আতাউল্লাহ নুরুল কবির: রাষ্ট্রের প্রধান তিনটি অঙ্গের একটি বিচার বিভাগ। ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জন্য একটি দেশের জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল ও বিরাট একটা ভরসার জায়গা হলো বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগ বিচারালয় বা আদালতের মাধ্যমে জনগণকে তার সেবা প্রদান করে থাকে।
আদালতে বিচারকার্য চলে বিচারক ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে। বিচারকার্য পরিচালনার জন্য বিচারক যেমন অপরিহার্য, তেমনি অপরিহার্য আইনজীবীও। আদালতে বিচারক ও আইনজীবী, এক পক্ষকে ছাড়া অন্য পক্ষ অচল। বার ও বেঞ্চের সুসম্পর্ক না থাকলে ন্যয়বিচার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।
আইনজীবী বা বিচারক হতে গেলে উভয় ক্ষেত্রেই পূর্ব শর্ত হলো আইন বিষয়ে ডিগ্রী লাভ করা। একসময় নিম্ন আদালতে আইনজীবীদের মধ্য থেকেই বিচারক নিয়োগ করা হতো। এখন সময় পাল্টেছে, আইন বিষয়ে ডিগ্রী লাভের সাথে সাথেই জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষার মাধ্যমে নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়। তবে উচ্চ আদালতে এখনও সিংহভাগ বিচারক নিয়োগ পান আইনজীবীদের মধ্য থেকে।
একই বা একই রকম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, সমমেধাসম্পন্ন (সামান্য কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে) কতিপয় ল’ গ্রাজুয়েট জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষায় ভালো করে নিম্ন আদালতে বিচারক হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন, কিছু ল’ গ্রাজুয়েট আদালতে আসেন আইনজীবী হবার বাসনা নিয়ে, আর বাকিরা অন্য চাকুরী বা পেশা বেছে নেন।
বিচার বিভাগ তথা আদালতের একটি পক্ষ, বিচারক হিসেবে যারা নিয়োগ পান, শুরু থেকেই তাদের জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা করে সম্মানজনক মাসিক বেতন, পেশাগত উন্নয়নের নিমিত্তে একের পর এক দেশী-বিদেশী প্রশিক্ষণ, কোর্স ইত্যাদি সহ সকল রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা। ফলে তারা সমাজে রাতারাতি উচ্চ মর্যাদায় আসীন হন এবং নিশ্চিন্তে পেশাগত উন্নয়ন এবং আত্মউন্নয়নে মনোনিবেশ করতে পারেন।
অপরদিকে আদালতের অন্যপক্ষ, আইনজীবী হওয়ার জন্য যারা কোর্টে আসেন, রাষ্ট্র তাদের ন্যূনতম দায়িত্ব গ্রহণ করে না। নেই তাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষানবিশি ব্যবস্থা বা পেশাগত উন্নয়নের জন্য কোন উন্নত প্রশিক্ষণের সুযোগ। তারা কোন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীর অধীনে যাতায়াত ভাড়া বা এক বেলা খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষানবিশি শুরু করেন। অনেকের কপালে সেটাও জুটে না। এর পর দীর্ঘ শিক্ষানবিশি কাল অতিক্রম করে বার কাউন্সিল পরীক্ষায় পাশ করার পর কেউ কেউ হয়তো সামান্য কিছু সম্মানী পেতে শুরু করেন সিনিয়রের কাছ থেকে, অনেকে আবার সেটাও পান না। চোখের সামনে অন্য পেশায় অনেক বন্ধুর মোটা উপার্জন ও দ্রুত উন্নতি দেখতে হয়, অথচ একজন আইনজীবীর উন্নতি হতে থাকে অত্যন্ত ধীরে। তার উপর থাকে সমাজ, আত্মীয়-স্বজন এমনকি পরিবারেরও লাঞ্ছনা গঞ্জনা। শুরুতে আইনজীবীরা পেট চালাতেই যেখানে হিমশিম খেতে থাকেন, সেখানে মেধার বিকাশ ও আত্মউন্নয়ন গৌণ হয়ে পড়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই। খুব অল্প সংখ্যক আইনজীবী আছেন, যারা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন, পেশাগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে এসব প্রতিবন্ধকতা যাদের স্পর্শ করেনি।
এতশত প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে যখন একজন আইনজীবী কমবেশি পেশাগত ও আত্মউন্নয়নে সমর্থ হন, তার পরও তার দূর্ভোগ কমে না। প্রতিনিয়ত আদালতের দূর্ণীতিবাজ ও অসৎ কর্মচারীদের হাতে নাকাল হতে হয় তাকে সহ্য করতে হয় সদ্য পাশ করা বিচারকদের শ্লেষাত্মক আচরণ পর্যন্ত।
আপনি সম্মানিত বিচারক। বিজ্ঞ আইনজীবীগণ আপনাকে সম্মান প্রদর্শণ করতে কুন্ঠা বোধ করে, সেটা একেবারেই বিরল। আপনারও উচিৎ একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে তার প্রাপ্য মর্যাদাটুকু দেয়া। তাতে আপনাপর সম্মান বাড়ে বৈ কমে না। ছোট্ট একটা কথার জন্য একজন বিজ্ঞ আইনজীবীকে দুই ঘন্টা খাঁচায় পুরে রাখা আপনার কাছে মোটেও কাম্য নয়। ধন্যবাদ।
আতাউল্লাহ নুরুল কবির: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট