দুর্নীতির অনুসন্ধানে অন্য সবার সম্পদের হিসাব যে সংস্থা চায়, নানা ঘটনায় সমালোচনা ওঠায় এখন সেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তাদের সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশের কথা বলেছেন হাইকোর্ট। এ সময় দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পত্তির হিসাব বিবরণী প্রকাশ করলে সংস্থাটির গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে আরও বাড়বে বলেও মন্তব্য করেছেন উচ্চ আদালত।
দুদকের ভুল তদন্তের কারণে ১৫ বছরের কারাদণ্ড পাওয়া নিরাপরাধ মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের সাজা বাতিল সংক্রান্ত রুল শুনানিতে বৃহস্পতিবার (২৮ জানুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
শুনানির এক পর্যায়ে আদালত বলেন, “কমিশন অনেক ভালো কাজ করছে। কিন্তু দু-একটি ঘটনা সারাদেশে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়। আমরা তো চাই কমিশন সবাইকে নোটিস দিক। সবারই সম্পত্তির হিসাব দেওয়া উচিৎ।”
এতে দুদকের গ্রহণযোগ্যতাই বাড়বে মন্তব্য করে হাইকোর্ট আরও বলেন, “যদি কমিশনের কমিশনাররাসহ সমস্ত কর্মকর্তা কর্মচারী জনসমক্ষে হিসাব বিবরণী প্রচার করে কাজ করেন, তাহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাছে আরও বেশি বেশি বাড়বে।”
বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের এই হাই কোর্ট বেঞ্চ রায়ে নিরাপরাধ কামরুল ইসলামের সাজা বাতিল করেছে।
সেই সঙ্গে মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত। মামলাটিতে ভুল ব্যক্তিকে যুক্ত করার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়েছে।
আর ভুল তদন্তের শিকার কামরুল ইসলাম যদি ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুদকে আবেদন করেন, তবে দুদককে তা বিবেচনা করতে বলেছে হাইকোর্ট।
আদালতে কামরুল ইসলামের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী। আর দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান।
মামলার শুনানিতে আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আসামির ঠিকানা পরিবর্তন হওয়াতে আসামি বদলে গেছে। এখন যাকে আসামি করে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ খুঁজছে ঘটনার সময় তার বয়স ছিল আট বছর। মূল আসামির জন্ম ১৯৭৭ সালে। আর রিটকারির জন্ম ১৯৯০ সালে।’
তিনি বলেন, ‘দুদকের বিশেষ আইনে প্রথমেই একটি অনুসন্ধানের বিধান আছে। অন্যান্য অপরাধের মত সরাসরি এফআইআর হয় না। এখানে এফআইআর হবে তাদের অনুসন্ধানের পরে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে- প্রশংসাপত্র জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে, সেখানে আসামির নাম, পিতার নাম, ঠিকানা পরিপূর্ণভাবে দেয়া আছে। তারপরও তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম, প্রথম এফআইআরে ভুল হতে পারে। কিন্তু সেটিও সংশোধনের সুযোগ থাকে। ওনারা ১০ বছর তদন্ত করলেন। এফআইআর হয় ২০০৩ সালে। পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করে ২০১৩ সালে। প্রায় ১১ বছর।’
এই আইনজীবী বলেন, ‘দুদক আইনের বিধিতে আছে, তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামির খোঁজ করবেন, তার সাক্ষ্য নিবেন। তদন্তাকারী মনে করলে তার শুনানি করবেন। প্রতি মাসে তার প্রতিবেদন কমিশনের দাখিল করবেন। কমিশন সেই প্রতিবেদন অনুমোদন করবেন। সরল বিশ্বাসে দুদক ভুল করেছে এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত না। এত বছর তদন্ত করে তিনি পূর্ব না পাশ্চিম কিছুই পেলেন না। আসলে তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছুই করেননি। এটা অপেশাদার কাজকর্ম। আর যদি জেনে করেন তাহলে অসততা।’
এসব বিবেচনায় নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রার্থনা করেন এই আইনজীবী।
এরপর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘এই মামলাটি হলো দুর্নীতি দমন ব্যুরোর। এই তদন্তকারী কর্মকর্তা ১০ বছর তদন্ত করেছেন, এটা ঠিক না। তিনি ছিলেন শেষ তদন্ত কর্মকর্তা। আর এটাই তার প্রথম তদন্ত।’
তখন আদালত বলেন, ‘তাহলে এই তদন্তকারী কর্মকর্তা কবে দায়িত্ব পেয়েছেন?’ জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমার কাছে সে তথ্য নেই। তবে সময় দিলে দেখে বলতে পারবো। মামলাটি ব্যুরো আমলের।’
আদালত বলেন, ‘ব্যুারো আমলের হোক, বর্তমান কমিশনতো সবকিছু বুঝেই নিয়েছে।’ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘বিশেষ জজ যদি এটা যাচাই-বাছাই করতেন, তাহলে এমনটি হতো না।’
বিচারক বলেন, ‘চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা যে ঠিকানা দিয়েছেন, সে অনুযায়ী প্রসিডিং হবে। তদন্তকারী কর্মকর্তার দোষ, প্রসিকিউশনের দোষ। আপনাদের প্রসিকিউটরদেরও দায় নিতে হবে। এখন সব দোষ জজ সাহেবের ওপর দিচ্ছেন।’ এটা তদন্তকারী কর্মকর্তার প্রথম তদন্ত, এই কারণে এটা আরও ভালো করা উচিত ছিল বলেও উল্লেখ করেন আদালত।
এ সময় আদালত বলেন, ‘বিভিন্ন মিডিয়ায় এই মামলা সম্পর্কে রিপোর্ট হয়েছে। দু-একটি ভুলের কারণে গোটা প্রতিষ্ঠান কীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিছু কিছু লোক আছে, কিছু কিছু জায়গা আছে, মানুষের প্রত্যাশা থাকে তাদের ফেরেস্তার মত থাকতে হবে।’
এর আগে নরসিংদীর পাটকল শ্রমিক নিরাপরাধ জাহালমের কারাবাসের ঘটনায় সমালোচনায় পড়েছিল দুদক।