সাব্বির এ মুকীম
সাব্বির এ মুকীম

চেক সংক্রান্ত মামলায় ভারত সুপ্রিম কোর্টের দেয়া সাম্প্রতিক গাইডলাইন

সাব্বির এ মুকীম :
ভারতে সুপ্রিম কোর্টের তলবে দাখিল করা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারতের মোট ২কোটি ৩১ লক্ষ ফৌজদারি মামলা চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ লক্ষ ১৬ হাজার মামলাই নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট এক্ট এর ১৩৮ ধারার মামলা। বাংলাদেশ এবং ভারতে এই এন আই এক্ট কার্যকর থাকলেও, ভারতে ২০০২ সালের করা এই আইনের সংশোধনী ২ দেশের আইনে আইনে চোখে লাগার মতো তফাৎ তৈরী করেছে। অবশ্য ২০১৮ সালে আরো ১বার ভারতে আইনটি সংশোধন করা হয়। ভারতীয় সংশোধনী মোতাবেক:

(১) মূল আইনে ১৪১ নম্বর পর্যন্ত ধারা লেখা ছিলো, বর্তমানের ভারতীয় আইনে ১৪৮ নম্বর পর্যন্ত ধারা লেখা আছে।

(২) চেক এর মামলায় সামারি ট্রায়াল বা সংক্ষিপ্ত বিচার এর সুযোগ তৈরী করা হয়। সংক্ষেপে বলতে, সংক্ষিপ্ত বিচারে এই বিধান মোতাবেক যেসব ক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারিক আদালত মনে করবেন যে মামলায় অভিযুক্ত সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদন্ড এবং ৫ হাজার রুপি জরিমানা সাজা পাবেন, সেসব ক্ষেত্রে বিচারিক হাকিম সংক্ষিপ্ত বিচার করবেন। সংক্ষিপ্ত বিচার করা যায়, এমন মামলা সংক্ষিপ্ত বিচার না করে নিয়মিত বিচারে নিতে হলো- বিজ্ঞ আদালত কে তদসংক্রান্ত কারণ আদেশ নামায় আদেশ হিসেবে লিখতে হবে।

(৩) চেকের মামলা ৬ মাসের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করতে বলা হয়।

(৪) বিচারিক আদালত চাইলে অভিযুক্ত কে অন্তবর্তীকালীন জরিমানা ফরিয়াদী বরাবরে পরিশোধ করতে আদেশ দিতে পারবেন। খালাসের আদেশ হলে সুদ সহ ফরিয়াদী তা ফেরৎ দিতে বাধ্য।

(৫) বিজ্ঞ বিচারিক হাকিম চাইলে কুরিয়ারে সমন এর কপি পাঠাবেন। সমন যদি গ্রহন না করার কারণে ফেরৎ আসে, এই গ্রহন না করা কে সমন জারী হিসেবে বিজ্ঞ আদালত গ্রহন করতে পারবেন।

(৬) মামলার যে কোনো পর্যায়ে এফিডেভিটের মাধ্যমে বিজ্ঞ আদালত স্বাক্ষ্য গ্রহন করতে পারবেন।

(৭) চেক প্রত্যাখান সংক্রান্ত ব্যাংক এর মোহরাংকিত সব ধরণের দস্তাবেজ কে “Shall Presume” মাপের স্বাক্ষ্য প্রমান হিসেবে নিতে হবে।

এ ধরণের প্রাগম্যাটিক সংশোধনের পরেও মামলা জটে ১৩৮ ধারার শেয়ার এতো বেশী কেনো তা নিয়ে আলাপ করতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ২০২০ সনের ২ নম্বর সুয়ো মুটো ক্রিমিনাল রিট পিটিশন চালু করেন। অবশ্য ২০১৬ সালে ৫৪৬৪ নম্বর স্পেশাল ক্রিমিনাল লিভ পিটিশন শুনতে গিয়েই এই সুয়ো মুটো চালু করেন। ২০১৬ সালের মামলাটি ২০২১ সাল অবদি ১৬ বছর ধরে চলা চেক এর মামলা।

আলোচ্য সুয়োমুটো মামলায় ২জন এমিকাস কিউরি নিযুক্ত করা হয়। ভারতে এখনো মামলার সাথে সম্পর্ক নেই এমন আইনজীবীকেই এমিকাস কিউরি নিয়োগ দেয়া হয়। ভারতে আজও মামলার বাদী পক্ষের বা বিবাদী পক্ষের নিযুক্ত আইনজীবীর এমিকাস কিউরি হওয়ার জুরিসপ্রুডেন্সিয়াল ইনোভেশন হয়নি।

আলোচ্য এই রুলে ভারত সরকার, ২৫টি ভারতীয় হাইকোর্টের রেজিষ্ট্রার জেনারেল, রাষ্ট্রীয় ও রাজ্য পর্যায়ে পুলিশের ৭জন সর্বোচ্চ কর্তা, ন্যাশনাল লিগ্যাল সার্ভিসেস অথোরিটি এর সদস্য সচিব, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ভারতীয় ব্যাংক এসোসিয়েশন, মুম্বাই কে পক্ষ করা হয়। তাদের কে যার যার বক্তব্য এবং বিজ্ঞ সলিসিটর জেনারেল অব ইন্ডিয়া এডভোকেট বিক্রমজিৎ ব্যানার্জী ভারত সরকারের পক্ষে নিযুক্ত হন।

দাখিলকৃত বক্তব্যগুলা বিবেচনায় নিয়ে এমিকাস কিউরি ৭টি মূল ইস্যু খুঁজে পান, যথা:-

(এ) সমন জারি

(বি) ফৌজদারি কার্যবিধির ২১৯ ধারার সংশোধন

(সি) সংক্ষিপ্ত বিচার

(ডি) ব্যাংক হিসাব বাজেয়াপ্ত করা

(ই) ফৌজদারি কার্যবিধির ২০০ ধারার প্রয়োগ

(এফ) মেডিয়েশন

(জি) বিচারিক হাকিমের সহজাত ক্ষমতা

বিগত ১০ই মার্চ, ২০২১ ইং তারিখে বিজ্ঞ আদালত বোম্বে হাইকোর্টের সাবেক বিচারক বিচারপতি আর সি চাওয়ান কে প্রধান করে ১৩৮ধারার মামরা জট কমানোর ব্যাপারে বিভিন্ন পক্ষের দেয়া পরামর্শ মূল্যায়নের দায়িত্ব প্রদান করেন।

এই রুলে গত বিগত ১৬ এপ্রিল, ২০২১ সালে রুল চলমান রেখেই ভারতের বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি বিচার পতি এস এ বোবদে এর নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের বেঞ্চ একটি আদেশ প্রদান করেন। সে আদেশে বিজ্ঞ আদালত ভারতে এন আই এক্ট এর ১৩৮ ধারার মামলা নিয়ে ৮টি নির্দেশনা প্রদান করেন। সে ৮টি নির্দেশনার সার এর বাংলা তরজমা সংক্ষেপ নীচে দেয়া হলো।:-

১ম নির্দেশনা: ২৫টি হাইকোর্ট কে- সংক্ষিপ্ত বিচার না করে ১৩৮ ধারার মামলা কেনো নিয়মিত বিচারে নেয়ো হলো সে কারণ আদেশ নামায় লিপি করতে বলে বিচারিক হাকিমগণ জন্য কর্ম নির্দেশনা জারি করতে অনুরোধ করা হয়।

২য় নির্দেশনা: যদি নালিশে দেখা যায় অভিযুক্তর ঠিকানা আদালতের এখতিয়ারের বাইরে পড়ে, তবে অভিযোগ আমলে নেয়ার আগে তদন্ত করতে হবে।

৩য় নির্দেশনা: ফৌজদারি কার্যবিধির ২০২ ধারায় তদন্ত করার সময় স্বাক্ষীগণের বক্তব্য এফিডেভিট আকারে নেয়া যাবে। এমনকী বিজ্ঞ বিচারিক হাকিম চাইলে কোনো স্বাক্ষী না নিয়েই কেবল কাগজাদী পরীক্ষা করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিতে পারবেন।

৪র্থ নির্দেশনা: একই লেনদেনের ফলে ১২ মাসের মধ্যে উদ্ভুত ১ এর অধিক চেক সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ে একজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ১টি মামলা করার সুযোগ দিয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ২১৯ ধারার নিষেধ অকার্যকর করে এন আই এক্ট সংশোধন করার সুপারিশ করা হয়।

৫ম নির্দেশনা: ২৫টি হাইকোর্ট কে ১টি নালিশে সমন জারি হলে তা ১ই লেনদেনে ১ই অভিযুক্তের দেয়া অন্য সব চেক সংক্রান্ত নালিশের সমন জারি হিসেবে গ্রহন করতে বলে সকল বিচার আদালতের জন্য কর্ম নির্দেশনা জারি করতে অনুরোধ করা হয়।

৬ষ্ঠ নির্দেশনা: ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালতের সহজাত ক্ষমতা নেই স্বীকার করে নিয়েই সিদ্বান্ত দেয়া হয়, বিধির ৩২২ ধারা মতে বিচারিক আদালত এখতিয়ারহীনতা জনিত কারণে আগে আদেশে পূণরায় বিবেচনা করতে পারবেন।

৭ম নির্দেশনা: বিদ্যমান আইনে ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫৮ ধারার এন আই এক্ট এ ১৩৮ ধারার মামলায় প্রযোজ্য নয়। এন আই এক্ট এর ১৩৮ ধারার মামলায় বিচারিক আদালত কে সমন পূর্নবিবেচনা ও ফেরত এর আদেশ দানের ক্ষমতা দিতে আইনে কি ধরণের সংশোধনী দরকার, সে ব্যাপরে বিচারপতি আর সি চাওয়ান এর কমিটিকে মতামত দিতে বলা হয়।

৮ম নির্দেশনা:- আলোচ্য আদেশে আসেনি, কিন্তু শুনানীতে বা পক্ষগণের বক্তব্যে এসেছে, এমন সব বিষয়ে বিচারপতি আর সি চাওয়ান এর কমিটিকে মতামত দিতে বলা হয়।

রুল টির গুরুত্ব বিবেচনায় রুল শুনানীর জন্য ৩ সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ এ রুলটি প্রেরণ করার সিদ্বান্ত হয়। তুলনামূলক পর্যবেক্ষণে এ কথা সবাই স্বীকার করে নিবে যে ভারতের মতো বাংলাদেশেও এন আই এক্ট এর ১৩৮ ধারার মামলাগুলো শরীরে ক্যান্সার রোগের মতো বাংলাদেশের বিচার ব্যাবস্থার রোগ বলে চিহ্নিত করা যায়। সেজন্য ভারতীয় এই চিকিৎসা প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে আমাদের মনোযোগের দাবী রাখে।

লেখক : আইনজীবী, কুমিল্লা জজ কোর্ট।