রাজীব কুমার দেব, সিনিয়র জুড়িসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।

শিশুর দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড কি অবৈধ? একটি আইনি পর্যালোচনা

রাজীব কুমার দেব:

শিশু আইন, ২০১৩ ইং এর প্রায়োগিক জটিলতা যেন থামছেই না। মহামান্য হাই কোর্টের আনিস মিয়া বনাম রাষ্ট্র রায়ের বিচারিক পর্যবেক্ষণে শিশু আইন, ২০১৩ এ শিশুর ১৬৪ ধারার কথিত জবানবন্দির বিষয়ে কিছু নেই এবং শিশুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দির সাক্ষ্যগত মূল্য নেই মর্মে উল্লেখ করায় শিশুর অভিযুক্তের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা বিষয়ে আইনি বিতর্ক দেখা দিয়েছে। যদিও এই রায়ে শিশুর দোষ স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা যাবে না মর্মে কোন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। আবার

Bangladesh Legal Aid and Services Trust and another Vs Bangladesh and others ও Jaibir Ali Fakir Vs State মামলাতেও রিট এখতিয়ার শিশুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দির ভিত্তিতে সাজা এখতিয়ার বিহীন মর্মে ঘোষণা করা হয়েছে। এমতাবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে শিশু অভিযুক্তের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা কি অবৈধ?

উল্লেখ্য শিশু আইন,২০১৩ বিষয়ে বর্ণিত তিনটি রায় ছাড়াও the State Vs. Ministry of law, Justice and Parliamentary Affairs and others মোহাম্মদ শুক্কুর আলী বনাম রাষ্ট্র, ফোজদারি আপীল নং ১৫৮১/২০২১ ও বিগত ১০/০৩/২০২১ ইং তারিখের সার্কুলার রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে শিশু আইনের কাঠামো ও পরিধি বিবেচনায় অন্যান্য আইনের সাথে এই আইনের প্রয়োগে কতেক জটিলতা ও আইনি অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। এমনকি মহামান্য হাই কোর্ট কেও জটিলতা ও অস্পষ্টতা দূরীকরণে নির্দেশনা দিতে হয়েছে। (বিশেষ আইনে অভিযুক্ত শিশুর অপরাধের আমল গ্রহণ করবেন কে?, “প্রসঙ্গ গ্রেফতারকৃত শিশু অভিযুক্ত ও শিশু আদালত: একটি সাংবিধানিক অসামঞ্জস্যতার প্রশ্ন“, “A Landmark Judgment on Mobile Court“) এমনকি৷ মহামান্য হাই কোর্টের দৈত বেঞ্চের ফৌজদারি আপীল নং ১৪৮১/২০২১ এর নির্দেশনা অনুসারে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগ বিগত ১০/০৪/২০২১ ইং তারিখের ০৪/২০২১ নং বিজ্ঞপ্তি মূলে দেশের সকল আদালত কে Meticulously শিশু আইন,২০১৩ অনুসরণ করতে বলা হয়। তাই শিশু আইন, ২০১৩ প্রয়োগে নতুনভাবে যেন জটিলতা ও আইনি অস্পষ্টতা তৈরি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি।

এখন শিশু আইন, ২০১৩, ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮, শিশু আইনের উপর মহামান্য উচ্চাদালতের পাচটি রায় এবং সর্বোপরি আইন বিজ্ঞানের নীতি বিচার বিশ্লেষণে শিশুর দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা বৈধ হবে কিনা তা নিরূপণ করে দেখা যাক।

আইন বিজ্ঞানে নজীর (Precedent) একটি মৌলিক দিক। Ratio Decidendi নজীরের একটি অংশ। এই নীতি অনুসারে উচ্চাদালতের সিদ্ধান্ত অধঃস্তন আদালতের উপর বাধ্যকর। সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ নজীরকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আনিস মিয়া বনাম রাষ্ট্র সহ অন্য দুইটি রায় পর্যালোচনায় দেখা যায় কোন রায়েই শিশু অভিযুক্তের ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা যাবে না মর্মে নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। সুতরাং শিশু অভিযুক্তের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড না করার বিষয়ে উচ্চাদালতের কোন নজীর নেই।

