। তবে ১৯৭১ সালের ১০ই ডিসেম্বর থেকে ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশীসংখ্যক বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৪ই ডিসেম্বরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস ঘোষণা করা হয়!
বাংলাদেশই পৃথিবীর বুকে একমাত্র দেশ যেখানে যুদ্ধকালে সশস্ত্র এবং নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল স্বাধীন দেশের প্রগতিকে আটকিয়ে দেয়ার জন্য।
১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনাটি পূর্বেই করা হয়; আর এতে সহায়তা করে জামায়াত ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র সংঘ। এ হত্যাকান্ডে সবচেয়ে সক্রিয় ছিলেন ব্রি. জে. আসলাম, ক্যাপ্টেন তারেক, কর্ণেল তাজ, ভিসি প্রফেসর ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসইন, ড. মোহর আলী, আলবদরের এবি এম খালেক মজুমদার, আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মাইনুদ্দিন। এদের নেতৃত্ব দেয় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের পরপরই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ এই দিনকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এবং একটি তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন ১৯৭১ সালের ৩১ শে ডিসেম্বর। কিন্তু, তার ঐ সিদ্ধান্ত আর কার্যকর হয়নি।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ১৮, মতান্তরে ২৯ তারিখে বেসরকারীভাবে গঠিত বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন আজও প্রকাশিত হয়নি। এরপর আরেকটি ‘বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটির প্রথমিক রিপোর্টে বলা হয়, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চলেনি। কারণ ফরমান আলীর লক্ষ্য ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা। ঐ বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হান বলেন, এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনষ্ক বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত হেনেছে। তবে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি জহির রায়হান নিখোঁজ হওয়ার পর সেই কমিটির তদন্ত কমিটির কাজের আর অগ্রগতি হয়নি! ধারণা করা হয় তদন্ত কাজের অংশ হিসাবে অনেক তথ্য তিনি সংগ্রহ করেছিলেন এবং একই কাজে মিরপুরে গেলে ওখানেই তাঁকে হত্যা করা হয়!
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, ১৯৭২ সাল থেকেই সরকারিভাবে, জাতীয়ভাবে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়ে আসলেও আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো তদন্ত হয়নি! রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো একক নির্ভরযোগ্য দলিল তৈরী হয়নি! বিচারিক আদালতেও বিষয়টি আসেনি! যুদ্ধাপরাধের মামলার আসামী সাঈদী এবং চৌধুরী মাইনুদ্দীনের মামলাতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের বিষয়ে আলোকপাত করা হলেও সেখানে শুধুমাত্র ঐ সকল ব্যক্তি বিশেষের অপরাধের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের বিচার করার প্রয়োজনে! সেখানে কতজন বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের শিকার, অপরাধের ধরণ, অপরাধের বিবরণ, তাদের অবদান, তাদের অবস্থান, তাদের জীবনবৃত্তান্ত কোনো কিছুই উঠে আসেনি!
১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনায় রমনা থানায় প্রথম মামলা দায়ের করা হয় (মামলা নম্বর ১৫)। সেখানে আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মাইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে আসামি করা হয়। মামলাটি দায়ের করেন অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিনের বোন ফরিদা বানু, ২০০২ সালের বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে সেই মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়। দেশের প্রগতি ও ইতিহাস সংরক্ষণের স্বার্থে বিশেষ কমিশন গঠন করে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের বিচারের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
সংখ্যা নিয়ে আজও বিভ্রান্তি!
১৯৭২ সালে প্রথম ‘বিজয় দিবস’ উদযাপন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার বই/স্মারক প্রকাশ করেছিল, যেখানে প্রাথমিকভাবে ৯৮৯ জনের নাম প্রকাশিত হয়েছিল! এই তালিকাতে অনেকেরই নাম আসেনি!
বাংলা একেডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ (১৯৯৪) থেকে জানা যায়, ২৩২ জন বুদ্ধিজীবী নিহত হয়েছেন। তবে তালিকায় অসম্পূর্ণতার কথাও একই গ্রন্থে স্বীকার করা হয়েছে! একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের এই ধরণের কর্মকান্ড অত্যন্ত অবমাননাকর!
১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’- এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন।
কেন বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের জন্য পৃথক মামলা ও বিচারের প্রয়োজন?
যুদ্ধাপরাধ এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণহত্যার বিষয় উঠে আসলেও বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন! যদিও ভিয়েতনাম, বসনিয়াতেও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল! তবে, সেটির এত ব্যপকতা ছিলনা।
বর্তমানের চলমান যুদ্ধাপরাধের মামলা এবং বিচার সম্পন্ন মামলাতে সামষ্টিক বিবেচনা নিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের বিষয়টি তেমন আলোচিত হয়নি! এই কারণে শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের জন্য পৃথক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, পৃথক মামলা হওয়া প্রয়োজন! যেখানে শুধুমাত্র এই বিষয়ের উপরে আলোকপাত করা হবে!
দাবীসমূহ:
* শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের রাষ্ট্রীয়ভাবে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত:
* রাষ্ট্রীয়ভাবে তদন্তের ফলাফলের আলোকে বিচারিক আদালতের মাধ্যমে বিচারকার্যের মাধ্যমে রায় আকারে দালিলিক প্রমাণ সংরক্ষণ;
* শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের অপরাধে জামাত, ইসলামি ছাত্র সংঘ, আলবদর, আল শামসসহ যে সকল সংগঠন জড়িত ছিল তাদের সকল অপরাধ রাষ্ট্রীয়ভাবে লিপিবদ্ধ করা, যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ এবং প্রকাশ;
* শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশ ও সংরক্ষণ করা;
* সকল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জীবন বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করা।
সম্ভাব্য অভিযুক্ত:
পাকিস্তানী সেনাবাহিনী
রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী
জামায়াত ইসলামি ছাত্র সংঘ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী।
তথ্যসূত্রঃ
*Khan, Asadullah (১৪ ডিসেম্বর ২০০৫)।‘‘The loss continues to haunt us” The Daily Star (Bangladesh)
*Shahiduzzaman No count of the nation’s intellectual loss ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে
*The New Age, 15 December, 2005Killing of Intellectuals (Asiatic Society of Bangladesh)
* আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস “ঢাকা টাইমস, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪” ইউ আর এল = এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)। ঢাকা টাইমস, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৪।
*বুদ্ধিজীবী নিধন তদন্ত কমিশন ১৯৭১, প্রফেসর ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন কর্তৃক প্রনীত
* বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বিজয় দিবস স্মারকগ্রন্থ, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭২; সম্পাদক- সৈয়দ আলী আহসান। দেখুন: শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৫ মার্চ ২০০৯ তারিখ।
* স্বাধীনতাযুদ্ধের অপরনায়কেরা, নুরুজ্জামান মানিক, শুদ্ধস্বর,একুশে বইমেলা ২০০৯।
মোঃ জিশান মাহমুদ: অ্যাডভোকেট; বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং উপ-আইন বিষয়ক সম্পাদক বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ।