আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৩৬ আসামি এখনো পলাতক। বেশির ভাগ আসামির অবস্থান সম্পর্কে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও রাষ্ট্রপক্ষের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াত নেতা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার, মো. আশরাফুজ্জামান খান, চৌধুরী মঈনউদ্দিন। এর মধ্যে আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মঈনউদ্দিন বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় সরাসরি জড়িত। পলাতক আসামিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জাহিদ হোসেন, সৈয়দ হাছান আলী, এ টি এম নাছির, আবু সালেহ মুহাম্মাদ আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজ ও রুহুল আমিন।
তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক এম সানাউল হক গণমাধ্যমকে বলেন, পলাতক আশরাফুজ্জামান এখন যুক্তরাষ্ট্রে আর মঈনউদ্দিন আছেন যুক্তরাজ্যে। তাদের ফেরাতে সরকার চেষ্টা করছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো আন্তরিক হলে তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর বাচ্চু রাজাকার কখনো পাকিস্তানে কখনো সৌদি আরবে অবস্থান করেন এমনটা শোনা যায়। তিনি বলেন, গত ১১ বছর শীর্ষস্থানীয় অপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। দেশীয় ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সাফল্য ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হয়। এর প্রায় দুই বছরের মাথায় ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়, যা ট্রাইব্যুনাল-২ নামে পরিচিতি পায়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুই ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। গত ১১ বছরে মোট ৪২টি মামলায় রায় হয়েছে। দণ্ডিত আসামির সংখ্যা শতাধিক।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন ৩০টি মামলা বিচার পর্যায়ে রয়েছে। আর ৬টি মামলা বিচার শুরুর অপেক্ষায় আছে। এর বাইরে মানবতাবিরোধী অপরাধের আরও ২৬টি অভিযোগের তদন্ত চলছে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। তাঁরা হলেন জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলী এবং বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আর আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
এর বাইরে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আবদুল আলীম কারাগারে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আরেক নেতা আবদুস সুবহানেরও মৃত্যু হয়েছে কারাগারে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
এখন পর্যন্ত ৩১টি মামলায় রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-১ এবং ১১টি মামলায় ট্রাইব্যুনাল-২ রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে দুটি ট্রাইব্যুনাল থেকে নয়টি মামলায় রায় হয়। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ৬টি করে মোট ১২টি মামলায় রায় দিয়েছেন দুটি ট্রাইব্যুনাল। ২০১৬, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ট্রাইব্যুনাল-১ ছয়টি করে ১৮টি মামলায় রায় দিয়েছেন। এর আগে ২০১৭ সালে দুটি মামলায় রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-১। গত বছর ট্রাইব্যুনাল থেকে কোনো রায় আসেনি। আর চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি একটি মামলায় রায় দেন ট্রাইব্যুনাল।
রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার হওয়া ৪২ মামলার ১১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন রায় ঘোষণার আগেই মারা যান। একটি মামলায় এক আসামি খালাস পেয়েছেন।
রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের তথ্য অনুযায়ী, ৪২টি মামলায় ট্রাইব্যুনাল ১০৩ জনকে দণ্ড দেন। এঁদের মধ্যে ৭১ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়। আমৃত্যু কারাদণ্ড হয় ২২ জনের। অপর আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ড হয়।
তদন্ত ও বর্তমান মামলা
রাষ্ট্রপক্ষের একাধিক আইনজীবীর তথ্যমতে, বিচার ও প্রাক্-বিচার পর্যায়ে থাকা ৩৬টি মামলায় আসামির সংখ্যা ২২৭। এর মধ্যে কারাগারে আছেন ১২৩ জন, পলাতক ৭৯ জন। ১৯ জন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। বাকি ৪ জন জামিনে আছেন। অপর ২ জন স্বেচ্ছায় ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করেন, তাঁরাও কারাগারে আছেন।
তবে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুসারে, প্রাক্–বিচার ও বিচার পর্যায়ে থাকা ৩০টির বেশি মামলায় আসামির সংখ্যা ২১৫। তাঁদের মধ্যে ৯৬ জন পলাতক ও ৯৮ আসামি আটক আছেন। জামিনে আছেন ৬ আসামি এবং ১৫ আসামি মারা গেছেন।
এখন পর্যন্ত তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ এসেছে ৭৭৮টি, যার মধ্যে ৭৮টি অভিযোগের তদন্ত শেষ হয়েছে। ২৬টি অভিযোগ তদন্তাধীন, যাতে আসামির সংখ্যা ৩৮ জন। এর বাইরে ৩ হাজার ৮৩৯ জনের বিরুদ্ধে থাকা ৬৯৪টি অভিযোগ গ্রহণ করেছে তদন্ত সংস্থা, যা তদন্ত শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘যে স্বপ্ন নিয়ে জাতি ট্রাইব্যুনালের ওপর আশা রেখেছিল, মনে করি ট্রাইব্যুনাল সে আশা পূরণে সক্ষম হয়েছেন। কারণ, ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে যুক্ত বিচারপতি, প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থা ও ডিফেন্স—সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থেকেছেন। গত ১১ বছরে ট্রাইব্যুনাল ৪২টি মামলায় রায় দিয়েছেন, যেখানে ১১৬ জন অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হন।’
সূত্র : প্রথম আলো