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড একটি বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়া যা ম্যাজিস্ট্রেটের উপর বাধ্যকর। তবে তিনি “True and Voluntary” নয় অথবা অভিযুক্ত জবানবন্দি প্রদানে অস্বীকার করছেন অথবা বিশেষ আইন দ্বারা জবানবন্দি গ্রহণ বারিত – এই তিনটি কারণ ব্যতিত একজন ম্যাজিস্ট্রেট শিশু অভিযুক্তের জবানবন্দি রেকর্ড করা হতে বিরত থাকতে পারবেন না। এই বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়া কে সংকুচিত বা বারিত বা প্রয়োগ করা হতে বিরত রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট আইনে সংশোধনী আনতে হবে। উপযুক্ত সংশোধন ব্যতিত শিশুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দি রেকর্ড করা যাবে না মর্মে মতামত প্রদান করা হলে আইনি শূন্যতা তৈরি হবে।

আনিস মিয়া বনাম রাষ্ট্র সহ অন্য মামলার রায়ের অবজারভেশনে বা সাক্ষ্য বিশ্লেষণে শিশুর ১৬৪ জবানবন্দি রেকর্ড না করার জন্য যে সকল কারণ দেখানো হয়েছে তা “Matters to be considered in view of the merit sustaining in that particular case with a view to entering into its judicial decision. মহামান্য উচ্চাদালতের এই বিবেচনা কে generalise করার সুযোগ নেই। কারণ এটি Ratio Decidendi এর অংশ নয়। তাছাড়া উল্লিখিত রায়ে শিশু অভিযুক্তের জবানবন্দির বিষয়ে যে সকল বিচারিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে তা গৃহীত জবানবন্দির সাক্ষ্যগত মূল্য বা গুণাগুণের উপরে; জবানবন্দি রেকর্ড করা যাবে কি যাবে না তার উপর নয়। তদহেতু উক্ত সাক্ষ্যগত মূল্য বা গুণাগুণ কি হবে না হবে তা মাননীয় শিশু আদালতের বিবেচ্য বিষয়; বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের নয়।

‘আনিস মিয়া বনাম রাষ্ট্র’ মামলায় কোনো শিশুকে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না মর্মে বলা হয়েছে। এটি মহামান্য হাই কোর্টের বিচারিক অবজারভেশন যা Assessment/Evaluation of Evidence এর অংশ যা ১৬৪ ধারার জবানবন্দি কে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করবে কি করবে না তদবিষয়ে; জবানবন্দি রেকর্ড করবে কি করবে না তদবিষয়ে নয়।

শিশুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দি রেকর্ড করা এবং গৃহীত জবানবন্দির সাক্ষ্যগত মূল্য বিবেচনা করা দু’টি পৃথক ক্ষমতা যা ভিন্ন দু’টি আদালত (ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ও শিশু আদালত) কর্তৃক প্রয়োগযোগ্য। তবে এ দু’টি ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয় যথাক্রমে জেনারেল ও সাক্ষ্য গ্রহণ পর্বে। অভিযুক্তের ১৬৪ ধারার জবানবন্দি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে না এই অজুহাতে জবানবন্দি রেকর্ড করা হতে বিরত থাকা কোনভাবেই কাম্য নয়। কেননা সাক্ষ্য আইনের মৌলিক নীতি অনুসারে জেনারেল পর্যায়ে সংগৃহীত সাক্ষ্য প্রমাণ বিচার পর্বে সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে কিনা তদবিষয়ে সম্পূর্ণভাবে বিচারিক আদালতই সিদ্ধান্ত নিবেন; জেনারেল কোর্ট নয়। জেনারেল কোর্ট কে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতেই হবে।

শিশু আইন, ২০১৩ এর ৪২ ধারার মাধ্যমে ফৌজদারী কার্যবিধির বিধানাবলী, (যতদূর সম্ভব) প্রযোজ্য ও অনুসরণ করার বিধান আছে। তাই ৪২ ধারার মাধ্যমে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার বিধান কে accessibility দেওয়া হয়েছে। ৪২ ধারার উপস্থিতিতে আর কোন প্রকাশ্য ঘোষণার প্রয়োজন পড়ে না। ফৌজদারি আপীল নং ৭৫৩৩ এর বিগত ০১/০৮/২০১৯ ইং তারিখের মহামান্য হাই কোর্টের আদেশে যে সাতটি নির্দেশনা ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল – অভিযুক্ত শিশুর জবানবন্দি ম্যাজিস্ট্রেট লিপিবদ্ধ করতে পারবেন। সুতরাং শিশু অভিযুক্তের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ডর জন্য আর কোন আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন নেই।

যদি মনে করা হয় যে “অভিযুক্ত শিশুর ১৬৪ ধারার জবানবন্দি শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়” তাহলে এটি একটি Pre conceived ধারণা হবে যা নিশ্চিতভাবেই Risky administration of justice এর কারণ হতে পারে। এই Pre conceived ধারণাই কিন্তু অভিযুক্ত শিশুর জবানবন্দি রেকর্ড না করার বিষয়ে উৎসাহিত করে।

১৬৪ ধারায় জবানবন্দি মামলার তদন্ত পর্যায়ের একটি প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন তথ্য উদঘাটনের সম্ভাবনা থাকে। তাই ” শুধুমাত্র সাক্ষ্যগত মূল্য নাই” এরূপ অযাচিত বিবেচনায় অভিযুক্ত শিশুর জবানবন্দি গ্রহণ না করলে একদিকে যেমন বিচারিক অপরিপক্কতা হবে অন্যদিকে তদন্তে নতুন তথ্য উদঘাটনে তথা তদন্তকার্যে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সামিল হবে।

সাক্ষ্য আইনের ২৫ ধারা অনুসারে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও শিশু আইনের ৪৭ ধারা শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা কে শিশুর জবানবন্দী গ্রহণ করার ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু সাক্ষ্য আইনের ২৪ ও ২৮ ধারা অনুসারে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট যদি শিশু অভিযুক্তের জবানবন্দি রেকর্ড করতে না পারেন তাহলে বিচারিক ব্যবস্থায় নির্বাহী আচরণের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়তে বাধ্য।

প্রাসঙ্গিক কিছু বিচারিক সিদ্ধান্ত উল্লেখ করা যেতে পারেঃ- ” What is binding as the ratio of a decision and not the finding of fact or the conclusion reached by the court”..Sufia Khatoon VS Mahbuba, 2010 BLD (AD) 41

“Unless a principle is laid down, a decision given in exercise of the power of doing complete justice under art. 104 cannot operate as a binding precrdent”… Municipal Corp. Of Delhi V Gurnam Kaur, AIR 1989 SC 38

“A decision, which is per inquriam, that is, a decision given in ignorance of the terms of the constitution or of law or of a rule having the force of law, does not constitute a binding precedent”.. Sufia Khatoon VS Mahbuba, 2010 BLD (AD) 41

“A statement of law which is obiter dicta cannot operate as a binding precedent as it was unnecessary for the decision in the case.”.. A.D.M. VS Shukla, AIR 1976 SC 1207

‌”If that statement of law has been made in a decision after due consideration, even though unnecessary, it need not fall outside the pale of art.111 and according to the Indian Supreme Court its obiter dicta should be treated as binding precedent… C.I.T. VS Vazir Sultan & Sons, AIR 1959 SC 814

সার্বিক পর্যালোচনায় শিশু আইন, ২০১৩ এর ৪২ ধারা বলবত থাকাবস্থায় এবং মহামান্য হাই কোর্ট ডিভিশনের আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা কার্যকরী থাকায় আনিস মিয়া বনাম রাষ্ট্র মামলায় অবজারভেশন সত্ত্বেও শিশু অভিযুক্তের জবানবন্দি রেকর্ডে কোন প্রভাব ফেলবে না। বরং এর ব্যত্যয় administration of Justice কে অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত করার সামিল হবে। তবে বিধিবদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ করার সময় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যদি মনে হয় যে শিশু অভিযুক্তের জবানবন্দি true and voluntary হবে না তখন তিনি উপযুক্ত কারণ লিপি করে জবানবন্দি রেকর্ড করতে অপারগতা প্রকাশ করতে পারেন।

লেখক: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজার